কনকনে শীতের দেশে ৩৮ বছর
শীত কারে কয়, ছোটবেলার শীত আর এখনকার শীত আকাশ-পাতাল ব্যবধান। থাকি সাদা ভালুকের দেশে। পুরো দেশ শীতকালে বরফে থাকে ঢাকা। সুইডেন চার ঋতুর দেশ হলেও আমার কাছে শীত কমপক্ষে বারো মাস যদি বাংলাদেশের পৌষ ও মাঘ মাসের সঙ্গে তুলনা করি। সুইডেনের যে সময়টিকে গ্রীষ্মকাল বলা হয়, সে সময়টি বাংলাদেশের শীতকালীন সময়ের মতো। তবে সুইডেনে প্রকৃত শীত নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে। এপ্রিল থেকে বরফ গলতে শুরু করে সুইডেনের এক-তৃতীয়াংশ জায়গায়। সুইডেন একটি লম্বা দেশ, দক্ষিণে তাপমাত্রা +৩০ ডিগ্রি থেকে শুরু করে -৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অন্য দিকে উত্তরে স্বল্প সময়ের জন্য +৩০ ডিগ্রি জায়গা বিশেষ হলেও বেশির ভাগ সময়েই -৩০ ডিগ্রি থেকে শুরু করে -৬০ ডিগ্রি অবধি তাপমাত্রা হয়ে থাকে।
আমরা মানুষ জাতি, আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। যদি সেটা হঠাৎ করে ৩৭ ডিগ্রি বা তার বেশি হয়, তখন জ্বর হয়েছে ধরে নিই, শরীর ৩৭ ডিগ্রির বেশি গরম হলে কী অবস্থা হয়, তা কি বলার প্রয়োজন আছে? আমাদের দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশে যখন তাপমাত্রা +৪০ ডিগ্রি হয়, কী বিরক্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা–ও বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। এখন ভাবুন, যখন তাপমাত্রা -২০ থেকে শুরু করে -৬০ ডিগ্রির মধ্যে থাকে তখন বাইরে সাধারণভাবে চলাচল করার প্রশ্নই আসে না। সে ক্ষেত্রে শরীরের কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। পানি যাতে জমে না যায়, তার জন্য বিশেষ টেকনিক ব্যবহার করে পানির সাপ্লাই সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এত সমস্যা সত্ত্বেও মানুষ জাতি বহু বছর থেকে এসব জায়গায় বসত করে চলছে। বর্তমান বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে ঠান্ডা দেশগুলো তুলনামূলকভাবে সব দিক দিয়ে উন্নতির শীর্ষ পর্যায় রয়েছে। ফলে সবাই এসব দেশে বসবাস করে চলছে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে মানুষ জাতি বসবাসের জন্য এসব দেশ বেছে নিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, আমার মতো অনেকে লেখাপড়া করতে এসে নানা কারণে এখানে রয়ে গেছে। অনেকে নানাভাবে চেষ্টা করছে নিজ দেশ ছেড়ে বরফের দেশে বসত করতে, শুধু জীবনের নিশ্চয়তার কারণে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে জীবনের নিশ্চয়তা বলতে কী বোঝায়? অগাধ সম্পত্তির মালিক? কিন্তু যারা তার নিজ দেশে অগাধ সম্পদের মালিক, তারা কেন বরফের দেশে আসার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, সবকিছু করছে? তাদের তো নিজ দেশে কোনো কিছুর সমস্যা নেই, তারপরও সুযোগ পেলেই সবাই দেশ ছাড়তে প্রস্তুত।
আমি শুরুতে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে কিন্তু সুইডেনে আসি, পরে চাকরি, বিয়ে, ছেলেমেয়ে সবকিছুর কারণে এখানেই আছি। আমার শ্বশুরের বাড়ি স্পেনে, শাশুড়ির বাড়ি সুইডেনে। স্পেন কোনো অংশেই সুইডেনের থেকে খারাপ নয়, তারপর আবহাওয়া ভালো। তারপরও আমার শ্বশুর শত চেষ্টা করেও সেখানে আমাকে নিতে পারেনি। এদিকে আমার বউ, শ্বশুরের একমাত্র মেয়ে, স্পেনে যা আছে তাতে বর্তমান পরিবেশের চেয়ে ভালো ছাড়া খারাপ থাকার কথা নয়, এমনকি বাংলাদেশে আমার বাবার যা রয়েছে, তাতে আমার এবং আমার স্ত্রীর সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তারপরও আমরা সুইডেনেই বসবাস করছি। কী এমন কারণ যে আমি ও আমার স্ত্রী সুন্দর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সুইডেন ছেড়ে যাচ্ছি না, এমনকি বাংলাদেশ ও স্পেনে খুব একটা বেড়াতেও যাই না? স্পেনে দু–এক বছর পর গেলেও মারিয়ার বাবার বাড়ি গিয়েছিলাম এবার প্রায় ২৪ বছর পর। বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। ভাবনার জগতে ঘোরাঘুরির পর যে সারাংশে এসেছি, তার কিছু অংশ শেয়ার করব।
আমি আমার হৃদয়ে বাংলাদেশ বলতে যেটা মনে করি, সেগুলো হলো আমার ছোটবেলার দিনগুলো। শীতকে নিয়ে লিখতে শুরু করেছি, তাই শীতের দিনগুলোর ওপর স্মৃতিচারণা করি।
আমি আমার গেঁয়ো ভাষায় ফেসবুকে আজ এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথোপকথনে যেভাবে মনের কথা প্রকাশ করেছি, সেটা ছিল এ রকম:
‘Md Habibullah লিখেছে আমাকে, ও জাগা জাড় কিরামের ভাই?’
আমি উত্তরে লিখেছি, ‘জাড়ে গা-গতর ভাঙ্গে নিচ্ছেরে ভাই।’
Md Habibullah লিখেছে, ‘Rahman Mridha ভাই, এ জন্যই আপনাকে ভালোবাসি একটু বেশিই, সুদূরে থাকলেও আপনার গতরে আমার মাটির গন্ধ খুঁজে নিতে কোনো সময় লাগে না। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। আমার সোনার বাংলা সেখানেই থাকে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে বাংলায়।’
আমি Md Habibullah-কে লিখেছি, ‘ও মণি, ছোটবেলা বিয়ানে (সকালে) খ্যাড়-কুটো জ্বালায়ে পাড়ার কুটি ভাইডি-বুন্ডিরা সগোলি (সবাই) একসঙ্গে আগুনির তাপ পুয়াতাম, পরে মাঠ যাইয়ে ছুলা গাছ আগুনি পুড়াতাম। ছুলা পুড়ে মচমচে অয়ে যাতো, তারপর পুড়া ছুলা ফু দিয়ে খাতাম, সে যে কী মজা লাগতোরে ভাইডি! তোরা কি ওসব করিস এহন?’
Md Habibullah লিখেছে, ‘Rahman Mridha ভাই, আপনি যিডা করে গেছেন, উডা এহনো আমরা চালাই যাচ্ছি। তয় আগুন পুয়ানো দেহিনে।’
আমার কাছে বাংলাদেশ মানে আমার ধরন, বরণ, অনুকরণ, অনুসরণ কিন্তু এসব কিছু এখন এই অবর বেলায় ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই মনকে বলি, ডেকো না আমারে তুমি পিছে ডেকো না, দূরে আছি সেই ভালো নিয়ে বুক ভরা ভালোবাসা।
আমার বউকে বলেছিলাম, চলো, স্পেনে চলে যাই। সে বলল, হঠাৎ সেখানে, কেউ তো আর আগের মতো নেই! আমি বললাম, চলো ঘুরে আসি, তারপর দেখি কী মনে হয়? গিয়েছিলাম গত এপ্রিল মাসে মারিয়ার বাবার বাড়িতে, তিন-চার দিন ছিলাম। ঘুরে ছিলাম তার পাড়া, গ্রাম শহর। সে বলে, কিছু আর সেই আগের মতো নেই। কোনো কিছুরই অভাব নেই, তারপরও সে বলে কিছু নেই। একই কথা, এই অবর বেলা সেই ছোটবেলায় কীভাবে ফিরে যাব? তারপর আধো কিছু বিষয় আছে, যা আমার বেলায় কিছুটা ভিন্ন, যেমন আমার বাবা-মা, ভাইবোন কেউই বাংলাদেশে থাকে না, বাবা-মা মারা গেছেন। একটি ভাই দেশে থাকেন কিন্তু পারিবারিক মত–দ্বিমত ভিন্ন হওয়ায় তেমন কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে, ফলে দেশে সব থাকতেও ঠিকমতো সেখানে আসা-যাওয়া হয় না। তারপরও আমি মন থেকে চেষ্টা করি অগত্যা দেশের মানুষের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াতে। আমি ইদানীং একটি জিনিস লক্ষ করেছি। যেমন অনেকে বিদেশে থাকে বটে, তবে তাদের চিন্তায় তারা বাংলাদেশে পড়ে আছে, এমন নয় যে তারা অন্যের কথা ভাবে! তারা নিজেদের নিয়েই মূলত ব্যস্ত, তবে বিদেশে কষ্টে আছে, তবুও ভাবছে দেশে ফিরে যাবে কোনো একসময়। পরে দেখা যাচ্ছে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিদেশ ছাড়তে পারছে না, শেষে ধুঁকে ধুঁকে বিদেশেই মরছে। এমতাবস্থায় আমি মনে করি, সত্যিই যদি বিদেশে খাপ খাওয়া সম্ভব না হয়, তবে অবসরের সঙ্গে সঙ্গে দেশে গিয়ে বাকি জীবনটা সেখানে কাটানো ভালো। আর যদি সেটা সম্ভব না হয়, তবে বিদেশেকে আপন করে নেওয়া ভালো।
অন্যের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে বরং নিজের কথায় ফিরে আসি। হতে পারে জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় বিদেশে কাটিয়েছি, সবকিছু এখন এখানে। নিজেকে নতুন দেশের মাইনাস তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছি, সেই সঙ্গে হৃদয়ের মাঝে ছোটবেলার সেই বাংলাদেশের স্মৃতিকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছি যে সুইডেনেই এখন ‘লিটল বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছি। সবকিছু সেই ছোটবেলার মতো হবে না, তবে অনেক কিছুই হয়েছে। আর যা হয়নি, তা–ও কমবেশি হয় প্রতিদিন, যখন বন্ধুবান্ধবসহ দেশের মানুষের কথা ভাবি, তাদের জন্য কিছু করি, নিজের মনের কথা এভাবে লিখি, শেয়ার করি। সুইডেনে গর্বিত বাঙালি হয়ে চলি, আর কী চাই! সবকিছুর পরও—যায় যদি যায় যাক, এই মন হারিয়েই যাক না, নিষেধের বাধা নেই, ওই নীল শূন্যের সব সীমা ছাড়িয়েই যাক না...। সুইডিশ গ্রীষ্মে যখন খেতে বাংলা শাকসবজি রোপণ করি, তখন মনে হয় এ বাতাস হৃদয়ে বেশ খুশি খুশি লাগে, এ পলাশ মনে হয় হাসি হাসি। গ্রীষ্মে নতুন রঙের ছোঁয়ায় হৃদয় রাঙে। নতুন আলোর জোয়ারে খুশির বাঁধও ভাঙে। কনকনে শীতের দেশে এত বছর পরও যখন কেউ ভালোবেসে, নিভৃতে যতনে বলে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে। যখন সে এ–ও বলে, আমার পরানে যে গান বাজিছে, তাহার তালটি শিখো তোমার চরণমঞ্জীরে। পারি কি তারে না ভালোবেসে থাকিতে? তা যেমন পারিনে, ঠিক তেমনি সোনার বাংলাকে, সেখানের সবকিছুকে ভুলিতে পারিনে, কারণ, সে যে আমার প্রিয় জন্মভূমি।