ডু অর ডাই

অলংকরণ: আরাফাত করিম

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়নের একবারে শেষ প্রান্তে কদমতলী গ্রামটি। অগুনতি গাছপালা আর পুকুরে ভরা চারদিক। পাশেই বিশাল গুমাই বিল। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ—সবাই মিলেমিশে থাকত।

পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর দেড় কিলোমিটারের দূরের চন্দ্রঘোনা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করালেন অভিভাবক। কারণ, বিদ্যালয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, পূর্ণ অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ার সুযোগ দেবে। কর্তৃপক্ষ ভর্তি করাল বি সেকশনে। ১৯৮৬ সাল।
দ্বিতল বিদ্যালয় ভবন। দ্বিতীয় তলায় ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হতো। বিদ্যালয়ের সামনে ছিল বিশাল খেলার মাঠ, পাশেই বিশাল পুকুর আর অনেক নারকেলগাছ!

শৈশবের আনন্দময় সময়ে হইহুল্লোড় করে মেঠো পথ ধরে বিদ্যালয়ে যেতাম ও ফিরতাম।

অনেকটা সময় বয়ে গেল!

স্যাররা খুব ভালো। শ্রেণিকক্ষে বেত থাকত, তবে বেত্রাঘাত ছিল না বললেই চলে। বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী ছিল, তবে তুখোড় মেধাবী ছিল কম, গ্রামের বিদ্যালয়। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আমাদের বিদ্যালয়মুখী করে রাখত সব সময়। দপ্তরি সাইফুলের চমৎকার ঘণ্টাধ্বনি হৃদয়ে আটকে গিয়েছিল তত দিনে।
১৯৮৮ সাল।
দশম শ্রেণিতে পৌঁছে গেলাম।

অষ্টম শ্রেণিতে গণিতে পাস করতে না পারায় ক্রমিক সংখ্যা অনেক দূরে চলে যাওয়ায় মানসিক ভীষণ চাপে ভুগছিলাম। মেধাবী ছিলাম না। মুখস্থ আর কৌশলে সব বিষয়ে পাস করে মেধাবীদের দলকে একটু চমকে দিলাম বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের দিন। লাকি সেভেনে অবস্থান হলো।

শ্রদ্ধেয় জ্ঞানদা রঞ্জন বিশ্বাস ছিলেন অন্য এক বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য সাবেক প্রধান শিক্ষক, বয়স সত্তরোর্ধ্ব। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে পড়াতেন দশম শ্রেণির ইংরেজি ব্যাকরণ। বাংলা যেখানে ভালো নয় আমার, ইংরেজি তো এক ভয়ংকর বিষয়! তাই কয়েক বেঞ্চ পরে বসতাম। প্রাক্‌-নির্বাচনী পার করলাম। প্রচণ্ড চাপে নির্বাচনী পরীক্ষার জন্য আমরা সবাই। আবার আমি তো আছি মুখস্থ আর কৌশলী প্রচেষ্টায় ওপরে ওঠার সুচেতনায়।

একদিন জ্ঞানদা স্যার পড়াচ্ছেন। পড়ান খুব ধীরেসুস্থে। পড়াচ্ছেন প্রবাদ বচন ইংরেজি থেকে বাংলাকরণ। বরাবরের মতো কয়েক বেঞ্চ পেছনে আমি। স্যার মেধাবী শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করছেন, তারা উত্তরও দিচ্ছে পটাপট। নীরব আমি। স্যার বললেন, ‘ডু অর ডাই’-এর বাংলাকরণ কী? মেধাবী শিক্ষার্থীরা বলতে থাকল সরাসরি, ‘করো বা মরো’। কেউ কেউ চেষ্টা করছিল ভেবে বের করতে আসলে কী হতে পারে?

এটা আমার জানা ছিল। অপেক্ষায় ছিলাম। কেউ পারল না!
একসময় উঠে বললাম, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন।’
‘ভেরি গুড, সিট ডাউন’ বলে স্যার বিশাল ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে লাগলেন।
বন্ধুরা থ হয়ে গেল আমার মতো বোকার ছক্কায়!
এসব ভেবে ভেবেই পার হই হাডসন নদীর ওপর ব্রুকলিন ব্রিজটি!

*লেখক: রতন জ্যোতি, ব্রুকলিন, নিউইয়র্ক

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]