জনম জনম—মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসার গল্প

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বইটির পূর্বকথাতে লেখক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘“মৌনব্রত” নামে দৈনিক বাংলায় একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করেছিলাম। সেখানে হঠাৎ “তিথি” নামের একটি চরিত্র চলে এল। নিশিকন্যা। লক্ষ্য করলাম, তার কথা লিখতে বড় ভাল লাগছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই জাতীয় মেয়েদের আমি চিনি না। শুধু কল্পনার আশ্রয় করে তো আর একটি লেখা দাঁড় করানো যায় না। আমি নানান জনের কাছে যাই, কেউ তেমন সাহায্য করেন না।

‘মজার ব্যাপার হল সাহায্য পেয়ে গেলাম অকল্পনীয় একটি সূত্র থেকে। এই ভূমিকায় গভীর মমতা ও ভালোবাসায় সেই সূত্রের ঋণ স্বীকার করছি।

‘বইটি শুরুতে “রাত্রি” নামে ছাপা হচ্ছিল। একদিনের কথা, উপন্যাস লিখছি, আমার স্ত্রী রেকর্ড প্লেয়ারে গান বাজাচ্ছেন—হঠাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় চলে গেল গানে— “জনম জনম তব তরে কাঁদিব”। গান শুনতে শুনতে নিজে খানিকক্ষণ কাঁদলাম এবং পরে উপন্যাসের নাম পাল্টে দিলাম, “রাত্রি” থেকে তা হয়ে গেল “জনম জনম”।

আমার প্রকাশক খুব বিরক্ত হলেন। রাগী-গলায় বললেন, এসব কি করছেন— “রাত্রি” নামে ফর্মা ছাপা হয়ে গেছে। আমি বললাম, হোক। প্রকাশক চোখের দৃষ্টিতে আমাকে ভস্ম করতে চাইলেন—পারলেন না। যে কম্পোজিটর এই বই কম্পোজ করত, সে আমার কাটাকাটির বহর দেখে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেল—নানান যন্ত্রণা। তবু সব যন্ত্রণার পরেও বইটি বের হচ্ছে—এই আমার আনন্দ।’

এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে বইটির বিষয়বস্তু কী। এই পেশার মানুষেরা বাংলাদেশে বিশেষভাবে নিগৃহীত। সবাই সুখের খোঁজে তাঁদের কাছে যায় কিন্তু কেউই তাঁদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজি নয়। বাংলাদেশের সমাজে তাঁদের নিয়ে অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা চলে। জীবনমুখী গায়ক নচিকেতা তাঁর ‘বারো টাকা’ গানে এই পেশার মানুষদের জীবনপ্রণালি তুলে ধরেছেন—
‘যখন, ঘনায় রাত্রি এই পাথুরে শহরে
যখন, ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস আকাশ অঝোরে
ঠিক তখখুনি সস্তার মেকাপেতে মুখ ঢেকে লাজলজ্জার সংস্কারকে পিছে রেখে
এই সাধারণ মেয়েটাই শহরে বিলোতে প্রেম রাস্তায় এসে দাঁড়ায়
প্রেমহীন শহরের কদর্য লোকগুলো তার কাছে প্রেম চেয়ে দুহাত বাড়ায়’

এই বইয়ের মূল চরিত্র তিথি। লেখক পরম মমতায় তিথির চরিত্রটি তৈরি করেছেন। তিথির সঙ্গে উঠে এসেছে তার পরিবারের গল্প। মা মিনু, বাবা জালালুদ্দিন, বোন অরু যার ভালো নাম শাহানা বেগম, ভাই হীরু আর টুকু, ভাইয়ের বউ এ্যানা। এ ছাড়াও আছে তিথির দালাল নাসিম, তার একজন মক্কেল দবির উদ্দিন, দবির উদ্দিনের স্ত্রী ফরিদা, মেয়ে অজন্তা। আরও আছে মনজুর। আছে পাড়ার ছেলে বজলুর কথাও। আর অবধারিতভাবেই আছেন একজন পীর সাহেব, যিনি তার মুরিদদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেন না কিন্তু দামি সিগারেটের প্যাকেট নেন। আমরা খুব ভালোভাবেই জানি বাংলাদেশের মানুষদের জীবনে পীরফকিরদের অবস্থান কতটা শক্ত। লেখক তিথির এমন পেশায় আসার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি এই পেশা নিয়ে বেঁচে থাকার মানসিক যন্ত্রণার দিকগুলোতেও এল ফেলেছেন। ফলে আমরা তিথির প্রতি ঘৃণা পোষণ করি না বরং তার প্রতি মায়ায় আমাদের হৃদয় আদ্র হয়ে আসে।

প্রথমেই নজর দেওয়া যাক তিথির মায়ের দিকে। একাই শক্ত হাতে একটা বড় সংসারের হাল ধরে আছেন। যেই সংসারে উপার্জনক্ষম কোনো মানুষ নেই। সেই সংসারে সত্যিকার অর্থেই নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ঘরে হারিকেনের আলো জ্বালাবার মতো তেল থাকে না। যেই সংসারে ভাত রান্না হয় মানুষের মুখ গণনা করে। তাই কোনো কারণে কেউ যদি বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তাহলে মিনু যেন খুশিই হয়। কাউকেই তিনি খেতে ডাকেন না। কারণ, কেউ যদি না খায় তাহলে তার খাবারটা বেঁচে যায়। তিনি জানেন তিথি কীভাবে টাকা উপার্জন করে আনে, তবুও তিনি কিছুই করতে পারেন না। আবার এমনও হয় যে তাকেই বাজারে যেতে হয়। ভারী চালের বস্তা বয়ে বাড়ি ফিরে যন্ত্রণায় কাতরাতে হয়। এমনই এক কঠিন জীবন মিনুর।  

তিথির বাবা জালালুদ্দিন প্রায় অন্ধ একজন মানুষ। সংসারে যে তিনি আছেন, এমনটা টের পাওয়া যায় না। কারণ, সংসারে তার আসলে কোন ভূমিকা নেই। তিনি অনেকটা সাক্ষী গোপালের মতো নিষ্ক্রিয় দর্শক। যদিও তিনি চোখে দেখেন না। তিনি মাঝেমধ্যে উচ্চবাচ্য করে নিজের অবস্থান জানান দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করেন কিন্তু মিনুর ধমক খেয়ে তাকে থেমে যেতে হয়। তাকে সংসারের কেউই পাত্তা দেয় না। সবাই তার অভিযোগ, আবদার, অনুরোধ শোনে কিন্তু কেউই সেটা রাখার দরকার মনে করে না। সংসারের কঠিন সময়ের মধ্যেও তার বংশ পরিচয় টনটনে। কিছু একটা ঘটলেই বংশমর্যাদা রক্ষার ভূত তার মস্তিষ্কে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

অরু তিথির বড় বোন। পরিবারের বড় সন্তান হয়েও তেমন কোনো অবদান রাখতে পারে না কারণ তার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর সঙ্গে তার প্রায়ই ঝগড়া হয়। এর মধ্যেই তার কোল আলো করে এসেছে দুই সন্তান—সুমন আর রিমন। অরু সন্তান অন্তঃপ্রাণ। তাই স্বামীর ওপর রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেলেও সে আবার ফিরে আসে সন্তানদের জন্য। অরুর জীবনটা পাহাড়ি নদীর মতই খরস্রোতা। স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে একটা এনজিওর মাঠপর্যায়ে কাজ নেয়। এরপর সেই এনজিওর একজন বড়কর্তার সঙ্গে বিদেশে পাড়ি দেয়। এরপর আর তার কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।

হীরু বয়সে তিথির বড় হলেও তার মধ্যে বড় ভাইসুলভ কোনো ব্যাপার নেই। সংসারের আসলে হাল ধরার কথা ছিল তারই, কিন্তু সে বাতাসে গা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সে কোন কাজই করতে চায় না। কোনো কাজের কথা বললেই সে বলে ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে এইসব কাজ করতে পারব না। তাকে টাকা দিয়ে বাজারে পাঠালে নিশ্চিভাবেই টাকাটা জলে যায়। সে সেই টাকা যতদিন হাতে থাকে, ততদিন বাইরে বাইরে ঘুরে। তারপর টাকা শেষ হয়ে গেলে বাড়িতে ফিরে আসে। এরমধ্যেই সে একটা বিরাট সাহসের কাজ করে ফেলে। সেটা হলো একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম। এরপর সে সেই মেয়ের মন পাওয়াতেই পুরোপুরি মনোনিবেশ করে। সংসারের কোন কিছুতেই যেন তার কিছুই যায় আসে না। অবশ্য শেষে এসে এই উড়নচণ্ডী হীরুই উপন্যাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।  

টুকু এই অচল পরিবারের ছোট ছেলে এবং সবচেয়ে সৃষ্টিশীল মানুষ। যদিও সে সব সময়ই কোনো না কোনো একটা রোগে ভোগে। তবুও এর মধ্যেই সে লেখালেখি করে। পাড়ার দেয়াল পত্রিকা বের করতে হাত লাগায়। এমনকি তার লেখা ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হয়। তার একটি গল্প পড়ে একটা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তাকে একটা চিঠিও লিখেছিলেন। সবার ছোট বলেই তাকে যেই কাজ দেওয়া হয়, সে নিষ্ঠার সঙ্গে করে। তিথিকে বাসস্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে চিঠি পোস্ট করার মতো কাজগুলো তাকেই করতে হয়। আবার বড় বোনের জন্য তাকেই চাকরিও খুঁজতে হয়। ছোট কাঁধে সে অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

এই ভাঙাচোরা পরিবারে এক সময় বউ হয়ে আসে এ্যানা। অবশ্য এর আগে হীরুকে অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয় এ্যানার মন পাওয়ার জন্য। সে এই পরিবারে আসার পর থেকেই যেন এখানে ছন্দ ফিরে আসে। তার শ্বশুর জালালুদ্দিন এমনটাই মানেন। শ্বশুরকে সময়ে সময়ে চা করে দেয় সে। এমনকি শ্বশুরের আষাঢ়ে গল্পও তাকে মাঝে মধ্যে শুনতে হয়। এসেই সে সরাসরি শাশুড়ির হাত থেকে সংসারের কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। হীরু দোকান চালু করে। সেই দোকানে দিনে দিনে লভ্যাংশ বাড়তে থাকে। যেটা দিয়ে তিন তলা বাড়ির ভিত্তির ওপর একতলা একটা বাড়ি তৈরি করা হয়। এমনকি একটা গাড়িও কেনা হয় একসময়।

অবশেষে তিথির পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় কিন্তু তিথির কিছু একটা হয়ে যায়, যার হদিস সে পায় না। তার শুধু রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে ভাল লাগে। আর মাঝেমধ্যে হঠাৎ মেঘে মেঘে আকাশ যখন কালো হয়ে চক্রাকারে আকাশে সোনালি ডানার চিল উড়তে থাকে। তখন তার সব ছেড়েছুড়ে ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এমন একটা ঘরে যেখানে দুই বাহু বাড়িয়ে কেউ একজন অপেক্ষা করে থাকবে। তিথি সেই মানুষটাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে। লোকটি যতই রাগ করবে সে ততই মজা পাবে। কিন্তু তিথির জন্যে তেমন কেউ অপেক্ষা করে নেই, কোনোদিন করবেও না। তার জন্যে অপেক্ষা করবে বিশাল আকাশ। যে আকাশ সবার জন্যেই অপেক্ষা করে। আবার কারও জন্যই করে না।