আম–কাঁঠালের ছুটি: গ্রামীণ শৈশবের রুপালি চিত্রায়ণ

আম কাঁঠালের ছুটি
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় আট বছর পর প্রবাস থেকে ফিরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া। মনে মনে ভেবেছিলাম, হয়তোবা অনেক পরিবর্তন দেখব। দেখলামও। তবে গ্রামের শিশুদের অকৃত্রিম শৈশব কিছুটা মলিন হয়ে গেলেও এখনো অনেকখানিই টিকে আছে। জনসংখ্যার চাপে খেলার জন্য খোলা জায়গাগুলো দিনে দিনে ভরে যাচ্ছে। তবু শিশুরা রাস্তার ধারে, পুকুরপাড়ে, স্কুল মাঠে, আঙিনায় এখনো গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো ধরে রেখেছে। আর আমাদের বাচ্চা দুটোকেও গ্রামের বাচ্চাদের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলাম। যাতে করে ওদের স্মৃতিভান্ডারেও যেন কিছু অকৃত্রিমতা থাকে।

বাচ্চাদের একবার মিলিয়ে দিতে পারলেই হয়। এরপর ভাষা বা বয়স কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আমাদের ছেলেটার জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রবাসে, তাই ইংরেজিই ওর প্রাথমিক ভাষা। যদিও ও বাংলা বলে কিন্তু তার উচ্চারণও অনেকটা ইংরেজির মতোই। তাই ভাবছিলাম, আত্মীস্বজন ও প্রতিবেশীদের বাচ্চাদের সঙ্গে ও কীভাবে যোগাযোগ করবে। ওদের একসঙ্গে ছেড়ে দেওয়ার পর দেখি ওরা নিজেদের আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও করছে। সেটা দেখে আমি অবশ্য মোটেও অবাক হয়নি। কারণ, শিশুদের পৃথিবীকে দেখার একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে, যেটা পৃথিবীর সব শিশুর মধ্যেই জন্মগতভাবে থাকে।

ওরা এরপর দল বেঁধে যে কাজগুলো করল, সেগুলোতে ছিল অকৃত্রিম আনন্দের ছোঁয়া। শুরুতেই তারা আঙিনায় লুকোচুরি খেলা শুরু করল। সেটা খেলে একসময় তারা ক্লান্ত হয়ে গেল কিন্তু থামার কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখা গেল না। এরপর বিকেলে যখন তাদের নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হলাম, তারা আবারও মেতে উঠল খেলায়। রাস্তায় যেতে যেতে ছাগলের বাচ্চা দেখলেই সেগুলোকে দৌড়ে ধরে কোলে নিয়ে নিচ্ছিল। এ ছাড়া এক প্রতিবেশীর বাড়িতে বিচালির পালা দেওয়া হচ্ছিল দেখে তার মই বেয়ে পালার ওপর উঠে গেল। এরপর গড়িয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়তে লাগল যতক্ষণ না তাদের নিষেধ করা হলো। এরপর বাসার পেছনের খেতের আল দিয়ে ফেরার সময় তারা আবারও খেলায় মেতে উঠল। একটা খেতের মধ্যে একটা শিশুগাছ হেলে পড়ে কাত হয়ে ছিল। তারা সেটাকে ঘোড়া বানিয়ে সবাই মিলে চড়ে বসল।

এরপর আবার একদিন ওদের নিয়ে আমাদের গ্রামের পাশের মাঠে বেড়াতে গেলাম। মাঠে ধান কাটা, আঁটি বাঁধা, গরুর গাড়িতে তোলার কাজ চলছে। আর খেতের মধ্যে কিছু মানুষ ধান কুড়াচ্ছে। সেখানে সব বয়সের মানুষই আছে। আমি বললাম, তোমরাও ধান কুড়াতে লেগে পড়ো। শুধু বলার অপেক্ষা। তারা হইহই করে খেতে নেমে পড়ল। এটা দেখে গ্রামের মানুষেরা খুবই মজা পেয়ে গেল। একদিন সকালে তাদের নিয়ে গেলাম খেজুরের রস কিনতে। সেখানে রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানো হচ্ছিল দেখে তারা চুলাতে জ্বাল দিতে শুরু করে দিল। এরপর গাছ থেকে নামানো টাটকা রস খেয়ে তারপর বাসায় ফেরা।

গ্রামীণ শিশুদের প্রাকৃতিক সাজসজ্জা
ছবি: লেখক

বাচ্চাদের ছাড়াও আমি গ্রামে বেড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, প্রযুক্তির ধাক্কায় এখনো আমাদের শৈশবের খেলাগুলো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। একদিন দেখলাম, রাস্তার পাশের আঙিনায় কয়েকটি বাচ্চা মিলে বউচি খেলছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখে নিজেদের শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। একটু দৌড়ালেই আমি হাঁপিয়ে যেতাম, তাই আমাকে বউ বানানো হতো। যার একটাই কাজ সুযোগ বুঝে ঝেড়ে একটা দৌড় দিয়ে কোর্টে ফিরে যাওয়া। যেহেতু মাত্র একবারই দৌড় দিতে হয়, তাই আর আমি বউ হতে আপত্তি করতাম না। অবশ্য সব সময় যে সফলকাম হতাম, তা–ও ঠিক নয়। একবার প্রতিপক্ষ দলের একজনের হাতের ছোঁয়ায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে গিয়েছিল। কিছু সময়ের জন্য কান তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল।

আরেক দিন বিকেলে বেড়াতে বের হয়ে দেখি, আমাদের পাড়ার স্কুল মাঠে কিছু ছেলেমেয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে ‘ফুল টোক্কা’ খেলছে। ফুল টোক্কা খেলাটা যাঁরা খেলেছেন, তাঁরা জানেন এটা একই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক কসরতের খেলা। শুরুতে চিন্তা করে বের করতে হয়, বিপরীত দলের কে কপালে টোকা দিয়ে গেল। এরপর যত দূর সম্ভব লম্বা লাফ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এ বছর আমরা সিডনির ক্যাবেলটাউন বাংলা স্কুলে মায়েরা একদল ফুলের নাম আরেক দল ফলের নামে দুই দলে ভাগ হয়ে এই খেলাটা খেলেছিলেন। অবশ্য লাফ দেওয়ার ব্যাপারটা এড়াতে আমরা চকের দাগ দিয়ে দিয়েছিলাম। খেলাটা মায়েরা খুবই উপভোগ করেছিলেন।

গ্রামের শিশুদের খেলার প্রাকৃতিক উপাদান
ছবি: লেখক

এরপর মিছামিছি রান্নাবাটি খেলতে দেখেছিলাম আলাদা আলাদাভাবে তিনটি শিশুকে। খেলাটা আমাদের শৈশবে খুবই জনপ্রিয় ছিল। আমরা প্রথমে পুকুর বা নদী থেকে এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে হাঁড়িপাতিল বানাতাম। তারপর সেগুলো মা রান্নার শেষে মাটির চুলার আগুনের মধ্যে রেখে পুড়িয়ে দিতেন। তারপর সেগুলোতে আমরা রান্নাবাটি খেলতাম। এর রান্না খাওয়ার একটা নির্দিষ্ট ধরন আছে। নিচের ঠোঁট ভাঁজ করে চুকচুক ধরনের একটা শব্দ করতে হয়। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বাড়ি থেকে সামান্য চাল, ডাল, আলু সংগ্রহ করে আসল রান্নাও করা হতো। যেটাকে বনভোজন বা চড়ুইভাতি বলা হয়ে থাকে। সেই খাবারের স্বাদের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনো রান্নার স্বাদের তুলনা চলে না। সুদূর সিডনিতে এসেও আমরা প্রতিবেশীরা মিলে আমাদের আঙিনায় বেশ কয়েকবার এভাবে চড়ুইভাতি করেছি।

মাটির ভাঙা কলসির ছোট ছোট টুকরা দিয়ে আমরা আরেকটা খেলা খেলতাম। এই টুকরাটাকে বলা হতো ‘খাপড়া’। একটা চৌকোনা ঘর কেটে সেখানে এক পা রেখে খাপড়াটা ছুড়ে ফেলা হতো। তারপর অন্যজন তার খাপড়াটা ছুড়ে দিয়ে আগেরটার একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে ফেলতে হতো। হাতের আঙুলের প্রস্থে এই দূরত্ব মাপা হতো। তার বাইরে ফেললে পরেরজনকে টাকা পরিশোধ করতে হতো। আমরা টাকা হিসেবে ব্যবহার করতাম কাঁঠালগাছের কুড়িয়ে আনা পাতা। আবার অনেক সময় সিগারেটের খোলের দুই পাশের বেশি চওড়া অংশও ব্যবহার করা হতো। আর এই সিগারেটের প্যাকেটের অংশের দামও ছিল মার্কাভেদে আলাদা। দরকার পড়লে আমরা মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে সেগুলো বিনিময় করে নিতাম।

গ্রামের শিশুরা এখনো ডাংগুলি খেলে
ছবি: লেখক

এ ছাড়া পাটের মৌসুমে পাঠকাঠি দিয়ে গাড়ি বানিয়ে আমরা চালিয়ে বেড়াতাম রাস্তাময়। আবার কখনোবা সাইকেল, রিকশার পুরোনো টায়ার জোগাড় করে গাছের ছোট ডাল দিয়ে চাকার মতো করে ঘুরিয়ে বেড়াতাম। আর পাটকাঠির মাথায় জিগাগাছের তরল আঠা লাগিয়ে সেটা দিয়ে ধরা হতো ফড়িং। তারপর ফড়িংয়ের লেজে সুতা বেঁধে সেগুলো লালন–পালন করা হতো। বছরের একটা সময় আমরা সরু বাঁশ দিয়ে একধরনের বন্দুক বানাতাম। বাঁশের দুটি গিঁটের মধ্যকার অংশটুকুকে বানানো হতো বন্দুকের নল। আরেকটা অংশের প্রায় পুরোটা ফেলে দিতে গুঁতা দেওয়ার জন্য বানানো হতো বন্দুকের চাবি। আর গুলি হিসেবে ব্যবহার করা হতো ‘পেফল্টি’গাছের ফল। প্রথমে একটা ফল বাঁশের নলের মধ্যে আস্তে ঠেলে ঢোকানো হতো। পরের ফলটা ঢোকানো হতো গায়ের জোরে। এতে করে আগের ফলটা বাঁশের নলের ভেতরের বাতাসের চাপে গুলির বেগে বেরিয়ে আসত। এই খেলার বিপদ ছিল ফলটার রস। রস কোনোভাবে চোখে ঢুকে পড়লে সারা দিন চোখ জ্বালা করত।

গ্রামের কুসংস্কারগুলোও ছিল আমাদের জন্য বাড়তি আনন্দের উপকরণ। গিরগিটিকে আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘কাঁকলাস’। এটা দেখলেই আমরা বুকে একদল থুতু দিতাম। কারণ, তা না হলে সেটা আমাদের সব রক্ত শুষে নেবে। এমনটাই ছিল আমাদের ধারণা। আরেকটা বিশ্বাস ছিল যে শেওড়াগাছে ভূত বাস করে। তাই আমরা দিনে বা রাতে কোনো সময়ই শেওড়াগাছের কাছে যেতে চাইতাম না। আমাদের বাসার ঠিক পেছনের সালামদের বাঁশঝাড়ের ভেতরে একটা তালগাছ ছিল। সেই তালগাছে বাস করা ভূত আমাদের গ্রামের অনেকের ঘাড়েই ভর করেছিল। আমরা তাই সে তালগাছের তলায় কোনোক্রমেই যেতে চাইতাম না। এ ছাড়া আমাদের দুপুরবেলা গাছে চড়া থেকে নিরস্ত করতে মায়েরা বলতেন, দুপুরবেলায় গাছে উঠলে ভূতে কিন্তু ঠেলা দিয়ে ফেলে দেবে। কাউকে সেই সময় গাছে চড়তে দেখলে আমরা ছড়া কেটে বলতাম—
‘দুইপারকার বেলা
ভূতে মারে ঠেলা।’

গ্রামের শিশুরা এখনো ফুল টোক্কা খেলে
ছবি: লেখক

আমাদের ঘরে বেঁধে রাখাটাই ছিল আমাদের মায়েদের জন্য একটা বিশাল ঝক্কি। আমরা চাইতাম সারাক্ষণ পাড়ার সব ছেলেমেয়ে মিলে খেলে বেড়াতে। যখন কোনো ভয়ই আমাদের নিরস্ত্র করতে পারত না, তখন অবধারিতভাবেই আমাদের কপালে জুটত বকুনি। তবু আমরা কখনোই পিছপা হতাম না। কারণ, বকুনির দুঃখের চেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার আনন্দ ছিল অনেক বেশি। স্কুলের সময়টায় খেলাধুলাটা হতো স্কুলের পর। কিন্তু ছুটির সময়টা ছিল একেবারে অবিরামভাবে খেলে যাওয়ার। তাই আমরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম কখন ‘গরমের ছুটি’ যেটার আরেক নাম ছিল ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’ হবে। কারণ, সে সময় আম–কাঁঠাল পাকে। অনেক সময় এই ছুটিতে মা নানিবাড়িতে নায়রে যেতেন। কিন্তু স্থান ও সঙ্গী বদল হলেও আমাদের খেলা চলত অবিরাম।

গ্রামের শিশুরা এখনো মিছামিছি রান্নাবাটি খেলে
ছবি: লেখক

মোহাম্মদ নূরুজ্জামানের রচনা ও পরিচালনায় ‘আম–কাঁঠালের ছুটি’ ছবিটা দেখতে গিয়ে মনের পর্দায় আমাদের শৈশবের দিনগুলো যেন ভেসে উঠল। আর আমি সময়–সময় আমার পাশে বসা আমাদের দুই ছেলে–মেয়েকে ব্যাখ্যা করছিলাম চলচ্চিত্রটার কোন দৃশ্যের মানে কী? অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ বঙ্গজ ফিল্মস এবং এর স্বত্বাধিকারী তানিম ভাইকে বাংলাদেশ থেকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর এই পারে বাংলাদেশের শৈশবের দৃশ্যায়ন দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তবে দর্শকসারি ভর্তি থাকলে আরও বেশি ভালো লাগত। আমরা বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে সমালোচনা করি কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে চাই না। অবশ্য ইদানীং এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আমি আশা করি, এভাবে চলতে থাকলে একদিন বাংলা চলচ্চিত্র বিশ্বের দরবারে মর্যাদার সঙ্গে স্থান করে নেবে।