ভয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

যদি বলি জীবন হচ্ছে স্মৃতি ও কল্পনা, তাহলে অনেকে কিছুক্ষণের জন্য ঘাবড়ে যাবেন। কারণ, জীবন সম্পর্কে নানাজন নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আমি আমার স্মৃতি ও কল্পনার ধারণক্ষমতাকে জীবন বলে মনে করি। জীবনের সব ঘটে যাওয়া ঘটনা হয় স্মৃতি, আর যা ঘটেনি কিন্তু ঘটবে বা ঘটতে পারে, যাকে বলি কল্পনা—এ দুটির সমন্বয় হলো জীবন। অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মৃতি হয়ে, জমা হয়ে কল্পনায় ভয়াবহ যেসব ঘটনা আগেভাগে ঘটায়, সেসব ঘটনাগুলো সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনায় ভরা থাকে। ভয় ঠিক তেমন একটি ঘটনা, যা মনের মধ্যে কল্পনার রাজ্যে (জীবনে) বসবাস করে। যার ফলে আমরা সব সময় কিন্তু ভয়ের মধ্যে বাস করছি, যা সব সময় বাস্তব নয়। ভয় যে শুধু কল্পনায় বাস করছে, তা–ও নয়; ভয় আমাদের মনে সারাক্ষণ বাস করছে।

আমাদের ভয় সব সময় পরবর্তী সময়ে কী হবে, তা নিয়ে। এর মানে হলো যে আমাদের ভয় সব সময় সেখানেও যেখানে ভয় নেই, তা নিয়েও। আমাদের ভয় যদি অস্তিত্বহীন সম্পর্কে হয়, তবে আমাদের ভয় এক শ ভাগ কাল্পনিক। এখন প্রশ্ন, আমরা কেন ভয় পাই এবং কী কারণ রয়েছে এর পেছনে? ভয়কে জয় করার কি কোনো উপায় আছে?
আমরা সব সময় কষ্ট পাই অতীতে যা ঘটেছে বা আগামীকাল যা ঘটতে পারে, সেটা নিয়ে। আমাদের কষ্ট সব সময় যা নেই, তা নিয়ে। কারণ, আমরা বাস্তবে নিহিত নই, আমরা সব সময় আমাদের মনের মধ্যে প্রোথিত থাকি।

আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে স্মৃতি ও কল্পনা। দুটোই একরকম ফ্যান্টাসি। কারণ, দুটোই এখন নেই।

আমি আমার কল্পনায় হারিয়ে গেছি, এটাই আমার ভয়ের ভিত্তি। আমি যদি বাস্তবে বদ্ধ হতাম, তবে আমার ভয় থাকত না। ভয় আমার চারপাশে সীমানা তৈরি করে রাখে না, ভয়ের কারণে আমি নিজেই সব সময় সীমানা তৈরি করি। আমি যদি সীমানা নির্ধারণ করি এবং আমার জীবনের ক্ষেত্র সীমিত করি, তবে আমি নিরাপদ থাকতে পারি। আমি জীবন থেকে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত, যা একটি বাস্তব সুরক্ষা!

এখন আমি কি এখানে জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এসেছি, নাকি জীবনকে এড়াতে এসেছি, তা আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি যদি জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এসে থাকি, তবে একটি জিনিস যা প্রয়োজন, তা হলো তীব্রতা। যদি আমার তীব্রতা না থাকে, তবে আমি একটি চর্বিহীন জীবন অনুভব করব। যে মুহূর্তে আমি নিজেকে রক্ষা করার জন্য ভয়কে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করব, তখনই আমার তীব্রতা কমে যাবে। একবার এটি নেমে গেলে, আমার জীবন অনুভব করার ক্ষমতা চলে যাবে। আমি একটি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে পরিণত হব। আমার মনে যা ঘটবে, তা–ই হবে। আমি কখনোই আশ্চর্যজনক এবং আনন্দদায়ক কিছু অনুভব করব না। কারণ, আমি যখন ভয় পাই, তখন আমার পরিত্যাগের অনুভূতি থাকে না। আমি গান গাইতে পারি না, নাচতে পারি না, হাসতে পারি না, কাঁদতে পারি না, এমন কিছু করতে পারি না যা জীবন।

আমি যদি ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ করি, তাহলে ভয় কী? যা ঘটেছে তা নিয়ে আমার ভয় কখনোই নয়, কী হতে পারে সেটা নিয়ে ভয়, যা ভবিষ্যতের কথা। ভবিষ্যতে ঘটতে পারে যা এখনো ঘটেনি, মানে এর অস্তিত্ব নেই। তাই ভয় পাওয়ার মানে যা নেই তাতে ভোগা। আমার এই ভোগার কারণকে বিবেকবান ব্যক্তি পাগলামি বলবে। আমরা যখন অস্তিত্বহীনতায় ভুগি, তখন তাকে বলি পাগলামি। সুতরাং আমরা কেবল সামাজিকভাবে গৃহীত উন্মাদনার স্তরে থাকতে পারি। আমরা যদি ভয় পাই বা আমি এমন কিছুতে ভুগছি যার অস্তিত্ব নেই, সেটা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়।

ভয় জীবনের পণ্য নয়। ভয় একটি হ্যালুসিনেটারি মনের একটি পণ্য। আমি কিছুতে ভুগছি যার অস্তিত্ব নেই। কারণ, আমি বাস্তবে প্রোথিত নই কিন্তু সেটা আমার মনের মধ্যে আছে, যা ক্রমাগত অতীতকে খেয়ে ফেলে এবং ভবিষ্যতের উদ্রেক করে। আমি আসলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি কেবল অতীতের একটি অংশ নিয়ে তৈরি করি এবং ভাবি ভবিষ্যৎকে।

ভয়কে ঘিরে দেয়াল তৈরি না করে বরং হেয়ার অ্যান্ড নাও কনসেপ্টের ওপর বিশ্বাস করে বাঁচতে শিখি, তারপর যা হওয়ার সেটা হবে। আমি না চাইলেও যা হওয়ার তা–ই হবে, হোক না, তাতে ক্ষতি কী? আমি মারা যাব, আর কিছু নয়, অন্তত মরার আগে বাঁচি। কারণ, যেভাবেই হোক আমি মরব, মরতে তো একদিন হবেই।