দেশে প্রবাসে অমর একুশ

কানাডার মন্ট্রিলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার অন্যতম উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আমি, তাঁর কোলে আমার বড় মেয়ে শ্রাবণ
ছবি: সংগৃহীত

আমার বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকার, বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার, তাদের জীবনপ্রণালি জানার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার বাবার বাগান করার প্রতি বিশেষ করে ফুলের বাগান করার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ। সেই কারণেই হয়তো বাংলাদেশের যেখানে গিয়েই আমরা থেকেছি তিনি আমাদের বাসার আঙিনায় একটা সুন্দর ফুলের বাগান গড়ে তুলতেন। কত ধরনের ফুল যে সে বাগানে ছিল, গোলাপ, টগর, জুঁই, চামেলি, বেলি, জবা, গন্ধরাজ আরও কত কী! বাগানের মালিদের সঙ্গে বাবা নিজেও ফুলের বাগানে কাজ কাজ করতেন। সারা বছরের পরিচর্চার পর ফুলের বাগান ফাল্গুনে এসে পরিপূর্ণতা লাভ করত। ফুলের বাগান যখন ভরাট, রূপে–সৌন্দর্যে যখন অপরূপ, সেই ফাল্গুনের কাকডাকা এক ভোরে উঠে দেখি বাগানে কোনো ফুল নেই! খুব ছোট্টবেলায় এই দৃশ্য দেখে আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। বাবা বুকের কাছে টেনে হাসতে হাসতে বললেন, ‘কেঁদো না আজ একুশে ফেব্রুয়ারী, এই ফুলগুলো ভাষাশহীদদের উদ্দেশ্যে স্কুলের ছেলেমেয়েরা নিয়ে গেছে। আমাদের বাগানের ফুলগুলো ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য উৎসর্গ করা হচ্ছে, এটা তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার’।

শৈশবে এভাবেই একুশের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তারপর প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রজীবনের যেকোনো ধাপেই একুশকে বরণ করেছি বুকের ভেতর থেকে। যে ঘটনার সঙ্গে, যে আত্মত্যাগের সঙ্গে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব গভীরভাবে জড়িত, তাকে উদ্‌যাপন করেছি শ্রদ্ধা, গাম্ভীর্য কিন্তু উৎসবের আমেজে। ঢাকার বাইরে মফস্‌সল শহরে যখন থাকতাম, তখন খুব ভোরে ফুল সংগ্রহ করে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর সেই বিখ্যাত একুশের গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গেয়ে গেয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতাম। দিবসটি উপলক্ষে আমাদের স্কুলে দিনব্যাপী চলত আলোচনা সভা, বিতর্ক, গান, কবিতা, নাচ, নাটক নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের যেখানেই থেকেছি, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একই দৃশ্য, একই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।

অমর একুশকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি যেন নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আরও নব উদ্যমে আলিঙ্গন করেছে! এসব দেখে একটা বিষয় বুঝতে পেরেছিলাম, বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার এই আন্দোলনে দেশের সব এলাকার মানুষ সমস্বরে সোচ্চার।
একসময় ছোট্ট বিদ্যালয়ের আঙিনা ছেড়ে মহাবিদ্যালয় অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় আসা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে যখন আসলাম, দেখলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটি তেমন বড় কিছু না। কিন্তু তাতে দুঃখ নেই। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সব ছাত্র সংগঠন মিলে বুয়েটের সেই ছোট্ট শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে পুষ্প অর্পণ করে দল বেঁধে আমরা ছুটতাম ঢাকা মেডিকেল কলেজসংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিশাল জনসমুদ্রের সঙ্গে আরেক দফা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। আশির দশকের সেই সময়টা এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের সময়। দেশের প্রধান দুই বিরোধীদলীয় নেতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তখন তুমুল রূপ ধারণ করেছে। শহীদ মিনার তখন ছিল সব স্বৈরাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ফেব্রুয়ারিজুড়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চলত নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।  উত্তরে শাহবাগ রোড, দক্ষিণে জাহির রায়হান রোড, পশ্চিমে কাঁটাবন সড়ক, আগে শাহবাগের মোড় থেকে দোয়েল চত্বর, কার্জন হল হয়ে চানখাঁরপুলের মোড়, এই এলাকাটিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ অবস্থিত। এ ছাড়া আশপাশেই রয়েছে দেশের বেশ কিছু নামকরা বিদ্যালয় ও কলেজ। এটা এমন একটি এলাকা যেখান থেকে একুশের ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রাম, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সব সময় এই এলাকা ছিল অগ্রণী ভূমিকায়। নিজেকে এই ভেবে খুব সৌভাগ্যবান মনে করতাম যে ছাত্রজীবনে এমন একটি এলাকায় আমার পদচারণ ছিল!

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বাঙালিদের তৈরি অস্থায়ী শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে
ছবি: সংগৃহীত

একসময় ছাত্রজীবন যখন শেষ হলো, কেমন যেন এক শূন্যতায় গ্রাস করল মন! স্বৈরাচারবিরোধী মিছিল আর করতে পারব না? বন্ধুদের সঙ্গে মিছিলে মিটিংয়ে আড্ডা আর হইচইয়ের কী হবে? কিন্তু জীবনের গতিপথের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকলাম। আবার একুশ এল। এবার মিছিল বাদ দিয়ে ঢাকার সেই মোহাম্মদপুরের আবাসস্থল থেকে রিকশায় করে, পায়ে হেঁটে একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে ফুল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজীর হয়েছি। ছাত্রজীবনের মতো একুশের প্রথম প্রহরে মিছিল করে শহীদ মিনারে না–ইবা যেতে পারলাম, তাই বলে কি শহীদদের প্রতি ভালোবাসার নিবেদন বন্ধ থাকবে? একসময় সংসার হলো, ঘরে সন্তান এল তখন স্ত্রী সন্তানকে সঙ্গে করেই একুশের সকালে অপেক্ষাকৃত শান্ত সময়ে শহীদ মিনারে এসেছি ফুল হাতে নিয়ে। একুশের এই ভালোবাসা এক জেনারেশনের নয়, এটা বংশপরম্পরায় হাজার বছর ধরে যে চলবে!

একসময় জীবনের টানে দেশ থেকে মহাদেশ, মহাসিন্ধু পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর অপর প্রান্তে এলাম। উত্তর আমেরিকায় বসবাসের শুরুর দিকে কয়েক বছর কানাডায় আমাদের জীবন কেটেছিল। মন্ট্রিলে ফেব্রুয়ারি মাসে রাস্তাঘাট তখনো তুষারাবৃত। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মন্ট্রিলের বাঙালিদের মন আনচান করা শুরু করত। লাল রক্তের রঙে সাজানো পলাশ শিমুল নেই তো কী হয়েছে? আমার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন তো করতে হবে!  এরই মধ্যে প্রচন্ড ঠান্ডায় বরফ ভেঙে আমরা মন্ট্রিলের বাঙালিরা অমর একুশে উদ্‌যাপন করতাম। বিশাল হলরুমে শহীদ মিনার বানিয়ে দোকান থেকে ফুল সংগ্রহ করে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতাম। অমর একুশের বীরদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি, সময়ের দূরত্বে তা সম্ভব ছিল না, কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে আরেকজন সমকালীন প্রবাদপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। ইনি হচ্ছেন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেসকো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার অন্যতম উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম ভাই। অমর একুশে উপলক্ষে রফিক ভাই সস্ত্রীক এসেছেন সুদূর ভ্যাঙ্কুভার থেকে। ১৯৯৮ সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে ‘The Mother Language Lovers Of The World’–এর সভাপতি রফিকুল ইসলাম এবং তারই আরেক সহযোদ্ধা আব্দুস সালাম জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে যোগাযোগ করে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁদের সেই উদ্যোগের কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। রফিক ভাইকে কাছে পেয়ে কী যে ভালো লাগছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না!

রফিক ভাই আমাদের সঙ্গে চিরাচরিত প্রথায় প্রভাতফেরি, শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোসহ একুশের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেন। স্টেজে উঠে ওনার বক্তৃতায় তুলে ধরলেন অমর একুশের গুরুত্ব, তুলে ধরলেন কীভাবে এ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায় বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত কীভাবে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সহযোগিতায় সেটা সম্ভব হয়েছে। অনুষ্ঠানের কোনো এক ফাঁকে রফিক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। অসাধারণ অমায়িক এক মানুষ! বোঝালেন, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি যেন বৃহত্তর এবং প্রভাবশালী জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির দৌরাত্ম্যে হারিয়ে না যায়, সেই ব্যাপারে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। কোনো ছোট জাতিগোষ্ঠীর যেন বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর ভাষার প্রভাবে হারিয়ে না যায়। সেই প্রাসঙ্গিকতা একুশে ফেব্রুয়ারিতে নিজের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন উৎসর্গ পৃথিবীতে এক অনন্য উদাহরণ। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই তিনি, সালাম ভাই একুশেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আবেদনের সুরে বললেন, ‘ভাই, নিজের মাতৃভাষাকে পরম ভালোবাসায় লালন করুন, বংশপরম্পরায় ধরে রাখুন, দেশ থেকে বহু দূরে উত্তর আমেরিকায় আমাদের জন্য এটা আরও বেশি জরুরি।’

কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার পর এখানেও অনেক বছর আমরা অমর একুশে উদ্‌যাপন করেছি। মাঝে মাঝে যখন রফিক ভাইয়ের সঙ্গে মন্ট্রিলে কথোপকথনের সেই সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়ত, তখন অনুপ্রাণিত বোধ করতাম। ২০১৩ সালের কোনো একদিন বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদ পোর্টালে পড়লাম সেই কালজয়ী প্রবাদপুরুষ রফিক ভাই আর নেই! সেই দিনটি আমার খুব খারাপ গিয়েছিল! আল্লাহ যেন এই মহান পুরুষকে বেহেশত নসিব করেন।