
বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির আকাশে উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হয়ে এবার জ্বলে উঠেছিল মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলার রজতজয়ন্তী উৎসব। একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার। এই অহংকারের গর্বিত অংশীদার হয়ে দূর দুরান্ত থেকে এবারের নিউইয়র্ক বইমেলা ও বাংলা উৎসবে বাংলা ভাষাভাষী সর্বস্তরের মানুষ যোগদান করে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বে। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক এই বাংলা উৎসব ও বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ২০, ২১ ও ২২ মে জ্যাকসন হাইটসের পিএস ৬৯ মিলনায়তনে।
নিউইয়র্কে বইমেলার রজতজয়ন্তীতে বাংলাদেশ, ভারত, লন্ডন, জার্মানি, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের অংশগ্রহণ ও আড্ডাবাজিতে জ্যাকসন হাইটস জমে উঠেছিল। কাউকে বলতে হয়নি এই বইমেলার কথা। এই মেলার জন্য নিউইয়র্কসহ উত্তর আমেরিকার বই পিপাসুরা সারা বছর অপেক্ষা করেন। যখনই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় তারা সদলবলে যোগ দেন। রঙিন শাড়িতে বই পেঁচিয়ে বাড়ি ফেরেন। সঙ্গে বাড়তি আয়োজন থাকে লেখকদের অটোগ্রাফ নেওয়ার। কাউকে ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করতে হয় না। নিজের কাছেই ফোন, ধমাধাম সেলফি, সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকে। অংশগ্রহণ, আনন্দ ও শেয়ার সবই যেন একই সঙ্গে। এই বইমেলা ও বাংলা উৎসব শুধু বইমেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলা ভাষা, বাংলা বই, বাংলা সংস্কৃতিসহ পুরো বাংলাদেশই যেন উঠে এসেছে। মেলায় বাংলা ভাষার, বাংলা সংস্কৃতি ও বিশ্ব বাঙালির জয়গান যেমন হয়েছে তেমনিভাবে পুরো বাংলাদেশ উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের সাহিত্যের একাল-সেকাল নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে। আবার তার সমালোচনাও করা হয়েছে। বিভিন্ন সেমিনারে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে গণতন্ত্র ও শক্তিশালী বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যা, সংখ্যালঘুদের দেশ থেকে বিতাড়ন, মুক্তমনা ব্লগার হত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনার কথাও বলা হয়েছে। বইমেলায় বই নিয়ে আলোচনার চেয়ে রাজনীতি হয়েছে বেশি। সবকিছুতেই যেন রাজনীতি টেনে আনা। সেলিনা হোসেনের কথা অনুযায়ী সময় যদি লেখকদের ধরে রাখতে হয়, রাজনীতিও লেখার উপজীব্য হয়ে যায়।

বইমেলায় সম্মাননা জানানো হয়েছে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে। প্রথমবারের মতো ঘোষিত চ্যানেল আই ও মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সম্মাননা জানানো হয়েছে সহযোদ্ধা ড. ডেভিড নেলিনকে। তিন দিনের ঠাসা অনুষ্ঠানে সময়ের অভাবে কোনো আলোচনাই উপসংহারে পৌঁছাতে পারেনি। সময় মতো শেষ করার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি ছাড়াও অন্যান্য অতিথিরা কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। যেমন স্বরচিত কবিতা পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, বই নিয়ে আলোচনা, নতুন লেখক—সবই যেন এক। ভিন্নতা চিন্তা করা যেতে পারে।
শোভাযাত্রা এবং বইমেলা ও বাংলা উৎসবে মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তৃতীয় দিনে পড়ন্ত বিকেলে যেন মেলায় মানুষের ঢল নেমেছিল। মেলায় যেন হাঁটাই যাচ্ছিল না, কী মূল মঞ্চে, কী ছোট মঞ্চে, কী মেলায়। সেদিক থেকে আয়োজকেরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেই পারেন। ধন্যবাদ পেতেই পারেন আহ্বায়ক হাসান ফেরদৌস।
ফিতা কেটে ও ২৫টি বেলুন উড়িয়ে বইমেলা ও আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবের উদ্বোধন করে প্রধান অতিথি ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন। ২৫ বছর পূর্তিতে ২৫টি মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে মেলার শুভ সূচনা করা হয়। মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন করেন সেলিনা হোসেন, লেখক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা রামেন্দু মজুমদার, লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. নূরন নবী, লেখক অর্ভিন ঘোষ, বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যকার জামাল উদ্দিন হোসেন, সময় প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী ফরিদ আহমেদ, কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজকালের সত্যম রায় চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুস সেলিম, লেখক মোহিত কামাল, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার, লেখিকা গুলতেনিক খান, আমীরুল ইসলাম, লেখক ফেরদৌস সাজেদীন, কবি ইকবাল হাসান, কিশোর ভারতী সম্পাদক ও পত্র ভারতীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ত্রিদিব কুমার চ্যাটার্জি, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি আলমগীর শিকদার, মো. মনিরুল হক, তাহমিনা জামান, মুস্তফা চৌধুরী, মাহফুজুল বারী, সৈয়দ আল ফারুক ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কমলিনী মুখোপাধ্যায়। যে ২৫ জন লেখক, কবি ও ঔপন্যাসিক মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বইমেলার উদ্বোধন করেন তাদের সবাইকে উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, বইমেলা আমাদের গৌরবের। এই মেলা আমাদের ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। এই বইমেলা গত ২৫ বছর ধরে নিউইয়র্কে হচ্ছে। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। সেই স্বাধীনতা লাভের কারণেই আজকে নিউইয়র্কের বইমেলায় যোগ দিতে পেরেছি। তিনি বলেন, বইমেলা ও বাঙালির সংস্কৃতিই হচ্ছে আমাদের শক্তির আসল জায়গা। বাঙালির জয় হোক, বাংলা ভাষার জয় হোক, বাংলা সংস্কৃতির জয় হোক, সর্বোপরি বাংলাদেশের জয় হোক। বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির জয়ধ্বনি সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ুক।
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এই সুন্দর একটি আয়োজনের জন্য বিশ্বজিৎ সাহা ও মুক্তধারাকে ধন্যবাদ। তিনি বলেন, আজ থেকে এক সপ্তাহ আগেও আমি জানতাম না, আমাকে আসতে হবে। বিশ্বজিৎ সাহা ফোন করে অনুরোধ করলেন এবং আমার প্রকাশক ত্রিদিব কুমার চ্যাটার্জির কারণেই এখানে আসা। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশে যাই। বাংলা ভাষার চর্চা বাংলাদেশে যেভাবে হচ্ছে আমি তা দেখে গর্ববোধ করি। আজকে এখানে এসে আমি আনন্দিত। আমার অহংকার হচ্ছে বাংলাদেশে বাঙালিরা এটা করছে। বিদেশে বাংলা ভাষার বীজ রোপিত হচ্ছে। বিশ্বে বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি হবে এই ধরনের আন্দোলন অব্যাহত থাকলে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কারণেই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন। তিনি ১০ বছর পদ্মার পাড়ে না থাকলে রবীন্দ্রনাথ হতেন না।

রোকেয়া হায়দার বলেন, দেখতে দেখতে ২৫ বছর চলে গেল। আমার এক সময়ের সহকর্মী লেখিকা দিলারা হাশেম আমাকে বলতেন, যাবেন নাকি নিউইয়র্কের বইমেলায়। আমি তাকে বলতাম যেখানে বাংলা ভাষার জয়গান হবে, বাংলাদেশের জয়গান হবে, বাংলা সংস্কৃতির জয়গান হবে সেখানে আমি কী না গিয়ে পারি।
তাসমিমা হোসেন বলেন, এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ, কলকাতা ও নিউইয়র্কসহ অন্যান্য দেশে বসবাসকারী বাংলা ভাষার কবি, লেখক ও সাহিত্যিকেরা এসেছেন। এটা আমার কাছে আনন্দের। আমি ভেবেছিলাম নিউইয়র্কে শীত কাঁপব, কিন্তু এখন দেখছি সম্মিলিত উচ্ছ্বাসে রক্তের শিহরণ। বইমেলা ও শোভাযাত্রা হচ্ছে বাঙালির ঐক্যের প্রতীক। আমার কাছে ভালো লাগছে এই প্রবাসেও বাংলা বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জয়ধ্বনি করছেন।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, বড় কাজ একজনই শুরু করেন। বাংলাদেশে বইমেলা শুরু করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা আর নিউইয়র্কে শুরু করেছেন আমেরিকার মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা। তিনি আরও বলেন, বইমেলা হচ্ছে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। আমাদের দেশে দারিদ্র্য আছে কিন্তু আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হচ্ছে ঐতিহ্যের। এই ঐতিহ্য নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি।
অর্ভিন ঘোষ বলেন, সারা বছর আমরা এই বইমেলার অপেক্ষায় থাকি।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান বলেন, বইমেলা হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যের মেলা। আমাদের অনেক ঐতিহ্য আছে। সেই সব ঐতিহ্য নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি।
ইকবাল হাসান বইমেলা ও বাংলা উৎসবের সাফল্য কামনা করেন।
আলমগীর শিকদার বলেন, বাংলাদেশ থেকেই আমরা শুনতাম নিউইয়র্কের বইমেলার কথা। এবার এসে দেখলাম। বিশ্বজিৎ সাহা ও মুক্তধারা ফাউন্ডেশন বাংলা ভাষা চর্চা ও বিস্তারে যে ভূমিকা পালন করছে তা সত্যিই অবিস্মরণীয়।
গুলতেনিক খান বলেন, আমার কাছে খুব ভালো লাগছে। প্রবাসে যেন এই ধারা অব্যাহত থাকে।
আব্দুস সেলিম বলেন, এই ধরনের সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন আয়োজন দেখে আমি অভিভূত। এত সুন্দর আয়োজন এর আগে আমি আর দেখিনি, এই আয়োজনে আসতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমি মনে করি এই ধরনের আয়োজন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে।
আনিসুল হক বলেন, আমাকে নিউইয়র্কের বইমেলায় দাওয়াত দিতে হয় না, আমি নিজের উদ্যোগেই চলে আসি। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আমাকে দাওয়াত দেয়নি, ডাকলে ভিজিট দিতে হয়। আমি ডাক্তার নই, আমি প্রাণের টানে চলে এসেছি।

লুৎফর রহমান রিটন বলেন, বইমেলা আমার জীবনের সঙ্গে জড়িত। যেখানেই বইমেলা হয় সেখানেই আমি চলে যাই। আমার আগ্রহের কেন্দ্র হচ্ছে একুশের বইমেলা, তার সম্প্রসারণ হচ্ছে নিউইয়র্ক বইমেলা।
নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিওর পক্ষে শুভেচ্ছা জানান তাঁর প্রতিনিধি নিক গোলাটা। তিনি বলেন, নিউইয়র্ক সিটি বাংলাদেশি কমিউনিটির সংখ্যা বাড়ছে। তারা নিউইয়র্ক সিটির উন্নয়নে সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। যে কারণে সিটি মেয়র বাংলাদেশিদের সঙ্গে রয়েছেন। পরে নিক গোলাটা সিটি মেয়রের পক্ষ থেকে বইমেলা ও আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব উপলক্ষে একটি সাইটেশন মেলার আহ্বায়ক হাসান ফেরদৌসের কাছে হস্তান্তর করেন। যাতে ২০ মেকে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা ডে হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বইমেলার আহ্বায়ক হাসান ফেরদৌসের পরিচালনায় এবারের বইমেলা ও বাংলা উৎসবে একাত্তরের সহমুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু আলবেনি মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. ডেভিড নেলিনকে তার অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। তাকে সম্মাননা জানান ও উত্তরীয় পরিয়ে দেন তাসমিমা হোসেন ও রামেন্দু মজুমদার।
ডেভিড নেলিন সালাম দিয়ে বাংলায় তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি শুরুতেই কৃতজ্ঞতা জানান বাংলাদেশিদের একদিন পর্যন্ত তাদের স্মরণ রাখার জন্য। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, কীভাবে বাল্টিমোরে যুদ্ধজাহাজ না যাওয়ার জন্য তারা আন্দোলন করেছিলেন, কীভাবে হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ করেছিলেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। তার প্রতিবাদ করেছি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন সিনেটর কেনেডিসহ আরও বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা। আমাদের পুরোপুরি সাহায্য করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট। তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য তিনি সকল বাংলাদেশিদের ধন্যবাদ জানান।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতি ধন্য এই মার্কিন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সে বছর জুলাই মাসে মেরিল্যান্ডের বালটিমোরে পাকিস্তানি অস্ত্রবাহী জাহাজ পদ্মা বন্দরে প্রবেশ করার বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভে অংশ নেন ড. নেইলিন তাদের অন্যতম ছিলেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকার কলেরা হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায়, তরুণ চিকিৎসক নেইলিন কলেরার প্রতিষেধক হিসেবে ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি আবিষ্কার করেন।
উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়ার পর তাসমিমা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের অসহায় মানুষকে সাহায্য করার জন্য ড. ডেভিড নেলিনকে ধন্যবাদ জানান।
হাসান ফেরদৌস মেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এই বইমেলা নিয়ে ষড়যন্ত্র কম হয়নি। কিন্তু যারা বইমেলার সঙ্গে নিঃশর্তভাবে ছিলেন তারাই এটাকে সফল করেছেন এবং আজকের এই পর্যায়ে আপনারাই নিয়ে এসেছেন।
যদি তোর গান শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন শফি চৌধুরী, দিঠি হাসনাত, সাবরিনা রহমান, তাসনিম আহমেদ, গুঞ্জরী সাহা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান জাগরণে ছিল চন্দ্রা ব্যানার্জির পরিচালনায় অনিন্দ্য সুন্দর ও চোখ ধাঁধানো নৃত্যাঞ্জলি। অংশগ্রহণ করে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে নুহা কাওসার, লিওনা মুহিত, সারেঙ্গি রোমান মিশ্র। গানে প্রিয়া সাহা ও নৃত্যে দেবলীনা চন্দ। নবীন শিল্পদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন গুলতেকিন খান।
মুক্তধারা ২৫ বছর: ফিরে অনুষ্ঠানে আনিসুল হক বলেন, এই বিজন দেশে মুক্তধারা গত ২৫ বছর ধরে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির জন্য কাজ করছে। এটা একেবারেই সহজ বিষয় নয়, বিশাল ব্যাপার। এটাকে আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। এই বইমেলা একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। তাই আমি এই বইমেলাকে পছন্দ করি। তিনি বলেন, লাল সবুজ আমাদের প্রতীক, বইও আমাদের প্রতীক।
নুরুন নবীও বইমেলার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ও বইমেলার আয়োজকদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করে সাংবাদিক নিনি ওয়াহিদ। এ পর্বে হাসান ফেরদৌস মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহাকে মঞ্চে আহ্বান করেন। আনিসুল হক ও নুরুন নবী তাকে সম্মানসূচক উত্তরীয় পরিয়ে দেন। উত্তরে বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, এটা প্রবাসী বাঙালি, বাংলা মিডিয়া ও লেখালেখির মানুষগুলোর নিঃশর্ত ভালোবাসার ফসল।
প্রথম দিনের শেষ পরিবেশনায় ছিলেন সংগীত শিল্পী ফেরদৌস আরা। তাঁকে মঞ্চে আহ্বান করেন রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। তিনি শিল্পীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। শিল্পী তার সংগীত পরিবেশনের আগে বলেন, আপনারা দেশকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আপনাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। আমরা যারা দেশে থাকি তারাও দেশকে ভালোবাসি কিন্তু আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখাতে পারি না। এরপর তিনি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তার জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করেন। মানুষও প্রাণ ভরে তার সংগীত উপভোগ করেন।
এ ছাড়া প্রথম দিন অনুষ্ঠিত হয় শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রা জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার সিটি প্লাজা থেকে শুরু হয়ে ৬৯ স্কুলের অডিটোরিয়ামে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় বক্তব্য রাখেন সেলিনা হোসেন, তাসমিমা হোসেন, গুলতেকিন খান, নিক গোলাটা, কমলিনী মুখার্জি, জামাল উদ্দিন হোসেন, নাজমুন নেসা পেয়ারি, আব্দুস সেলিম, আনিসুল হক, লুৎফর রহমান রিটন, নূরন নবী, গাজী মাজহারুল ইসলাম, ইকবাল হাসান, সালমা বানী, জেবিবিএর সাধারণ সম্পাদক তারেক হাসান খান ও সউদ চৌধুরী প্রমুখ। শোভাযাত্রার অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন হাফিজ ইয়াক্তি। শোভাযাত্রায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলার ঐতিহ্য সাজ ও মুখ, মুখোশ ও ঢোল নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রা যখন জ্যাকসন হাইটসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে তখন দুই পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ অভিনন্দন জানান। অন্যদিকে বিদেশিরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের শোভাযাত্রাটি ছিল সুন্দর ও বর্ণাঢ্য। শোভাযাত্রায় বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির জয়গানের কথা বলা হয়।
দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু প্রবাসে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের মধ্যে বয়স ও বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বে ছিলেন নাসরিন চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন, জেবু চৌধুরী, সুলেখা পাল, পারভিন সুলতানা, আলপনা গুহ, কুলসুম পপি ও রাহাত কাজী। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শিশু-কিশোরদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলি। তিনি বলেন, বাংলা সংস্কৃতি হচ্ছে পৃথিবীর শক্তিশালী সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রবাসে জন্ম নেওয়া ও বেড়া ওঠা নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখলে হলে এই সংস্কৃতির মাধ্যমেই সম্ভব। যেটা করে গ্রিকরা।
ফাহিম রেজা নূরের সঞ্চালনায় কবি রফিক আজাদ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় লেখক, পাঠক ও প্রকাশক মুখোমুখি শীর্ষক অনুষ্ঠান। এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন সেলিনা হোসেন, আনিসুল হক, মনিরুল হক, ফরিদ আহমেদ, তাসমিম হোসেন, টিউলিপ চৌধুরী, নাজমুন নেসা পেয়ারি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন।
সেলিনা হোসেন বলেন, আমি কখনো সমঝোতা করে লেখা ছাপাব না। আমি পাঠকের জন্য লিখি। আমার লেখায় পাঠক, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে।
আনিসুল হক বলেন, আমাদের দেশে ইদানীং দেখা যায় অনেক প্রকাশই লেখকের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বই প্রকাশ করেন। আবার অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থাতেই সম্পাদক থাকেন না এবং সম্পাদনা করা হয় না।
মনিরুল হক বলেন, রাষ্ট্র ও ধর্মের বিরুদ্ধে আমরা কোনো লেখা বা বই প্রকাশ করি না। বই প্রকাশ করা আমাদের নেশা ও পেশা। এর সঙ্গে আমাদের টিকে থাকা ও বেঁচে থাকার ব্যাপার আছে। আর আমরা লেখা ছাপি না, বাছাই করে লেখা ও বই প্রকাশ করি।
ফরিদ আহমেদ বলেন, প্রকাশকদের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। সব অভিযোগের ভিত্তি নেই, কিছু কিছু অভিযোগের ভিত্তি আছে। তিনি বলেন, আমরা দেখেশুনে ও মানসম্মত লেখা ও বই প্রকাশ করি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ওপর আট হাজার পৃষ্ঠার বিশাল বই প্রকাশ করেছি কোনো সরকারি অনুদান ছাড়াই। তিনি বলেন, এটা সত্যি যে আমরা প্রকাশকেরা আস্থার জায়গা এখনো তৈরি করতে পারিনি।
আদনান সৈয়দের সঞ্চালনায় এ বছরের নতুন বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন সেলিনা হোসেন, আনিসুল হক ও রামেন্দু মজুমদার।
নতুন লেখকদের মধ্যে উপস্থিত থেকে নিজ বই সম্পর্কে বলেন, কবি তমিজ উদ্দিন লোদী, সাংবাদিক আহমেদ মুসা, কবি ফকির ইলিয়াস, জসীম মল্লিক, কবি শামস আল মমিন, কাজী জহিরুল ইসলাম, শফিউল আলম, ওবায়দুল্লাহ মামুন, রওশন হাসান, জুলি রহমান, আশরাফ আহমেদ, মনিজা রহমান, ডা. কৌশিক সেন, সাজ্জাদ বিপ্লব, আহমেদ সবুর, আলম সিদ্দিকী ও রিমি রুম্মান।
সেলিনা হোসেন বলেন, আপনারা যারা প্রবাস থেকে লিখছেন আপনাদের মনন, চিন্তা ও চেতনায় বাংলাদেশ রয়েছে। আপনাদের লেখায় তাই ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, আপনারা দেশ ও ভাষাকে মননে রেখে যদি ইংরেজিতে লেখেন তাহলে অনেক ভালো হবে। বাংলা সাহিত্যও বিদেশিদের কাছে পৌঁছাবে ও বিশ্ব পরিমণ্ডলে উঁচু আসনে স্থান করে নেবে।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, আমি লেখালেখি করি কিন্তু লেখক হিসেবে নিজেকে দাবি করি না। তিনি বলেন, প্রবাসেও আমাদের লেখক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অর্থ খরচ করে বই বের করেন, আবার কোনো কোনো প্রকাশকও তাকিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ভালো লেখা হলে প্রকাশকরাও ছাপবে। আজকে যাদের লেখা সম্পর্কে জানলাম তাতে মনে হয়েছে আপনাদের লেখায় আমাদের বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে।
অনিসুল হক বলেন, তার মা বইটি দিল্লি থেকে ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করার জন্য অনুরোধ করেন সেলিনা হোসেন ও রামেন্দু মজুমদারকে। তিনি বলেন, আজকে এই অনুষ্ঠানে অনেক লেখক পেলাম, আমার ভালো লাগল।
ছড়াকার মঞ্জুর কাদেরের পরিচালনায় স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এ বি এম সালেহ উদ্দিন, আনোয়ার সেলিম, চারু হক, ফারহানা পলি, খালেদ শরফুদ্দিন, কবিতা হোসেন, লাকি সেরনিয়াবত, লালন নূর, সালমা বাণী, মামুন জামিল, মনিজা রহমান, নাসির উল্যাহ মোহাম্মদ, নূপুর কান্তি দাস, নূরুল ইসলাম, ওমর শামস, কাজী জহিরুল ইসলাম, রওশন হাসান, রিপা নুর, সাজেদ কামাল, সাজ্জাদ বিপ্লব, শাহ আলম, শামস চৌধুরী, শরিফুল আলম, স্বপ্ন কুমার, সোনিয়া কাদের, সৈয়দ আহমেদ, তমিজ উদ্দিন লোদী ও ভায়লা সেলিনা লিজা প্রমুখ।
তানভীর রাব্বানীর উপস্থাপনায় যারা লেখক হতে চান: সম্পাদক ও প্রকাশকদের পরামর্শ অনুষ্ঠানে ত্রিদিব কুমার চ্যাটার্জি বলেন, আমি লেখক ছিলাম না, আমি ছিলাম বিজ্ঞানী। আমার বাবার কারণেই আমি এই পেশায়। তিনি বলেন, লেখক হতে হলে ভালো পাঠক হতে হবে। আমাদের পাঠাভ্যাস কমে যাচ্ছে। আমরা এখন চিঠি লিখি না, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করি। তিনি বলেন, আমরা কলকাতার বিশ্বভারতী থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বই প্রকাশ করেছিলাম। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, নতুন প্রজন্ম বই পড়া বাদ দিয়ে টিভির দিকে ঝুঁকছে কেন? প্রচুর লিখছেন কিন্তু লেখা পড়ছেন না। কারণটা কি? নতুন প্রজন্ম কী চায় তার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে লিখতে হবে। লেখকদের জন্য কী কোনো ওয়ার্কশপ আছে? তাদের কী পরামর্শ দেওয়ার জায়গা আছে? তারপরেও আমেরিকা, ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্মের অনেক বাঙালি লিখছেন ও পুরস্কারও পাচ্ছেন।
তাসমিমা হোসেন বলেন, ভালো কিছু করতে হলে পড়তে হবে, পড়ার কোনো বিকল্প নেই। ইদানীং এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে, বাবা-মারাও তাদের সন্তানদের পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই পড়তে বলেন না। আজকাল সবকিছুই যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। প্রেমও এখন ফেসবুকের মাধ্যমে করে। আমাদের সময় চিঠি লিখে তা ঢিল দিয়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হতো।
ফরিদ আহমেদ বলেন, প্রকাশক মানে ব্যর্থ লেখক। আমরা বাঙালিরা পরামর্শ দিতে পারি ভালো। কিন্তু পরামর্শ দিতে আসিনি। আমি যেটা বলতে চাই, লিখতে হলে পড়তে হবে। ১০০ বই পড়ে একটি বই লিখতে হবে। কিন্তু অবস্থা হয়েছে এমন একটি বই পড়েই ১০টি বই লিখতে চায়। তিনি বলেন, বাংলা ভাষা সাহিত্য রচনা করা সহজ নয়। তারপরেও নতুন প্রজন্মের অনেকেই গবেষণাধর্মী বই লিখছেন।
সউদ চৌধুরীর পরিচালনায় আলাপচারিতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন প্রবাসে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি। একজন নিউজার্সির কাউন্সিলম্যান, অন্যজন হচ্ছে চ্যানেল ১১-এর সাংবাদিক। আমেরিকায় বাংলার মুখ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক নারমিন চৌধুরী বলেন, ছোটবেলায় বাবা-মার সঙ্গে আমরা বাংলাদেশি অনুষ্ঠানে আসতাম। আমি বাংলা বলতে পারি। এই ধরনের অনুষ্ঠান নতুন প্রজন্মের জন্য ভালো। তিনি বলেন, আমার বাবা একজন ফার্মাসিস্ট ছিলেন। তিনি চাইতেন আমি ডাক্তার বা ফার্মাসিস্ট হই, কিন্তু আমি হলাম সাংবাদিক। আমি জানতাম আমি সাংবাদিক হব। কিন্তু কোনো দিন বাবাকে বলিনি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা কষ্টের পেশা। তারপরেও আমি এই পেশা বেছে নিয়েছি। এই পেশায় আমি বাংলাদেশি রোডমডেল খুঁজে পাই না। আমি আগামী প্রজন্মের রোলমডেল হতে চাই। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে ইসলাম বিরোধী প্রোপাগান্ডা চলছে। কোনো কিছুতে দ্বিমত করতে হলে আমি করি কিন্তু সম্মিলিত যে শক্তির প্রয়োজন তা আমি পাই না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে নারমিন বলেন, বাংলাদেশে তার রোল মডেল হচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কাউন্সিলওম্যান তাহসিনা আহমেদও বললেন, তার রোল মডেল ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাহমিনা বলেন, ছোটবেলায় তিনিও তার অভিভাবকদের সঙ্গে বাংলাদেশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন। এখনো মাঝে মধ্যে যান। তিনি বলেন, আমি রাজনীতিবিদ হতে চাই না, আমি আমার এলাকার মানুষের সেবা করতে চাই, বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।
নতুন প্রজন্মের বই নিয়ে আলোচনা করেন আব্দুস সেলিম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় ছিলেন বাঙালির সম্পাদক কৌশিক আহমেদ। কৌশিক আহমেদ বলেন, এই অনুষ্ঠান আমি ছয় বছর ধরে আসছি। কিন্তু এবারের মতো অবস্থা কখনো হয়নি। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনুষ্ঠান আগে শুরু করায় সমস্যা হয়েছে।
বাংলার লোক ঐতিহ্য: আলাপচারিতা ও গানের অনুষ্ঠানটি মাতিয়ে রাখেন শিল্পী তাজুল ইমাম। তিনি লোকসংগীতের বিভিন্ন ভার্সন তুলে ধরেন ও গেয়ে শোনান। এই অনুষ্ঠানটি যখন জমে উঠছিল ঠিক তখনই সময়ের কারণে যবনিকাপাত ঘটে। অনুষ্ঠানটি পরিচালনায় ছিলেন আনিসুল হক। আলোচক ছিলেন রামেন্দু মজুমদার। আনিসুল হক বলেন, যা লিখছি ও করছি তার মধ্যে লোক সংস্কৃতির শেকড় জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথেরও লোকসংগীত রয়েছে। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ সর্বকালের, সর্বাধুনিক ও সর্বস্থানের লোক।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, লোকসংগীত বাদ দিয়ে সংগীতের ও দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। লোকসংগীত মানুষকে বিদ্যুতের মতো কাছে টানে। যে কারণে নতুন প্রজন্মও লোকসংগীতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এ দিন দলীয় অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে রঞ্জনী। রঞ্জনীর পরেই লেখক ফেরদৌস সাজেদীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় কেন লিখি অনুষ্ঠান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন লুৎফর রহমান রিটন, মোহিত কামাল, সৈয়দ আল ফারুক ও রিফাত কামাল সাইদ।
লুৎফর রহমান রিটন বলেন, আমি ঘোড়ার ডিম লিখি। আমার লেখায় কী হয়? রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কী বন্ধ হয়? আমি কি রাজনীতিবিদদের মতো সম্পদ লুণ্ঠন করতে পারি? আমি কী সন্ত্রাস করতে পারি, আমি কী ধর্ষণ করতে পারি? আমি কী খুন করতে পারি? আমি কী জোর করে ভোট আদায় করতে পারি? আমি তো গডফাদার হতে পারি না? আমি কী সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ বন্ধ করতে পারি? আমি কী প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করাতে পারি? তাহলে কী লিখি? ঘোড়ার ডিম লিখি? আমি ভিতু। প্রতিবাদও করতে পারি না, সামনাসামনি গালিও দিতে পারি না, তাই লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ করি। প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাতেই আমি লিখি।

ইকবাল হাসান বলেন, আসলে লেখালেখিতে সমাজ পরিবর্তন হয় না। বর্তমানে আমরা ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। মৌলবাদের থাবা চলছে, মুক্তমনা লেখকদের হত্যা করা হচ্ছে। সরকারও বিচার করতে পারছে না। তিনি বলেন, আমার বাড়ি বরিশালে। নদী ও প্রকৃতির লীলাভূমি। সেই প্রকৃতি দেখেই আমি লেখা শুরু করি। অন্যদিকে মনের কষ্ট দূর করতে আমি লিখি।
সৈয়দ আল ফারুক বলেন সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করতে আমি লিখি। আমি ফুটবলার, ক্রিকেটার বা পাইলট হতে পারিনি, তাই লেখক হয়েছি।
মোহিত কামাল বলেন, রিটন বলেছেন ঘোড়ার ডিম লিখছেন। আসলে তিনি তেজি ঘোড়া সৃষ্টি করছেন, যে সব ঘোড়া আগামী দিনে এ সব অনাচার দূর করবে। রফিকুল ইসলাম দাদা ভাইয়ের কারণেই আমার লেখা। আমি প্রতিদিন সকালবেলা লিখতে বসি। না লিখলে মনে হয় কিছু একটা মিস করেছি। তিনি বলেন, এখন তো প্রকাশদের তাড়াতেই লিখি।
আহ্বায়ক হাসান ফেরদৌসের পরিচালনায় লেখকের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেলিনা হোসেন। সেতার ও তবলার সমন্বয়ে যন্ত্রসংগীতে অংশগ্রহণ করেন ডেউজি প্যারাড়ি ও পিনাকপানি গোস্বামী।
রানু ফেরদৌসের সঞ্চালনায় নারী লেখক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তাসমিমা হোসেন ও গুলতেনিক খান। আলোচনায় তারা লেখক জীবনের গল্প তুলে ধরেন। গুলতেকিন বলেছিলেন, তার দাদার কারণেই তার লেখালেখিতে আসা। তাসমিমা হোসেন জানান তার ইচ্ছার কথা।
নীরা কাদরীর পরিকল্পনায় কবি শহীদ কাদরীর কবিতা নিয়ে অনুষ্ঠান কবিতাই আরাধ্য আমার অনুষ্ঠানে কবি শহীদ কাদরীর কবিতা আবৃত্তি করেন ক্রিস্টিনা রোজারিও, ক্লারা রোজারিও, মিজানুর রহমান, আবির আলমগীর, এজাজ আলম ও হোসেন শাহরিয়ার তৈমুর। আবৃত্তির পাশাপাশি কবির শহীদ কাদরীর বর্ণনা ছিল অভূতপূর্ব। কবি শহীদ কাদরী প্রথম এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠান করলেন সকলের জন্য উন্মুক্ত স্থানে।
গানের ভেলায় সংগীত পরিবেশন করেন প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পী শাহ মাহবুব।
দীপন (ফয়সাল আরেফিন দীপন) কেÿ ছিল লুৎফর রহমান রিটনের পরিচালনায় ছড়ার জাদু পাঠ। অংশগ্রহণ করেন আমিরুল ইসলাম, সৈয়দ আল ফারুক, মনজুর কাদের ও শাহ আলম দুলাল।
বইমেলা: ঢাকায়, কলকাতা, নিউইয়র্ক ও বার্লিনে—কথোপকথন অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ফরিদ আহমেদ। আলোচনায় ছিলেন নাজমুন নেসা পিয়ারী, মো. মনিরুল ইসলাম, আহমেদ মাহমুদুল হক, জহিরুল আবেদীন।
আমাদের রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও কমলিনী মুখোপাধ্যায়। তারা রবীন্দ্রনাথের সংগীত জীবন ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেন। জি এইচ আরজুর সঞ্চালনায় জেনোসাইড ১৯৭১ নিয়ে আলোচনা করেন ড. প্রদীপ রঞ্জন কর, সেলিনা হোসেন, ওবায়দুল্লাহ মামুন ও তাজুল মোহাম্মদ।
দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন শিল্পী কমলিনী তার অনিন্দ্য সুন্দর রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে।
তৃতীয় দিনের বইমেলার শুরু হয় বইমেলায় আসা কবি ও লেখকদের প্রাতরাশ ও আড্ডায়। এই আড্ডায় ছিল মজার গল্প, অন্যের চরিত্র হননের ভালগার গল্প। নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোরদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন সেলিনা হোসেন, রামেন্দু মজুমদার, গুলতেকিন খান ও হাসান ফেরদৌস।
কবি তমিজ উদ্দিন সঞ্চালনায় স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন আমিরুল ইসলাম, আলম সিদ্দিকী, আতিক কাজী, আতিকুর রহমান, বাদিউজ্জামান নাসিম, ফকির ইলিয়াস, হুমায়ূন কবির, জুলি রহমান, খান শওকত, খিজির হায়াত, খন্দকার জাহাঙ্গীর, কৌশিক সেন, লিয়াকত আলী, লুবনা কায়সার, লুৎফা সাহানা, মোহিত কামাল, মাকসুদা আহমেদ, ইকবাল হাসান, সৈয়দ আল ফারুক, মনজুর কাদের, মিনহাজ আহমেদ, মিশুক সেলিম, এ কে এম আনাম, পপি শাহিনা, শাহীন ইবনে দিলওয়ার, শামস আল মমিন, স্বপন চক্রবর্তী, সৈয়দ মামুনুর রশিদ ও তাহমিনা জামান প্রমুখ।
আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করেন গোপন সাহা, ফারুক আজম, আনোয়ার হোসেন ও জি এইচ আরজু।
ডানা ইসলামের উপস্থাপনায় নজরুলের গানের ওয়ার্কশপ নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সুজিত মুস্তাফা। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, আমি যখন গান শুরু করি তখন আমার মা বলতেন কলকাতার ভালো গান শোন। কিন্তু মার কথা খুব একটা শুনতে চাইনি। কিন্তু গানগুলো যখন আমি শোনা শুরু করলাম তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। তিনি বলেন, সবার আগে আমাদের মননকে তৈরি করতে হবে। মনন তৈরি করলেই আমরা একটি সুস্থ জাতি পাব। তিনি বলেন, চক্রবাকের মাধ্যমে তিনি সারা বাংলাদেশে নজরুল সংগীত ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নজরুল ৫১ ধরনের সুরে গান করেছেন এবং ১৫ হাজার নতুন শব্দ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন ২৫ হাজার শব্দ। নজরুল হচ্ছেন আধুনিক বাংলা গানের জনক। তিনি আরও বলেন, অর্থের কাছে ভালো শিল্প ও শিল্পী মরে যাচ্ছে। ভালোবাসা থেকে শিল্পী তৈরি হচ্ছে কম। সুজিত মুস্তাফার পাশে ছিলেন নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ।

নতুন বই নিয়ে অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। অংশগ্রহণ করেন ঘটি বাহিনীর লেখক ড. পার্থ ব্যানার্জি, জীবন এত ছোট কেনর লেখক ডা. সিনহা আবুল মনসুর, মাহফুজুল বারী, মুস্তফা চৌধুরী, মিলি সুলতানা, শফিউল আলম, রোকেয়া জামান, খান শওকত, শামীম আল আমিন। উপস্থাপনা করেন জসীম মল্লিক।
শেষ দিন বইমেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ছিল চ্যানেল আই-মুক্তধারা বইমেলা ২০১৬ সাহিত্য পুরস্কার। এই পুরস্কার ঘোষণার আগে হাসান ফেরদৌস জানান, ভোটের মাধ্যমে কবির নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। মেলা কমিটির ১১ জন সদস্য এই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। আমীরুল ইসলাম ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন। তিনি জানান, এই পুরস্কার পেয়েছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। এই পুরস্কারের মূল্যমান ছিল ২ লাখ টাকা। এই সময় স্টেজে উঠে রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর আনোয়ার হোসেন ঘোষণা দেন তিনি আরও ৩ লাখ টাকা দেবেন। এর ফলে পুরস্কারের অর্থ দাঁড়ায় ৫ লাখ টাকা।
এ ছাড়া বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় সেলিনা হোসেনকে। এ পর্ব পরিচালনা করেন হাসান ফেরদৌস। সেলিনা হোসেনকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন লেখক সাংবাদিক মনজুর আহমেদ। বিজ্ঞপ্তি।