১৯-২০ ফেব্রুয়ারি সিডনিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান
পৃথিবীতে এমন অনেক প্রধান ভাষা আছে, যেসব ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা এক কোটিরও কম। সেদিক থেকে প্রবাসে এক কোটি বা তারও বেশি বাঙালির বাংলাভাষা চর্চার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ বিষয়টিকে কোনো সরকারই কখনো তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। তাই বিদেশে বাংলাভাষার বিস্তার ও আধিপত্যের কৌশল নির্ধারণে বাংলাদেশ সরকারের কোনো নীতিমালা নেই ইংরেজি, জার্মান বা ফরাসি ভাষা বা অন্যান্য ভাষার মতো।
যে ভাষার অর্থনৈতিক আধিপত্য বেশি, সে ভাষা শিখতেই মানুষ বেশি উৎসাহী হয়। বাংলাদেশের যেহেতু বৈশ্বিক কোনো অর্থনৈতিক আধিপত্য নেই, তাই ইউরোপ-আমেরিকার বিদেশি নাগরিকেরা তো দূরের কথা, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরাও বাংলাভাষা চর্চা বা বাংলায় শিক্ষাগ্রহণে তেমন উৎসাহী হন না। যদিও ইউরোপ ও আমেরিকায় নিয়ম হচ্ছে মাধ্যমিক স্কুলে ওঠার পর শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় একটি ভাষা শেখার সুযোগ দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাভাষা আগামী দিনে বিজনেস কমিউনিটির ভাষা হয়ে উঠতে পারবে না, এমন আশঙ্কা মাথায় রেখে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীরা বাংলা শেখায় আগ্রহী হন না।
মানব ইতিহাসের গভীরে দৃষ্টিপাত করলে এটা সহজেই অনুমেয়-প্রতিটি মাতৃভাষার জন্ম হয় একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা ও সাংস্কৃতিক পরিবেষ্টনের মধ্যে। যেখানে মানবশিশু জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই তার সেতু সংযোগ রচিত হয় পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, সমাজ সংস্কৃতি, ব্যবহারিক জীবনের বিবিধ রীতিনীতি ও ধর্মাচারের সঙ্গে। মানস গঠনে এর প্রভাব তাই অনেক গভীরে প্রোথিত। প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে সহজে মানুষ প্রবাস জীবনে মাতৃভাষা পরিত্যাগ করতে চায় না। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই আধুনিকতার প্রতীক। বিশ্বায়নের নাটকীয় পরিবর্তনে পৃথিবী জুড়ে ইংরেজি এখন সবচেয়ে প্রতাপশালী ভাষা। তারপরই স্থান রয়েছে চীনা, স্পেনিশ, হিন্দি, রাশিয়ান, আরবি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ ও পর্তুগিজের। বর্তমানে নগণ্য কিংবা উল্লেখযোগ্য হারেই হোক পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই ইংরেজি ভাষা জানা লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুতলয়ে। বিশ্বায়নের মাপকাঠিতে বদলে যাচ্ছে জীবনাদর্শ।
২০১৩ সালে প্রকাশিত উইকিপিডিয়া তথ্য অনুসারে সারা বিশ্বে বাঙালি জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ কোটির কাছাকাছি। জনসংখ্যার এই বিশালত্ব এশিয়া মহাদেশে বাঙালি জাতিকে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং ৭ হাজার ভাষার মধ্যে তার মাতৃভাষার অবস্থান নির্ণয় করেছে যথাক্রমে দ্বিতীয় আসনে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে ১৮৫ দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপিত হয়ে থাকে।
অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত নতুন প্রজন্মের বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি এসফিল্ড কাউন্সিল ও মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ কনজারভেশন মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ইনক যৌথভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৬ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। বৈশ্বিক লাইব্রেরি সেবার মাধ্যমে স্থানীয় সকল মাতৃভাষার বর্ণমালা সংগ্রহের প্রথা অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে প্রতিটি লাইব্রেরিতে একুশে কর্নার করার উদ্যোগ সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়। এসফিল্ড কাউন্সিল, বাংলাদেশ সরকার, একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়া ও স্থানীয় মাতৃভাষাপ্রেমী সকলের সার্বিক ও সামগ্রিক সহযোগিতায় উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৬। আগামী ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি দুই দিনব্যাপী অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনুষ্ঠান উদ্যাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকেলে স্থানীয় কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রশাসক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে বিশ্বের সকল মাতৃভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় দিন ২০ ফেব্রুয়ারি শনিবার এসফিল্ড লাইব্রেরিতে প্রথম একুশে কর্নার উদ্বোধন করা হবে। এরপর স্থানীয়ভাবে পরিচালিত ভাষাভিত্তিক স্কুলসমূহের ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে মাতৃভাষা প্রদর্শনীসহ সংশ্লিষ্টদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান (এন আই খান)। সার্বিক আয়োজন ও তত্ত্বাবধানে আছে মিউচুয়াল হোমস। মিডিয়া পার্টনার আরটিভি।
উল্লেখ্য, মিউচুয়াল হোমস অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক বাংলাদেশি মালিকানাধীন রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাবেদ হক জানান মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ কনজারভেশন মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ইনকের উদ্যোগকে সহযোগিতা করতে পেরে তারা নিজেদের ধন্য মনে করছেন। তাদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতেও সকল ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালি উৎসবকে উৎসাহ উদ্দীপনা জোগাতে নিজ উদ্যোগে মিউচুয়াল হোমস পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে।
প্রবাসে বাংলাদেশিদের মধ্যে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মাঝে মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার আশা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে। প্রথম প্রজন্মের মুখে টিকে আছে মায়ের ভাষা। দ্বিতীয় প্রজন্মের মাঝে বাংলার ব্যবহার আধাআধি। তৃতীয় প্রজন্ম বাংলা ভাষাকে ধরে রাখবে কতটুকু তা নিয়ে শঙ্কা দিন দিন প্রবল হচ্ছে। ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি প্রধান সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ নিজের সংগ্রামী শক্তির প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এ আন্দোলনের মাধ্যমে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বের বুকে আজ বলবার মতো একটা অবস্থান করে নিতে পেরেছি সেই অর্জনকে ক্রমশ ছোট করা হচ্ছে। আমাদের মহান মাতৃভাষাকে কৌশলে করা হচ্ছে উপেক্ষার বিষয়ে। এর জায়গায় অঘোষিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করা হচ্ছে অন্য ভাষাকে। এটা ঠিক, দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে কিংবা দুনিয়ার মানুষের কাছে নিজের কথা পৌঁছে দিতে বিশ্বে সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা জানা দরকার। কিন্তু জানবার জায়গায় প্রাধান্য দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নিজের ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষাকে সম্মান করা কিংবা দরকার পড়লে রপ্ত করবার চেষ্টা করা দোষের কিছু নয় বরং এটাই যৌক্তিক।
প্রবাসে ও দেখা যায় বাংলা ভাষার ব্যবহারে বিভিন্ন সংগঠনের চেষ্টার কমতি নেই। ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক উদ্যোগেও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাংলা স্কুল। কিন্তু এসব বাংলা স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমে আগ্রহ নেই বেশির ভাগ অভিভাবকের। সন্তানের জন্য বাড়তি চাপ মনে করেন তারা। আর এ কারণে নতুন প্রজন্মের শিশুরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বাংলা শিক্ষায়। তবে এতসব বাধা-বিপত্তির পরেও এই কমিউনিটিতে অনেক শিশু গড়ে উঠছে বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে। আর এর পেছনে কৃতিত্ব তাদের অভিভাবকদেরই।
(লেখিকা অস্ট্রেলিয়ার সিডনিপ্রবাসী)