হীরক রাজাদের রাজত্ব

সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রটি প্রথম যখন দেখি, তখন আমাদের যৌবন। যৌবন মানে বিদ্যমান অসাম্য, অমানবিকতায় ভরা বিশ্বকে ভেঙে চুরমার করে স্বপ্নের পৃথিবী গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছার বয়স। পৃথিবী ও দেশের যেকোনো অসংগতি অন্তর থেকে অপছন্দ করি। মিছিল করি। কবিতা লিখি। বিতর্ক করি। যার যত সৃষ্টিশীল, সৃষ্টিহীন কাজ আছে তা করে বেড়াই। পঁচাত্তরের নভেম্বরে এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা দেওয়ার সময় তিনটি সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। দেশে গা ছম ছম করা সামরিক শাসন। তারপরও ছাত্ররা স্লোগান দেয় ‘এ সমাজ ভাঙতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে’। সমাজটি কেমন করে ভাঙতে হবে আর নতুন করে আবার কীভাবে গড়তে হবে, এ বিষয়ে কিন্তু স্পষ্ট ধারণা নেই কারও। তবে দমবন্ধ পরিবেশ গ্রহণীয় নয়, এ রকম স্লোগান দিয়ে ছাত্ররা তা বুঝিয়ে দেয়।

১৯৭৬ সালের মার্চে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর শুনি আমাদের অনেক জ্যেষ্ঠ বন্ধুকে রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে। মনে হলো, ফিরে এল মুক্তিযুদ্ধের কাল, রাতের আঁধারে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নেওয়া হতো যেমন, আমাদের বন্ধুদেরও ঠিক সেভাবে নিয়ে যাওয়া হতো। যাদের গভীর রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এরা কেউ রাজনীতি করত না। তবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল। তাঁদের দু/তিন বছর কারাগারে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার কোনো প্রমাণ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারাগার থেকে বের হয়ে অনেকেই সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। ভয়ে জীবন্ত মূর্তির মতো চলাফেরা করে। এ রকম দমবন্ধ পরিবেশের মধ্যে সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে সার্ক দেশগুলোর চলচ্চিত্র হিসেবে আমরা প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রটি দেখার সুযোগ পাই।

‘হীরক রাজার দেশে’ ছাত্র ও গণমানুষের মনের ভেতরে শাসকদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ জমা হয়েছিল, সে ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল। কর্তৃত্ববাদী শাসন কী? জনগণকে দাবিয়ে রাখার নিষ্ঠুর উপায়গুলো দেখে ভেতরের দ্রোহের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেল। চলচ্চিত্রটি দেখে ঘোর কাটে না। সবাই এক অন্যরকম বিস্ময়ে বিমূঢ়। শুধু গল্পে নয়, চলচ্চিত্রটি উপস্থাপনার ভিন্নতা আমাদের চমকিত করে তুলেছিল। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষ ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান–ভারত যুদ্ধের পর থেকে ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পাচ্ছিল না রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে। স্বাধীনতার পর সুনির্দিষ্ট কিছু ভারতীয় বাংলা ছবি ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে দেখানো হতো। তাই সর্বার্থে ‘হীরক রাজার দেশে’ আমাদের জন্য ছিল বিনোদন এবং চিন্তার জগতের বদ্ধ দরজা খুলে দেওয়ার পর যে বিস্ময় তৈরি হয়, ঠিক সেরকম কিছু।

সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রটির সংলাপ ছড়ার ছন্দে শুধু একজন মূল চরিত্র ছাড়া। আমাদের বন্ধু–বান্ধব পরিচিত অনেকেরই পুরো চলচ্চিত্রের সংলাপ মুখস্থ। মনে হচ্ছিল এ রকম একটি চলচ্চিত্রের জন্য দেশের মানুষ অপেক্ষায় ছিল। শাসকশ্রেণির নীতি নির্ধারকেরা বিষয়টি হয়তো বুঝতে পারেননি, না হলে এ রকম একটি অগ্নিগোলক তারা বিক্ষুব্ধ মানুষের মনের উঠোনে ছুড়ে মারবেন কেন?

‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রটি গোপী ও বাঘা সিরিজের গল্প হলেও চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র হীরক রাজা। হীরক রাজ্যে সম্পদের অভাব নেই, হিরার খনিতে পরিপূর্ণ একটি রাজত্ব। রাজ্যে অফুরন্ত প্রাচুর্য, কিন্তু শ্রমিকেরা না খেয়ে মারা যায়। যত বেশি সম্পদ তত বেশি শোষণ, তত বেশি বঞ্চনা। চলচ্চিত্রটিতে হিরার খনির শ্রমিকদের শোষণের জন্য কীভাবে অত্যাচারিত, নিগৃহীত হতে হয়, তা সত্যজিৎ রায় শিল্পিত নান্দনিকতায় উপস্থাপনা করেছেন। কর্তৃত্ববাদী সমাজের শাসকশ্রেণির চরিত্র আমাদের কাছে খুব পরিচিত ও জীবন্ত বলে মনে হতে থাকে। শোষণের কৌশল হিসেবে হীরক রাজা জনগণকে তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে বেপরোয়া থাকেন। শিক্ষাঙ্গন বন্ধ করতে হীরকের রাজাকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে দেখা যায়। হীরক রাজার মনে বড় ভয়, ভয় তাঁর সচেতন জনগণকে।

চলচ্চিত্রের এক জায়গায় হীরক রাজাকে বলতে শোনা যায়, ‘এরা যত পড়ে, তত বেশি জানে আর তত কম মানে।’ অধিকার বিষয়ে অসচেতন জনগণ তাঁর জন্য সম্পদ। জনগণ ঘুমিয়ে থাকলে, কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা স্বস্তিতে থাকতে পারেন। অধিকার নিয়ে আলোচনায় ক্ষমতার ভিত কেঁপে ওঠে। কর্তৃত্ববাদী শাসক তাই সব সময় জনগণের চিন্তা, চেতনার জগতে আধিপত্য বিস্তার করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ রকম অপকর্মে সহায়তা করতে রাজানুগ্রহের বিনিময়ে এগিয়ে আসেন গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি অংশ। চিন্তা–চেতনায় আধিপত্য বিস্তার করে অনুগত দাস তৈরিই তাঁদের প্রধান কাজ। শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা প্রশ্ন করেন, তাঁরাই রাজদ্রোহী। এ রকম মানুষের চিন্তার ধারা পরিবর্তন করতে তৎপর হীরক রাজার অনুগত বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীদের আছে মগজ ধোলাইয়ের ঘর। দ্রোহে পরিপূর্ণ মানুষের চেতনা ধোলাইয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় যন্তর–মন্তর ঘর। সেখানে দ্রোহীদের রূপান্তর প্রক্রিয়া চলে। প্রক্রিয়া শেষে দ্রোহেপূর্ণ মানুষ তোতাপাখিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আনুগত্যশীল মানুষ তোতা পাখির মতো রাজা ও রাজ ব্যবস্থার প্রশস্তি গাইতে থাকে।

চলচ্চিত্রটি দেখার পর থেকেই ছাত্ররা এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিল, একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হলে রাজ কবির লেখা আনুগত্যের মন্ত্রগুলো আওড়িয়ে নিজেদের মধ্যে দেশীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করত। ছাত্রদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত, কে কত তোতা পাখির বুলি বলতে পারে। আমাদের বন্ধুদের মুখে মুখে যেসব তোতা পাখির বুলি ঘুরে বেড়াতো, সেগুলো ছিল, ‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না’, ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’, ‘যে করে খনিতে শ্রম, যেন তারে ডরে যম, ‘অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ’, ‘লেখাপড়া করে যেই, অনাহারে মরে সেই’।

ছড়ার ছন্দে লেখা এসব সংলাপ পরবর্তীতে ছাত্র ও গণআন্দোলনেও স্লোগান হিসেবে ব্যবহার হতে দেখেছি। বিশেষ করে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের শেষের দিকে ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’, এই স্লোগানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

চলচ্চিত্রটির প্রতিটি চরিত্রই প্রতীকী। রাজার মন্ত্রী সভার সদস্যদের আধুনিক যুগের মন্ত্রীদের মতো রাজার কথার সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা যায়। রাজার অন্যায্য, উদ্ভট সব কথার শেষে যন্ত্রের মতো তাদের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হতে থাকে ‘ঠিক ঠিক ঠিক’। চাটুকার, বিবেকহীন সভাসদরা রাজার সব কাজে অন্ধ সমর্থন দিয়ে লাভ করে নানা পুরস্কার। চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায়, জনগণ যখন অনাহার প্রাণ হারাচ্ছে কিংবা মৃতপ্রায়, তখন সভাসদরা রাজানুগ্রহ হিসেবে হিরের হার গ্রহণ করছে। হীরক রাজার সভাসদদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় দেখা যায় শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রীকে। রাজা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আগে রাজ্য থেকে যেন দারিদ্র্যের সব চিহ্ন মুছে দেওয়া হয়। কোনো ভিখারিকে যেন পথে দেখা না যায়। এ যেন আমাদের এই বৈষম্যমূলক সমাজেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে উচ্ছেদ করা হয় ছিন্নমূল মানুষদের। অথচ মানুষকে অনাহারী রেখে যেকোনো নগরের সৌন্দর্য বর্ধন যে সম্ভব নয়, সেটা আমাদের শাসকশ্রেণি বুঝতে চায় না। একটি সৃষ্টিশীল শিল্প যখন কালোত্তীর্ণ হয়, তখন তার প্রাসঙ্গিকতা দেশ ও কালে ছাড়িয়ে যায়। ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

দেশ–কাল ছাড়িয়ে ‘হীরক রাজার দেশে’–এর গল্প আমরা এখন সারা পৃথিবীতে দেখতে পাই। শুধু কী উপমহাদেশের দেশগুলোতেই কর্তৃত্ববাদী শাসন, সাম্প্রদায়িক সংকট? এশিয়াজুড়ে এমন কি ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, ল্যাটিন আমেরিকায়ও হীরক রাজারা শাসন করছেন এখনো। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখলাম ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ক্যাপিটাল হিলে হামলা করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহরা সবাই ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে নীতিহীন, নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। বর্ণবাদকে ইউরোপ–যুক্তরাষ্ট্রে পুষ্ট করা হচ্ছে। আর আমাদের উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে। বৈষম্য সৃষ্টির জন্য শাসকেরা সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন।

হীরক রাজারা দেশে দেশে নানা রূপে এখনো যন্তর–মন্তর ঘরে মানুষকে ঢুকিয়ে তাদের ভয়ার্ত করে তুলছেন। ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রে রাজার সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন পাঠশালার শিক্ষক উদয়ন মাস্টার। উদয়ন মাস্টারই কেবল কোনো কিছুর বিনিময়ে নিজের বিবেককে বিলিয়ে দেননি হীরক রাজার কাছে। তিনি বিবেকের তাড়নায় অসম শক্তি দিয়ে রাজার বিরুদ্ধে লড়তে থাকেন।

চলচ্চিত্রটির শেষ দিকে দেখা যায়, হীরক রাজার বিশাল মূর্তি উন্মোচন উৎসব। সে উৎসব শোষিতের নেতা, বিবেকের প্রতীক উদয়ন পণ্ডিত রাজ-অতিথি গোপী ও বাঘার সহযোগিতায় পণ্ড করে দেয়। দেশের জনগণ উদয়নের নেতৃত্বে হীরক রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সবার সম্মিলিত শক্তিতে নামিয়ে ফেলা হয় মূর্তিটি।

বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের সার্বিক মুক্তি এখন বড় প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু মানবমুক্তি ঘটেনি। দেশে দেশে প্রাপ্ত স্বাধীনতাও ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হচ্ছে। আধিপত্যের কাছে আজ নানাভাবে পরাজিত স্বাধীনতা। মানবমুক্তির মাধ্যমেই আজ প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ সম্ভব। পুরো বিশ্বে তাই মানুষের সার্বিক মুক্তি ও স্বাধীনতা এখন সময়ের দাবি। এ কাজ করতে পারেন উজ্জীবিত, সচেতন মানুষদের নিয়ে উদয়ন পণ্ডিতের মতো নেতারাই। প্রশ্ন হলো, বিশ্ব সমাজে কি উদয়ন পণ্ডিত সৃষ্টি হওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ আছে? সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে, মানবমুক্তির ব্যাপ্তিকে আরও প্রসারিত করতে হলে সমাজকে সম্ভাবনাময় উদয়ন পণ্ডিতদের লালন করতে হবে। বিবেকবান, জনসম্পৃক্ত উদয়ন পণ্ডিতদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার বাধা দূর করে দিতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে কি সাড়া দেবে বিশ্বের শুভবুদ্ধির সম্পন্ন শাসক ও নাগরিক সমাজ?