হিরোশিমা আজও কাঁদায়
হিরোশিমা। ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ানো জাপানের এক আধুনিক শহর। যুদ্ধ ও যুদ্ধের ভয়াবহতা কল্পনা করলেই যে নামটি সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটি হলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের নিষ্ঠুর হামলার শিকার এই হিরোশিমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন এখনো মুছে যায়নি হিরোশিমা থেকে। তাই কালের সাক্ষী হিরোশিমা ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
স্কুলজীবন থেকেই হিরোশিমা নামটির সঙ্গে পরিচিত। আর হিরোশিমা নিজ চোখে দেখার ব্যাকুলতা তখন থেকেই। জাপানে আসার প্রায় এক বছর হলেও মাত্র কয়েক দিন আগে হিরোশিমা ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। ফুকুওকা শহর থেকে হিরোশিমার দূরত্ব প্রায় ২৮০ কিলোমিটার হলেও শিনকানসেন অর্থাৎ বুলেট ট্রেনে মাত্র দেড় ঘণ্টায় হিরোশিমায় পৌঁছলাম।
স্বাভাবিকভাবেই কল্পনায় হিরোশিমা ছিল এক ধ্বংসযজ্ঞের ছবি। কিন্তু হিরোশিমা শহরের সুউচ্চ সব আধুনিক ভবন ও চাকচিক্য দেখে বিশ্বাস করাই মুশকিল, এই শহরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে পারমাণবিক বোমার আঘাতে মৃত্যুপুরী ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। স্টেশন থেকে সরাসরি চলে যাই হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে। পার্কে ঢুকতেই প্রথমেই চোখে পড়ে অ্যাটমিক বোম ডোম যা পারমাণবিক বোমার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
পিস মেমোরিয়াল পার্কেই রয়েছে পারমাণবিক বোমার আঘাতে নিহত শিশুদের স্মরণে নির্মিত চিলড্রেন'স পিস মনুমেন্ট, মেমোরিয়াল সেনোটাফ, মেমোরিয়াল হল ও পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম।
দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষণ হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুঁটিনাটি নানান নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে। একজন দর্শনার্থীর উৎসুক মনের সকল প্রশ্নেরই উত্তর মেলে এই মিউজিয়ামে। পারমাণবিক বোমা হামলায় বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মানুষের মর্মস্পর্শী অনুভূতিগুলোর ভিডিও দেখার ব্যবস্থাও আছে এখানে। বেঁচে যাওয়া এসব মানুষের দুঃসহ স্মৃতিচারণ যে কাউকেই অশ্রুসিক্ত করবে।
হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কের পরিপাটি পরিবেশ ও নান্দনিকতা দেখে কে বলবে, এই জায়গাটি মুহূর্তের মধ্যেই লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে। তাই হিরোশিমা শুধু একটি শহরই নয়। এটি একটি দর্শনও বটে। শোককে কীভাবে শক্তিতে পরিণত করতে হয় হিরোশিমা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হিরোশিমা কী শুধু তার বাহ্যিক অবয়বই বদলিয়েছে? অবশ্যই না। এই হিরোশিমাই বদলে দিয়েছে জাপানিদের জীবন, দর্শন, মনন ও দৃষ্টিভঙ্গি। যে বয়সে আমি হিরোশিমা কিংবা পারমাণবিক বোমার নামই শুনিনি, সেই একই বয়সে আমার ছেলে শুধু হিরোশিমা দেখার সুযোগই পায়নি, বরং যুদ্ধকে ঘৃণা করতেও শিখেছে এখান থেকে। আর হিরোশিমা ঘুরে এসে এটাই আমার পরিতৃপ্তি।
মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও শিক্ষার্থী, কিউশু ইউনিভার্সিটি, জাপান।