
বৃহত্তর সিলেট তথা বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের মরমি সাধক কবি এবং বাউল শিল্পী ছিলেন হাসন রাজা। তাঁর প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রাজা। মরমি সাধনা আর আঞ্চলিকতার দর্শন চেতনার সঙ্গে সংগীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছেন তিনি। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, এর প্রধান পথিকৃৎ লালন শাহ। তবে দর্শন চেতনার নিরিখে লালনের পর যে উল্লেখযোগ্য নামটি আসে, তা হাসন রাজার।
১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর তৎকালীন সুনামগঞ্জের তেঘরিয়া পরগণার লক্ষণশ্রী গ্রামে জন্ম হয় হাসন রাজার। তাঁর বাবা ছিলেন দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী, মাতা হরমত জাহান বিবি। হাসন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন। তাঁদের আদি বাস ছিল অযোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তাঁরা দক্ষিণ বঙ্গের যশোর জেলার অধিবাসী ছিলেন। সিলেটে তখন আরবি আর ফার্সির চর্চা বেশ ছিল। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অনেক দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন।
মাজহারউদ্দীন ভূঁইয়া বলেন, হাসন রাজা দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। চারি হাত লম্বা দেহ, উঁচু ধারালো নাসিকা, পিঙ্গল চোখ মাথায় বাবরি চুল—তাঁকে দেখে ইরানি সুফি কবিদের একখানা চেহারা চোখের সামনে ভাসত। হাসন রাজা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ সরল আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান লিখে নিজেই সুরারোপ করেছেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী এক শৌখিন জমিদার, তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া’। বর্ষা মৌসুমে বজরা (বৃহৎ নৌকা) সাজিয়ে নৃত্যগীতের ব্যবস্থাসহ তিনি চলে যেতেন এবং বেশ কিছু কাল ভোগবিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখতেন। এরই মধ্যে তিনি প্রচুর গান রচনা করে ফেলেন, এসব গান নৃত্য এবং বাধ্য সহকারে গাওয়া হতো। আশ্চর্যের বিষয় হল, এসব গানে তাঁর নিজের জীবনের নৈতিকতা সম্পর্কে, ভোগবিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এক সময় নিজের মধ্যে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করেন।
হাসন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে এক আধ্যাত্মিক পরিবর্তন তাঁর স্বপ্ন ও জীবন দর্শনে আমূল প্রভাব ফেলে দিল। তাঁর মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগল। তাঁর চরিত্রে এল এক শান্ত ভাব। বিলাসী জীবন ছেড়ে তিনি সাদামাঠা জীবন বেছে নিলেন। জমকালো পোশাকের পরিবর্তে সাধারণ পোশাক পরতে এবং বিগত জীবনের ভুলভ্রান্তি তিনি শোধরাতে লাগলেন। একপর্যায়ে তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নামরে, না করলাম তার কাম।’ তাঁর বহির্জগৎ ও অন্তর্জগতে এল বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তাঁর এক ধরনের অনীহা, এক ধরনের বৈরাগ্য তৈরি হল।
হাসন রাজা আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হলেন, আর রচনা করতে লাগলেন গান, সব গানেই যেন প্রকাশ পেতে লাগল সৃষ্টিকর্তার অপরূপ মহিমার বর্ণনা। তিনি সম্পূর্ণ বদলে গেলেন, মানুষ প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে পশু-পাখির প্রতিও তিনি সদয় হলেন। পশু-পাখি হত্যা বন্ধ করে দিলেন। কুরা (পাখি) শিকার তিনি ছেড়ে দিলেন, ডাকসাইটে হাসন রাজা এককালে উচ্চণ্ড হাসন নামে পরিচিত ছিলেন। এবার হয়ে উঠলেন নম্র হাসন। তাঁর গানে আক্ষেপের সুর ধ্বনিত হয়ে উঠল। তিনি গাইলেন, ‘এ যৌবন ঘুমেরই স্বপন/সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন।’
পরিণত বয়সে হাসন রাজা তাঁর সব বিষয় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ জীবনযাপন শুরু করেন। তাঁর উদ্যোগে হাসন এম ই হাই স্কুল, অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আখড়া নির্মিত হয়।
হাসন রাজার চিন্তা-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর গানে। তিনি কত গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তাঁর রচিত ‘হাসন উদাস’ গ্রন্থে ২০৬টি গানের হিসাব পাওয়া যায়, আল-ইসলাহ পত্রিকায় কিছু গান ছাপা হয়েছে। জানা গেছে, হাসন রাজার উত্তর পুরুষদের কাছে তাঁর গানের অনেক পাণ্ডুলিপি রক্ষিত আছে। ‘হাসন বাহার’ নামে তাঁর আরেকটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। সৈয়দ মুর্তজা আলীর ‘মরমি কবি হাসন রাজা’ রচনায় বলা হয়েছে, তিনি এক জায়গায় হাসন রাজার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, হাসন রাজা সুনামগঞ্জের একজন মুকুটহীন রাজা ছিলেন। হাসন রাজা সম্পর্কে বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, রাজা সুলভ সত্তায় একটি অতি কোমল দয়ালু মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জের আরেক প্রথিতযশা সাহিত্যিক গবেষক আবদুল হাই রচনা করেছেন ‘হাসন পছন্দ’ নামে একখানা গ্রন্থ।
ইদানীং হাসন রাজার উত্তর পুরুষদের অনেকের লেখার মধ্যে হাসন রাজা সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। হাসন রাজা মিউজিয়ামের মহাপরিচালক তাঁরই একজন উত্তরসূরি সামারীন দেওয়ান এক বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে তাঁর স্মৃতিকে ধারণ করে ইতিমধ্যেই দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন ‘এক নজরে হাসন রাজা’ ও ‘সুর তরঙ্গে হাসন রাজার গান’। আমরা তাঁর মহান উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
হাসন রাজা রচিত কিছু হিন্দি গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়। মরমি গানের ছকবাঁধা বিষয়কে অনুসরণ করেই হাসন রাজার গানগুলো রচিত। কোথাও নিজেকে দীনহীন বিবেচনা করেছেন, আবার তিনি যে অদৃশ্য কারও হাতে বাঁধা সেটাও ফুটে উঠেছে। যেমন, ‘গুড্ডি উড়াইল মোরে মৌলার হাতে ডুরি’। কোনো কোনো জায়গায় হিন্দু ও মুসলিম যুগল পরিচয় তাঁর গানে পাওয়া যায়। অনেকের ধারণা, কয়েক পুরুষ আগে হাসন রাজার পরিবার হিন্দু ছিলেন বলেই তাঁর গানে এমনটি পাওয়া যায়। হাসন রাজার মরমি লোকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ঠাঁই ছিল না, তাই একদিকে আল্লাহর প্রেমে কাতর হাসন, অন্য দিকে শ্রীহরির বন্দনা গাইতেও বাধা ছিল না। কখনো হাসনের হৃদয় কান্নায় আপ্লুত হয়, ‘কী হবে মোর হাসরের দিন, ভাই মমিন’, আবার পাশাপাশি তাঁর হৃদয় ব্যাকুল হয় এভাবে—
‘দয়াল কানাই, ও দয়াল কানাইরে
পার করিয়া দেও কাঙ্গালিরে।
আবার হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা,
আমি বলি খোদা।’
স্পষ্টতই হাসনের গানে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে, এ বিষয়ে তিনি ছিলেন লালন ও অন্যান্য মরমি কবির সমান মর্যাদা সম্পন্ন।
হাসন রাজা কোন পন্থার সাধক ছিলেন, তা স্পষ্ট জানা যায়নি। কারও মতে তিনি ছিলেন সুফি বাদী। আবার কেউ বলেন, চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। তিনি নিজেকে বাউলা বা বাউল বলে দাবি করতেন। যেমন, ‘বাউলা কে বানাইল রে, হাসন রাজারে বাউলা কে বানাইল রে’। কিন্তু তিনি তো কোনো গুরুর চরণে নতজানু ছিলেন না। বাউলদের নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন বা মতবাদ দেন, তাদের ধারণা হাসন রাজা বাউল ঘরানার লোক নয়। ঐতিহ্যগত বাউল যাঁরা, তাঁরা কোনো গুরুর শিষ্যত্ব মেনে চলেন; তাঁদের কোনো ঘরবাড়ি সংসারের প্রয়োজন নেই, পুরুষ-মহিলা বাউল সবাই বিভিন্ন আখড়ায় জীবনযাপন করেন। তাঁদের কোনো ধর্ম নেই, গুরুই তাঁদের সব। কুষ্টিয়ায় লালন শাহর মাজারে যেসব বাউলের সন্নিবেশ ঘটে, তাঁদের কথাবার্তা চালচলনে বাউলিয়ানার পরিচয় সুস্পষ্ট।
হাসন রাজার গানে সুফিবাদের সঙ্গে দেশীয়ত মরমি ধারা ও নিজস্ব চিন্তা-দর্শনের সমন্বয়ে তাঁর সাধনার পথ নির্মিত হয় বলে অনেকে মনে করেন। হাসন রাজার গানেও তাঁর চিন্তা দর্শনে অনেক আঞ্চলিক বুলি ব্যবহারে লক্ষ্য করা যায়। যেমন, ‘আঙ্গে আর ডাঙ্গে/স্বামীর সেবা না করিলে ধরাইবনি লাঙ্গে (অবৈধ পুরুষ বন্ধু)’, ‘চক্ষু মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে’, ‘হাড় খাইল হাড়ুয়া পুকে, মাড়ইল খাইল ঘুনে, যৌবনের গুমানে’, ‘বিষম উন্দুরায় লাগাল পাইল/উগার বইরা থইলাম ধান খাইয়া তুষ বানাইল’।
হাসন রাজার কিছু গান গ্রামীণ ছোঁয়া পাওয়া যায়—এমন কয়েকটি গানের উদাহরণ—‘বুড়ি বড় হারামজাদা, ডাকে মোরে দাদা দাদা’,‘লাঙ্গের সঙ্গে মন মজাইয়া হারাইলায় নিজ পতি’, ‘মুতিয়া দে তোর বাপের মুখে, তার মুখে দে ছাই’। আবার হাসন রাজার কোনো কোনো গানে স্থান-কাল-পাত্রের পরিচয় চিহ্নিত আছে। যেমন, ‘কোথায় রইব লক্ষণছিরি সাধের রামপাশা’— এতে তাঁর জন্মগ্রাম ও জমিদারি এলাকার কথা বারবার এসেছে। কোনো কোনো গানে প্রসঙ্গ হিসেবে নিজেই উপস্থিত হয়েছেন।
দিলারাম নামে হাসন রাজার এক পরিচারিকা তাঁর গানে মাঝে মাঝে উপস্থিত হয়েছেন—‘ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর/হাসন রাজারে বান্দিয়া রাখ দিলারাম তোর ঘর’ কিংবা ‘তোমরা শুনছনি গো সই/হাসন রাজা দিলারামের মাথার কাঁকই।’
যুগ যুগ ধরে হাসন রাজার গান গেয়ে স্থানীয় তথা বাংলাদেশের শিল্পীরা সংগীতে হাতে খড়ি নিচ্ছেন। স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যে প্রয়াত উজির মিয়া, আবদুল লতিফ, এমরান আলীসহ আরও অনেকে সফল শিল্পী হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে সেলিম চৌধুরীর কণ্ঠে হাসন রাজার গান দেশে ও প্রবাসে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। হাসন রাজা মুখে মুখে গান রচনা করতেন আর তাঁর সহচর, নায়েব-গোমস্তারা তা লিখে রাখতেন। তাঁর স্বভাবকবিত্ব এসব গানের জন্ম দিত, সংশোধনের সুযোগ খুব একটা মিলত না। তাই ছন্দ পতন ও শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতা লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য এই ত্রুটি সত্ত্বেও হাসন রাজার গানে অনেক উজ্জ্বল পঙ্ক্তি, মনোহর উপমা চিত্রকল্পের সাক্ষাৎ মেলে। তাঁর কিছু গান বিশেষ করে ‘লোকে বলেরে ঘর বাড়ি ভালা নাই আমার’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’,‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল’, ‘মরণ কথা স্মরণ হইল না, হাসন রাজা তোর’, ‘কানাই তুমি খেইল খেলাও কেনে’,‘একদিন তোর হইবে রে মরণ রে হাসন রাজা’—এসব গান শুধু সমাদৃত ও জনপ্রিয় নয়, সংগীত সাহিত্যে বিরাট মর্যাদার স্থান দখল করে আছে।
১৯২৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভারতে দর্শনের ওপর এক আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসন রাজার গানে বিরাট দর্শন তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাসন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তাঁর দর্শন চিন্তার পরিচয় তুলে ধরেন। ভাষণে হাসন রাজা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত হলো,
পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির [হাসন রাজা] গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই— ব্যক্তি স্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য।
মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়া ঠান্ডা
গরম নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়।
এই সাধক কবি দেখিতেছেন,শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়ন পথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনিভাবে বলেছেন, যে পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আদিত্যমণ্ডলে অধিষ্ঠিত।
রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে।
উপসংহারে অনেক বলার থাকে, কিন্তু এই মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজা অবশ্যই একজন ক্ষণজন্মা সাধক গীতিকবি ছিলেন, যাঁর বিশালতা সম্পর্কে বর্ণনা করা দুরূহ। এই মরমি কবি ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর মাত্র ৬৭ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।