হারিয়ে যায় আপন মানুষ
একজন মানুষ তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই এত ভালোবাসার মানুষটি না পেলে তোমার জীবন বৃথা। অথচ সেই মানুষটি একদিন হুট করে চলে গেলে তুমি নিজে ভেবে পাও না, এত ভালোবাসার মানুষ কীভাবে ছেড়ে গিয়ে ভালো থাকে!
কিন্তু মনে রেখো, যে তোমাকে খুব বেশি ভালবাসতে পারে, সে আবার খুব সুন্দর করে তোমাকে ভুলে দিব্যি অন্য কাজে, অন্য ভুবনে ব্যস্ত থাকতে পারে। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। তুমি এক দিন যেমন তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলে, আবেগ, মোহ, ভালোবাসা সবটুকু ধীরে ধীরে কমতে থাকলে তার জগতে তুমি আর প্রিয় কেউ নও।
একটি সত্যি কথা কি জানো, ভালোবাসা সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিক হারে কমে। কথা বলা ধীরে ধীরে কমে যায়। অল্পস্বল্প ব্যস্ততার বাহানা একজনের ক্ষেত্রে চলে আসে। তুমি হয়তো সারা দিন অপেক্ষা করবে, কখন তাঁর ব্যস্ততা শেষ করে তোমাকে ফোন দেবে, মেসেজ লিখবে।
অথচ উত্তর তো দূরের কথা, তোমার মেসেজ দেখার সময়টুকুও তাঁর থাকে না। কখনো যদি দেখেও, তবে উত্তর দেয়, খুব ক্লান্ত আজ আর কথা হবে না।
তুমি হয়তো তখন কিছুই বলতে পারো না। চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়, রুমের টিকটিকি সাক্ষী হয় তোমার নীরবতায়। ধীরে ধীরে তখন প্রেমে অসুখে ধরে, তারপর এক দিন হুট করে সে নাই হয়ে যায়। এটিই সত্যি, এটিই বাস্তব।
এই চরম বাস্তবতাটুকু মানতে পারলে তুমি হয়তো সামনে যেতে পারবে। না হয় একযুগ চলে যাবে কেবল ভেবে ভেবে—এত ভালোবাসার পর আসলে কেউ মানতে চায় না, মানুষটা ছেড়ে যেতে পারে। নিশ্চয় এমন কোনো কারণ ছিল, যার জন্য সে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সে কারণ তুমি আর খুঁজে পাও না।
কিন্তু সত্য হলো, বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে জোরালো কোনো কারণ থাকে না। স্রেফ আগের মতো আর তোমাকে ভালো লাগে না। এটা মুখে না বললেও এটুকু বুঝতে হবে, তুমি তার হৃদয়ে আলোড়ন তোলার আপাতত কেউ নও। কারও কারও জীবনে একজন মানুষ তুমুল ভালোবাসা নিয়ে আসে, অল্প দিনে একজনমের ভালবাসার স্বাদ দিয়ে হুট করে একদিন চলে যায়। তখন আর একজনমের স্বাদ পরিবর্তন হয়ে একজনমের কষ্টে রূপান্তরিত হয়। মানুষ কাছে আসে, মায়া লাগিয়ে দূরে যাওয়ার জন্য, মানুষ কাছে আসে, আবেগ আর ভালোবাসা যাচাই শেষে নিজের ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিয়েই দূরে সরে যাওয়ার জন্য।
ছোট্ট করে একটি গল্প বলি, রুমাকে আমি চিনতাম আমার বোনের বান্ধবী হিসেবে। রুমার বয়স যখন বিশের কাছাকাছি, সে সময় থেকেই সে নিজেই একজন উদ্যোক্তা। সিলেট শহরে তখন তারই মালিকানায় একটি ফ্যাশন হাউস ও অন্য একটি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যে মেয়ের রাতদিন সময় ছিল না, সে এক দিন এক ফেক আইডির হাই, হ্যালো থেকে অল্প অল্প কথাবার্তা, তারপর ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ে যায় কুমিল্লার একটা ছেলের সঙ্গে। তারপর থেকে তাদের দৈনন্দিনের একটা দীর্ঘ মুহূর্ত ফোনের দুই প্রান্তে কাটে। দেখা গেল, দিনের বেশির ভাগ সময় পরস্পরের কাছাকাছি থাকে মুঠোফোনে। দিন দিন ভালোবাসার ব্যাপ্তি এতই বেড়েছে, সেখান থেকে ফেরার দুজনের জন্য প্রায় অসম্ভব। মেয়েটির জগৎজুড়ে তখন একজনই। এক দিন ছেলেটি কুমিল্লা থেকে সিলেট এল, সারাদিন দুজনে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে। হাতে হাত রেখেছে, কপালে ভালোবাসার স্মৃতিচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। আগামীর স্বপ্নে বিভোর হতে হতে সেদিন দুজন বাড়ি ফিরে এসেছিল। কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না, আবেগ কমে যায় একজনের। ফলে বিচ্ছেদের পথে কেউ একজন হেঁটে যায় আপন গতিতে। এটাই হয়। হুট করে আসা প্রেমে এমনই হয়।
ঠিক তার পরের দিন থেকে ছেলেটির ফোন দেওয়া, ফোন ধরা কোনোকিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না। মেয়েটির অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। ছেলেটি সারা দিনরাত অনলাইনে পড়ে আছে। জ্বলজ্বল করে সবুজবাতি জ্বলছে মেসেঞ্জারে, তবু সে কোনো মেসেজ দেখছে না। প্রতিদিন ১০০ বার ফোন দিলে সে দু–একবার ফোন তুলে ব্যস্ততার বাহানা দিত। কিন্তু মেয়েটি এত ভালোবেসে ফেলেছিল যে সেখান থেকে ফেরা তার প্রায় অসম্ভব। এরই মধ্যে মেয়েটি ডিপ্রেশনে পড়ে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছায়। জানার পর একবারও ছেলেটি খোঁজ নেয়নি। দু–একবার আত্মহত্যার চেষ্টা বিফলে গেছে পারিবারিক তদারকির কারণে। যদি পরিবার পাশে না থাকত, তবে হয়তো সে একটা ভুল করেই বসত।
ছেলেটি কথায় কথায় একবার বলেছিল, যদি একদিন আমি হারিয়ে যাই, তবে তুমি কুমিল্লা এসে আমাকে খুঁজো। হয়তো আমি সেদিন পৃথিবীতে সেরা একজন সুখী মানুষ হব। মেয়েটি তার পরের দিন হাসপাতাল থেকেই এসেই কুমিল্লা চলে যায় একজনকে সঙ্গে নিয়ে। সারা দিন অনেক ফোন, মেসেজ, সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে ক্লান্ত হয়ে গোমতী নদীর তীরে বসে হাউমাউ করে কাঁদে। দেখা হয় না, ছেলেটি আর দেখা করে না। সে এই শহরেই আছে, অথচ মেয়েটির জন্য হারিয়ে গেছে একেবারে। এই সত্য মেনে নেওয়া তার জন্য সীমাহীন কষ্টের। মেয়েটি ফিরে আসে এক বুক হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে।
আজও মেয়েটি মানতে পারে না, এত ভালোবাসা দেওয়ার পরও কেন সে চলে গেল? কী কারণ ছিল, আজও তার জানা হয়নি। ছেলেটি রেশমি চুড়ি কিনে দিয়েছিল শেষ দেখার দিন। প্রতিদিনকার ড্রেস পর্যন্ত ছেলেটি পছন্দ করে দিত। মেয়েটির দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি স্তরে মিশে গিয়েছিল ছেলেটি। আজও মেয়েটি চুড়িগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছে।
মেয়েটির একটাই কথা, সেই থেকে আমি দিনদিন একটু একটু করে মরছি। যদি চলে যাওয়ার কারণ বলে যেত, তবে বোধ হয় বেঁচে থাকা বেশ সহজ হতো।
এক দিন মেয়েটি আবিষ্কার করে, ছেলেটি এর কিছুদিন পর দিব্যি আরেক মেয়েকে বিয়ে করে সুখে আছে। নতুন সংসারজুড়ে ফুটফুটে একটি সন্তানও এসেছে। অথচ তার জীবনে আর কোনো পরিবর্তন আসেনি। দিনদিন মেয়েটি ভয়াবহ ডিপ্রেশনে চলে যায়। ফিরে আসতে তার দীর্ঘ সময় লেগেছিল। অতঃপর তার বিয়ে হয়। সংসার হয়, তবু আজও সেই ছেলের হারিয়ে যাওয়ার কারণ খোঁজে। যদি কারণ বলে যেত, তবে তার সামনের দিনগুলোতে নিজেকে পরিবর্তন করতে সুবিধা হতো। আফসোস, সে কারণ তার আর জানা হয় না। এখন সে সুখী না অসুখী, তা নিজেই জানে না। সংসার করা দরকার তাই করছে।
গল্পটি শুনেছিলাম গতবার দেশে গিয়ে। খারাপ লাগল, এভাবেই একজন মানুষ জীবনের সবটুকু ভালোবাসা নিয়ে আসে হুট করে, তারপর হুট করে চলে যায়। যাওয়ার নির্দিষ্ট কারণ পর্যন্ত বলে যায় না। যারা অতিরিক্ত ভালোবেসে নিঃস্ব হয়, তাদের গল্পগুলো এমনই হয়।
একটি কথা জানেন, স্রষ্টার চেয়ে আপনি যখন কাউকে বেশি ভালোবাসবেন, সেই মানুষটি আপনার জীবনে থাকবে না। খুব বেশি ভালোবাসাই মানুষকে অতিরিক্ত রকম একা করে দেয়।
হেমন্তের সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে জ্বলে থাকা কোনো নক্ষত্র তো আলো ঠিকঠাক দেয়, তবু মানুষটি হারিয়ে যায়। নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে আর জ্বলে তার বুকে।
হেমন্তের বিকেল বড্ড স্বল্পায়ু। শুরু হয়েই ফুরিয়ে যেতে চায়। কিছু ভালোবাসা ঠিক সেরকম স্বল্পায়ু। শুরু হয় তুমুল ভালোবাসা দিয়ে, আর দ্রুত শেষ হয়ে যায় কোনো একজনের। মাঝেমধ্যে ফুরিয়ে যাওয়া এসব বিষণ্ন বিকেল কি সন্ধ্যার অন্ধকারে কষ্ট লুকাতে যায়?
জানি না। তবুও জীবন চলে যায় এভাবেই পাওয়া না পাওয়ার মাঝে।
‘কেন প্রেমে এত সুখ
কেন প্রেমে এত যন্ত্রণা
কেন হারিয়ে ফেলার এত বুক ভরা আর্তনাদ
কেন কাছে পেয়েও হারানোর বিষাদ।’
তার উত্তর বোধ হয় কারও কাছে নেই।