মেয়েটি বসে আছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের লম্বা বেঞ্চের এক পাশে। বারবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। পরনের জামাকাপড় এলোমেলো। চোখেমুখে রাত জাগার স্পষ্ট ছাপ। ডান দিকে কাকে যেন দেখল মেয়েটি। হাসছে মৃদু। হাসপাতালের একজন কর্মচারী বাংলাদেশি আমেরিকান। কাজ করছেন প্রায় বছর চারেক। তিনি চেনেন মেয়েটিকে। গত শীতে প্রচণ্ড বরফঝরা রাতে মেয়েটিকে প্রথম দেখেন। দুপুর থেকে সারাক্ষণ বসা দেখে তাঁর কৌতূহল হলো। পাশে গিয়ে শোনেন, সেলফোনে কথা বলছে বাংলায়। পাশাপাশি কাঁদছে অবিরাম। কিছু জিজ্ঞেস করবেন বলে ভাবছেন। সঙ্গে ভয়ও হচ্ছে, যদি রাগ করে বলে আপনি কে? এত কিছু জিজ্ঞেস করছেন কেন? খানিকক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করলেন খাঁটি বাংলায়। আপনার কী অসুবিধা? মেয়েটি অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ আমার অসুবিধা আছে। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন? হাসপাতালের পুরোনো কর্মচারী মেয়েটিকে আশ্বস্ত করে বললেন, হ্যাঁ বলুন, কী অসুবিধা? আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। তবে আজ সব শুনতে পারব না। ডিউটি শেষ। কাল কি আসতে পারবেন এখানে? আমি সকালে ডিউটির আগে চলে আসব।
ভদ্রলোকের কথা শুনে মেয়েটি বলে উঠল, আসব মানে, আমি তো রাতদিন এখানেই থাকি। আমার তো থাকার বা যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শুনে তাঁর মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। কী করবেন, না বুঝে বলে দিলেন, ঠিক আছে সকালেই কথা হবে। পরদিন সকালে তিনি চলে আসেন ডিউটির ঘণ্টা দুয়েক আগেই। শুনলেন সব নীরবে। মেয়ের নিজের মুখে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের এক বৃহত্তর জেলার মেয়ে। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। মা পুরোপুরি গৃহিণী। চাচার আবেদনে অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসা প্রায় দুই যুগ আগে। বাবা-মা ছাড়া সঙ্গে ছোট বোন এবং কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ুয়া বড় ভাই। ভিসা হওয়ার পর সবাই আনন্দে ভাসছে। আমেরিকায় যাবে পুরো পরিবার। হঠাৎ করে গোটা পরিবারের পরিচিত সব মহলে দাম বেড়ে গেল। বাসায় আত্মীয়স্বজন আসছেন। খোঁজ নিচ্ছেন। উপদেশ দিচ্ছেন। অভয় দিচ্ছেন। টেনশন না করার জন্য বাবাকে বারবার অনুরোধ করছেন। মনে হলো, আমেরিকার ভিসা যেন সোনার কাঠি। ছুঁইয়ে দিতেই সব আপনা-আপনি বদল হতে শুরু হলো।
সবাই বদলে গেলেও একজন মোটেই বদলালেন না। তিনি হলেন মা। দেখে মনে হলো, আমেরিকায় চলে যাবেন শুনে মুষড়ে পড়েছেন। বাবাকে বললেন, তিনি যাবেন না আমেরিকায়। বাবা রেগে বলেন, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? আমরা কি আমেরিকায় আমাদের জন্য যাব? যাব তো ছেলেমেয়েদের জন্য। জবাবে মা নীরবে বললেন, তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমার উদয়ন! ওর কী হবে? মায়ের কথা শুনে বাবা হেসে বললেন, তুমি কী যে বল! উদয়নকে কোথাও কোনো অনাথ আশ্রমে রেখে যাব। ব্যস। বাবার কথা শুনে মা চিৎকার দিয়ে উঠলেন। না, আমি তা পারব না। বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন মা। হাসতে হাসতে বাবা বলছেন, ও তোমার কী? পিতৃপরিচয়হীন এক পাগলির সন্তান। সে তোমার কীভাবে হলো। কী যে বলো না! মা তখন চিৎকার দিয়ে বলছেন, অবশ্যই উদয়ন আমার। ওর জন্ম হয়েছে আমার ঘরের বারান্দায়। ওই জন্মান্ধ ও পঙ্গু শিশুকে আমি মায়ের মমতা দিয়ে লালন করেছি। কার কাছে রেখে যাব এই অসহায় শিশুকে?
সরকারি চাকুরে বাবা-মায়ের চিৎকার করে কান্নাকাটি শুনে নির্বাক তাকিয়ে শিশুটি। মুখে কোনো শব্দ নেই কারও। আলাপ করে ঠিক হলো, মা-বাবা দুজন আসবেন আমেরিকাতে। উদয়নকে রেখে আসা হবে বাবার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ার কাছে। আত্মীয়াকে বাসায় আনা হলো ১৫ দিন আগে। মা সব দেখিয়ে দিলেন। কীভাবে লালন করতে হবে উদয়নকে। সঙ্গে সারাক্ষণ বলছেন, বুবু, আল্লাহর দোহাই। কোনো মতেই যেন আমার উদয়ন কষ্ট না পায়। সব উৎকণ্ঠাকে মাথায় নিয়ে গোটা পরিবার এসে উঠল নিউইয়র্কে চাচার বাসায়। ছোট দুই রুমের বাসা। এক মাস যেতে না যেতেই মায়ের অবিরাম কান্না। তিনি নাকি শুনেছেন, বাবার আত্মীয়া উদয়নকে ভালোমতো দেখাশোনা করছেন না।
বাবা দুদিনের পার্টটাইম কাজ শুরু করেছেন মাত্র। নিজেদের খরচই হয় না। তার ওপর মায়ের বায়না। দেশে ফেরতের তাগাদা। মায়ের চাপাচাপিতে বাবা ঋণ করে মাকে দেশে পাঠালেন। বিমানবন্দরে মায়ের কী খুশি। আপন তিনটি সন্তানকে বিদেশে রেখে যাচ্ছেন। সেদিকে কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ পালিত এক অসহায় সন্তানের জন্য কত টান। চলে গেলেন মা।
মাস চারেক গাদাগাদি করে থেকে উঠলাম এক রুমের অ্যাপার্টমেন্টে। আমরা দুবোন রুমে। বাবা আর বড় ভাই সিটিং রুমে। বাবা কাজ নিলেন এক শপিং মলে। ভাই কলেজ শুরু করে কাজ নিল প্রথমে ডানকিনে। পরে অন্যত্র। বাসায় আমি ও আমার ছোট বোন। মা দেশে রয়ে গেলেন উদয়নকে নিয়ে। দুই বছর দেশে থাকার অনুমতি ছিল। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বাবার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও এ দেশে আর এলেন না। অভিবাসী আইনে গ্রিন কার্ড বাতিল হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আমার ও ভাইয়ের কলেজ শেষ হলো। ভালো কাজের জন্য দৌড়াচ্ছি। একদিন ভাই এসে বলল, সে কাজ পেয়েছে। তবে তা টেক্সাসে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে শুধু বললেন, তোমরা যা ভালো মনে হয় কর। আমার কোনো সমস্যা নেই। হ্যাঁ, বাবার কথাই সত্য হলো। বাবার আর কোনো সমস্যা হলো না। এক বছরের মাথায় শেষ রাতে বাবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টাকে বিদায় জানিয়ে তিন দিন পর বাবা চলেন গেলেন। শুরু হলো দুই বোনের সংগ্রামী জীবন। বাবার জমানো টাকা দিয়ে দুই মাসের ভাড়া শোধ করে দুই বোন উঠলাম অন্য এক পরিবারের সঙ্গে।
সবাই জানে, আমাদের মা আছেন, ভাই আছেন। অথচ বাস্তব চিত্র ঠিক তার উল্টো। ভাই ব্যস্ত তার কাজ ও বিদেশি বাগ্দত্তাকে নিয়ে। মা ঢাকার বাসা ভাড়া দিয়ে উদয়নকে নিয়ে এক রুমে ভালোই আছেন। উদয়ন বড় হয়েছে। ওকে লেখাপড়া করানো, বাইরে নিয়ে যাওয়া; মায়ের এখন শুধু একটি মাত্র কাজ। উদয়নকে দেখাশোনা করা। অভিমানে সব মেনে নিয়েছি এই ভেবে যে মা তো আমাদের ছেড়ে বাবাকে হারিয়ে সুখেই আছে।
বোনটিকে বললাম পড়াশোনা কর। আমি যেভাবে পারি চালিয়ে নেব। ভাইটির ফোনকলের সংখ্যা কমতে কমতে একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। শেষবার বলেছিলাম, ভাই, আমি আর পারছি না। চলে আসি তোমার কাছে। এরপরই সব যোগাযোগ বন্ধ। আশা করলাম বোনটির ওপর। সেও শেষে নিরাশ করল। আমেরিকান পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেল বাংলাদেশে তার এক ফেসবুক বন্ধুকে বিয়ে করতে। বাকিতে টিকিট করে দিলাম। তখনো বলছে, মাকে দেখতে যাচ্ছে। সব মিছে কথা। হতবাক হতে হতে নির্বাক হয়ে গেলাম।
খবরটি আর গোপন রইল না। বাড়িওয়ালা ডেকে সব জানতে চাইলেন। সরল বিশ্বাসে কোনো কিছু গোপন না করে সব বলে দিলাম। জানতে চাইলেন, এই মুহূর্তে আমার কী পরিকল্পনা। কী বলব আমি! দিগ্ভ্রান্ত আর দিশেহারা হয়ে বসে আছি। তবুও বললাম। চাচা, কয়দিনের জন্য মায়ের কাছে চলে যাব। উত্তরে বললেন, তাই ভালো হবে। আগামী মাসে আমার এক আত্মীয় দেশ থেকে এসে আমার বাসায় উঠবে। ভাবছি তোমরা যে রুমে থাকো, সেটাই ওদের দিয়ে দেব। তুমি তো চলেই যাচ্ছ তোমার মায়ের কাছে। আমার মাথা টলে গেল। ওটি ছিল আমার শেষ আশ্রয়। এখন আমি কোথায় যাব। দেশে তো যাওয়াই হবে না।
বাংলাদেশের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ অনেক আগে। নতুন পাসপোর্ট কীভাবে নিতে হয়, তাও যেমন জানি না। তেমনি জানি না কোথায় গেলে তা পাব। আমেরিকান নাগরিকত্ব নেব নেব করে নেওয়া হয়নি। বেতনের টাকা পেলে টেনেটুনে বাড়িভাড়া জোগাড় করে দুদিন পর কারও কাছে হাত পাতো। ফির পয়সা কোথায় পাব। তাই না হলো আমেরিকান নাগরিকত্ব, না হলো বাংলাদেশি পাসপোর্ট। অনেক কষ্টে জোগাড় করছিলাম একখানা নিউইয়র্ক আইডি। সেটিরও মেয়াদ শেষ।
এক বন্ধুর সঙ্গে বছরখানেক শেয়ারে রইলাম। সেখানেও নানা ঝামেলা। তার জীবনও সুখময় নয়। বিয়ে করে এসেছিল আমেরিকায়। শুরু থেকেই সে জানত, ওর সঙ্গে ঘর-সংসার হবে না। তারপরও ভাবল বলা যায় না অনেকই তো জীবনের তাগিদে মত-পথ বদল করে। সে নাকি বদল করেনি। বরং আরও জোরেশোরে নেমে পড়ল নেশার জগতে। পরে আরও অস্থায়ীভাবে দু-এক জায়গায় চেষ্টা করল। কিন্তু কপাল খারাপ। বিনা নোটিশে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি। ফলস্বরূপ স্থানচ্যুতি।
কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। ঠিকানাবিহীন অনিশ্চিত পরবাস জীবন। তখনই দেখা হলো চরম এক অভিজ্ঞতাপূর্ণ রাতের সঙ্গে। সকালে বেরিয়েছি এক সহকর্মীর বাসা থেকে। দুপুর থেকে শুরু তুষারপাত। দিশেহারা হয়ে ভাবছি, এই ঝড়ের রাতে কোথায় যাই। বন্ধু পরিচিতদের ফোন দিলাম। কোনো জবাব নেই। মানে সবাই এড়িয়ে চলছে। বন্ধুদের প্রায় সবাই জেনে গেছে, আমি আশ্রয়হীন, স্বজনহীন একজন নিউইয়র্কার।
জ্যাকসন হাইটস সাবওয়ে স্টেশনে বসা। ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়। হঠাৎ মনে হলো, হাসপাতালে যাই। পাশেই এলমহার্স্ট হসপিটাল। জরুরি বিভাগের সামনে অনেক চেয়ার পাতা। সেখানেই রাত কাটিয়ে দেব। খিদেয় পেট চোঁ–চোঁ করছে। এক ডলারের দুটি নোট সম্বল। হেঁটে হেঁটে চলে এলাম হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।
বাইরে জোরেশোরে বরফ পড়া শুরু। খিদে মেটাতে পুরো এক বোতল ট্যাপের পানি খেলাম। সব বন্ধ। দোকানপাট, ফুডকার্ট মানে খাবারের গুমটি ঘরসহ সবকিছু। আর খোলা থাকলেই–বা কী? আমার কাছে তো কোনো ডলার সেন্ট কিছুই নেই যে কিনে খাব। হঠাৎ চোখে পড়ল এক কালো লোক কী যেন খাচ্ছে! বসলাম গিয়ে ওর এক চেয়ার পর। কতক্ষণ পর দেখি লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। কেমন যেন ভরসা পেলাম। আরেকবার তাকাতেই সে বলল, হাই ইয়ং লেডি! হাউ আর ইউ? ইউ ওকে?
আমি জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বলছি। ইয়েস আই এম ওকে। সে বলে উঠল, দেখে তো মনে হয় না, মনে হচ্ছে তুমি ক্ষুধার্ত! এসো আমার পাশে। শেয়ার করতে পারো আমার খাবার। অনেক আছে এতে। তাজা ও মজাদার খাবার। চার্চের কিনা! সত্যি, প্যাকেট ভালো করে খুলতে দেখি অনেক খাবার। ব্রেড, সবজি, সেদ্ধ চিকেনসহ আরও অনেক কিছু। কালো লোকটি বলে উঠলে চিন্তা কোরো না। খেয়ে নাও তোমার খুশিমতো। তারপর তুমি আর আমি মিলে অনেক গল্প করব, অনেক গল্প ইয়াং লেডি। বলেই কেমন যেন উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসি দিল। মনে হলো ওর উদ্দেশ্য ভালো নয়। তারপরও আগপিছ না ভেবে পেট পুরে খেয়ে নিলাম।
খাবার পর জরুরি বিভাগের বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে কালো লোকটির পাশে বসলাম। শরীরজুড়ে ক্লান্তির নরম ছোঁয়া। দুচোখে রাজ্যের ঘুম। ভাবছি, ওই এই বুঝি আমার আমেরিকাপ্রবাসী জীবন। যদি কালো লোকটা আমার কাছে আরও কিছু চেয়ে বসে, ওকে কী জবাব দেব? চটজলদি যদি সেই জবাবটা এক্ষুনি জানা যেত! কতই–না ভালো হতো। কিন্তু তা কি সম্ভব?