হত্যা করে তাদের আদর্শ মোছা যায়নি

আব্রাহাম লিংকন,মহাত্মা গান্ধী,শেখ মুজিবুর রহমান

দ্বিতীয় কিস্তি

বঙ্গবন্ধু, আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধীর মতো নেতারা শুভ শক্তির আধার হয়ে চিরকাল মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁদের হয়তো হত্যার মাধ্যমে দৈহিকভাবে অনুপস্থিত করা যায়, কিন্তু জনগণ থেকে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও স্বস্তিতে থাকতে পারে না অশুভ, অন্ধকারের কুশীলবরা। রাতের আঁধারে তাই বারবার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙতে হয়। বারবার দৃশ্যমান স্মৃতিকে ভেঙে বাঙালির হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুকে অদৃশ্য করার অপচেষ্টা চলতে থাকে; যে প্রক্রিয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ মিনারের ওপর বারবার আঘাত আসে ঠিক সে প্রক্রিয়ায়।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর সেই গানের কথার মতো, ‘শহীদ মিনার ভেঙেছ আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা।...’ বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ঠিক এই গানের কথা মতো বাংলার মানুষের হৃদয়ে সূর্যের মতো তেজোদ্দীপ্তভাবে আলো ছড়াতে থাকে। বঙ্গবন্ধু অবিরত বাংলায় ফিরে আসেন, বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে তিনি ফিরেছিলেন দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস কারাভোগের পর। এখন ফিরে আসে তাঁর আদর্শ বারবার আমাদের হৃদয়ে—‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে।’ বঙ্গবন্ধু যেভাবে ফিরে আসেন, ঠিক একইভাবে ফিরে আসে আব্রাহাম লিংকন ও মহাত্মা গান্ধীর মানবিক আদর্শ, বিশ্বমানবের মনের গহিনে।

বাঙালি সংস্কৃতির বিজয় রথকে থামিয়ে রাখতে পারেনি কোনো অপশক্তি। বাংলা ভাষা এখন জাতিসংঘ দ্বারা স্বীকৃত ও সমাদৃত ভাষা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যেমন রোখে দিতে পারেনি বাংলাদেশবিরোধী কোনো শক্তি, বাংলাদেশের উন্নয়নকেও স্তিমিত করতে পারবে না অন্ধকারের অপশক্তির দল। বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথ রোধ করতে যারা চায়, তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত গণতন্ত্রের মৌলবাণী, ‘গণতন্ত্র হলো—জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার’। এ রকম মহৎ পদ্ধতিকে সরিয়ে দিতে বলতে পারবে, কিছু মানুষের, পেশির শাসন, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে অল্পসংখ্যক মানুষের শাসন কায়েম করবে।

‘অসহযোগ’ ও ‘অহিংসা’-এ দুটি প্রত্যয় মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিকভাবে এ দুটি প্রত্যয় আগে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা জানা যায় না, অসহযোগ কোনো কোনো ক্ষেত্রে থেকে পারে, অহিংসা নয়। মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ ব্যবহার করেছেন রাজনীতিতে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত, তবে অসহযোগের ভিত্তি সব সময় রাখতে চেয়েছেন অহিংস। শেষোক্ত প্রত্যয়টির উদ্ভব তার ধর্মবিশ্বাস থেকে। তিনি জৈনধর্ম বিশ্বাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এ ধর্মে কোনো জীবহত্যা অধর্ম। অহিংসা প্রত্যয়টি তিনি প্রথম ব্যবহার করেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। শাসক অত্যাচার করবে সেটির প্রতিবাদ সহিংস হবে না, নির্যাতন সহ্য করে এর অসারতা প্রমাণ করতে হবে। যিশুর বাণীও তা-ই ছিল। গান্ধীজির মতে, ‘অহিংসার অর্থ অন্যায়কারীর কাছে নতি স্বীকার নয়। অহিংসার অর্থ স্বৈরাচারী ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে নির্যাতিতের সমগ্র আত্মার বোধকে উত্থিত করা।’

গান্ধীজি দুটি প্রত্যয়কেই রাজনীতিতে একই সঙ্গে ব্যবহার করতে চেয়েছেন, এককভাবে একটিকে নয়। তিনি এতে পুরোপুরি সফল হননি। তবে, প্রত্যয় দুটিকে রাজনীতিতে প্রোথিত করতে পেরেছিলেন। এই প্রত্যয় পাশ্চাত্যে হাসিঠাট্টার বিষয় হলেও অগ্রাহ্য করেননি কেউ, তবে সাফল্য নিয়ে হয়তো সংশয় ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধী এই প্রত্যয়ের উদ্ভাবন করেন। নেলসন ম্যান্ডেলাও তা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তবে, প্রত্যয় দুটি একজনই সফলভাবে ব্যবহার করেছেন এবং এই উপমহাদেশেই। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশে যিনি পরিচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা শুধু বঙ্গবন্ধু নামে।

এখানে দুজনের তুলনামূলক আলোচনা নয় এবং করা উচিতও নয়, কেননা দুজনের সময় আলাদা। গান্ধীজি যখন প্রত্যয় দুটির উদ্ভাবন করেন, তখন বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছে মাত্র। অসহযোগ আন্দোলনের ঠিক ৫০ বছর পর বঙ্গবন্ধু তা প্রয়োগ করে সফল হন। তখন পৃথিবী বদলে গেছে। এখানে বরং বোঝার চেষ্টা করব, যিনি প্রত্যয় দুটির উদ্ভাবক, তিনি কেন সফল হলেন না। সফল হলেন তিনি, যিনি এই প্রত্যয় উদ্ভাবনের ৫০ বছর পর তা ব্যবহার করেন। গান্ধীর রাজনীতিতে তিনি বড় হয়েছিলেন এবং তাঁকে শ্রদ্ধাও করতেন। কলকাতায় ডাইরেক্ট অ্যাকশনের পর বেলেঘাটায় গান্ধীজি অবস্থান করছেন। তখনকার এক চিত্রে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী গেছেন গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে, সঙ্গে আছেন তরুণ একহারা শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নতুন দিল্লির একটি সুবৃহৎ প্রাসাদ বিড়লা হাউসের প্রাঙ্গণে (এখন গান্ধী স্মৃতি) হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর ঘাতক ছিলেন নাথুরাম গডসে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভার সদস্য এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধাসামরিক স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একজন সাবেক সদস্য। গডসে মনে করেছিলেন, এর আগের বছর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় গান্ধীজি মুসলমানদের পক্ষে খুব বেশি সহায়তা করেছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সন্ধ্যা ৫টার কিছু পরে গান্ধী বিড়লা হাউসের পেছনের দিকে লনে যাওয়ার সিঁড়ির মাথায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে তিনি প্রতি সন্ধ্যায় সর্ব ধর্মের প্রার্থনা সভা পরিচালনা করছিলেন। যেইমাত্র তিনি বেদির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, গডসে ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে গান্ধীর পথের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন এবং পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ (অস্ত্র থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি ব্যক্তিকে সরাসরি আঘাত করতে পারে) থেকে গান্ধীর বুকে এবং পেটে তিনটি গুলি ছুড়েছিলেন। গান্ধী মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে বিড়লা হাউসে তাঁর ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, সেখান থেকে কিছুক্ষণ পরে একজন প্রতিনিধি এসে তাঁর মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে।

গান্ধী যখন গণমানুষের নেতৃত্ব ও গণমানুষ দ্বারা শাসিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, গণতন্ত্রের প্রণীত এই বিখ্যাত ভাষণের মর্মবাণীকে ফিরেয়ে নেওয়া যায়। ইতিহাসের চাকা কি সত্যি সত্যি পেছন দিকে ঘোরানো যায়? মাত্র একটি বাক্যে গণতন্ত্রের নিখুঁত সংজ্ঞা, গণমানুষের দ্বারা শাসিত হওয়ার সভ্য ইচ্ছাকে কি কেউ কোনো দিন বাতিল করে দিতে পারে? এখনো পারেনি কেউ। আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত গণতন্ত্রের মৌলবাণী, ‘গণতন্ত্র হলো—জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার’। এ রকম মহৎ পদ্ধতিকে সরিয়ে দিতে বলতে পারবে, কিছু মানুষের, পেশির শাসন, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে অল্পসংখ্যক মানুষের শাসন কায়েম করবে।

ওই যে আইয়ুব খান পরোক্ষ গণতন্ত্র আর চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতি চালু করেছিলেন। অনেক চমক সৃষ্টি করেও মানুষের প্রবল গণঅভ্যুত্থানে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে। জন উইকস ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল ফোর্ড থিয়েটারে একটি অনুষ্ঠানে মাথার পেছন থেকে আব্রাহাম লিংকনকে হত্যা করে তাঁকে দেহান্তরিত করতে পেরেছিল। বোকা, নৃশংস নাথুরাম গডসে একইভাবে ভেবেছিল, মহাত্মা গান্ধীকে দৈহিকভাবে হত্যার মাধ্যমে তার অহিংসার বাণীকে চিরতরে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

প্রেসিডেন্ট লিংকনকে জন উইকস বুথ কী মাথার পেছনে গুলি করে হত্যা করতে পেরেছিল? ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল ফোর্ড থিয়েটারে একটি অনুষ্ঠানে হত্যা করতে পেরেছিল?

২৭ বছরের কারাবাসে ছিলেন। জেলে থাকার সময়ে বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি বাড়তে থাকে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসেবে রবেন দ্বীপের কারাগারে তিনি ও তার সহবন্দীরা একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন। কারাগারের অবস্থা ছিল বেশ শোচনীয়।

সারা দুনিয়ার মানুষ চেনে তাঁকে। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা। কেউ তাঁকে ডাকেন মাদিবা, কেউ খুলু আবার কেউ দালিভুঙ্গা। সবার কাছেই তিনি বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিচিত। ১৮ জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবার্ষিকী। তিনি শুধু সাধারণ মানুষেরই অনুপ্রেরণা নয়, রুপালি পর্দার তারকারা অনুসরণ করছেন তাঁর দর্শনকে।