হতাশা বনাম চেষ্টা

আজকাল মানুষের মধ্যে হতাশা বেশি। কিছু করতে পারলাম না বা কিছু হচ্ছে না—এই দুঃখবোধ যেন মানুষকে ভেতরে-ভেতরে ক্ষয় করে ফেলছে। বিশেষ করে উঠতি প্রজন্ম এর শিকার হচ্ছে। আমরা বাস করি কঠিন এক পৃথিবীতে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত মানুষকে ভাবতে হয় একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য। ভালোভাবে বাঁচতে গেলে খুব সচ্ছলতা না থাকুক, কিছুটা আর্থিক সংগতি থাকা প্রয়োজন। দেখা যায়, অনেকের এই সামান্য অনুষঙ্গ জোগান দেওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ছে। হাজারো যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত মানুষ তবু সুন্দর করে মেকি হাসি হেসে কথা বলে। কেউ কেউ অবশ্য চেষ্টা করে শূন্য থেকেও ওপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ অপেক্ষায় থাকে সৌভাগ্য যেন আপনা-আপনি এসে ধরা দেবে তার কাছে। আর যখন এ রকম কিছু ঘটে না, তখন দেখা দেয় হতাশা কিংবা পা বাড়ায় অপরাধের দিকে।

আমরা জানি, প্রত্যেক মানুষই জন্মে অপরিসীম সম্ভাবনা নিয়ে। আর সেই অপরিসীমের মধ্যে সে কেবল সেগুলোই করতে পারে, যা সে করার চেষ্টা করে বা করতে পারার ইচ্ছা পোষণ করে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘Action come from inside”। কথাটা খুবই সত্য। কিছু করার জন্য তোমার মনে যদি তাড়না থাকে, চিন্তা-ভাবনা থাকে, তা অবশ্যই কর্মে পরিণত হবে। সুতরাং তুমি কিছু করতে চাইলে তোমাকেই তার একটা ছাঁচ তোমার ভেতরে তৈরি করতে হবে। তোমাকে ভাবতে হবে তুমি কী করতে চাও। তারপর কাজ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওপরে ওপরে অনেক কিছু কিন্তু ভেতরে একেবারেই খালি কলস। কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকে অন্য কেউ বা বাবা-মা আমাকে সুযোগ দেবে, তারপর আমি কিছু করব। আসলে অন্য কেউ কিছু করে দিতে পারে না। যা করার তোমার নিজেকেই করতে হবে। এ কথা আমি অন্তত মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে এই পৃথিবীতে যাঁরা নিজেরা কিছু করার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা কিছু অন্তত করতে পেরেছেন।
খুব ছোট্ট উদাহরণ দিই নিজেকে নিয়েই। তেমন কিছু করতে না পারলেও আমার আজকের অবস্থানে আসা শুধু নিজের চেষ্টায়। মা-বাবা কলেজে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই বছরের মাথায় চলে গেছেন। বড় ভাই যিনি নিজের সন্তানের ব্যাপারেই উদাসীন, তিনি কখনোই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই চিন্তা করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। টানাপোড়েনের মধ্যবিত্ত সংসার, তবু আমি পড়া ছাড়িনি। সবচেয়ে ছোট ভাই কামরানের হাত ধরে ঢাকায় পাড়ি দিলাম ভর্তি পরীক্ষার জন্য। এভাবে শুরু এবং মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হতেই মতিঝিল থেকে গুলশান সব অফিসে রেজিউমি নিয়ে হাজির হতাম এবং হলো প্রথম চাকরি মাল্টিন্যাশনাল মোবাইল ফোন কোম্পানিতে। এই যে আমেরিকায় অবস্থান, এটাও অনেকটা এ রকমই। যদিও সবার ধারণা আমার স্বামী আমেরিকার নাগরিকত্বপ্রাপ্ত, তিনিই এনেছেন। কিন্তু না, এখানেও আমার নিজের চেষ্টা ছিল। যখন স্কুলে পড়তাম, তখন ক্ষীণ একটা ইচ্ছা ছিল আমেরিকায় এসে পড়াশোনা করব। বীজটা তখনই হয়তো আমার ভেতরে বোনা ছিল, যা একসময় কর্মে পরিণত হয়েছে।
যাই হোক, অনেকেই মাঝেমধ্যে বার্তা পাঠায় যে আমেরিকায় আসার খুব ইচ্ছা, কিন্তু সাহায্য করার কেউ নেই। কোনো সুযোগ থাকলে জানানোর জন্য। অল্পবয়সী ছেলেপিলে। কিন্তু তাদের মাঝে একধরনের হতাশা কাজ করে। শুধু পয়সার জন্য বিদেশে যাবে। তাদের ব্যক্তিগতভাবে দেওয়ার মতো কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।
একদিন একটা ছেলে দুঃখ করে বলল, তার মামা-খালা সবাই নিউ জার্সিতে থাকেন, কিন্তু কোনো সাহায্য করছেন না। আমি সেদিন তাকে ছোটখাটো উত্তর দিয়ে রেখেছিলাম। আর মনে মনে ভাবলাম যে কত ভুলের মধ্যে মানুষ থাকে। ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় ভাইবোনকে আনা যায়। কিন্তু আগে থেকে আবেদন না করলে হুটহাট কিছু করা যায় না। আর ভাগনে-ভাগনি তো একটু দূরেই থাকছে। উঠতি প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে সহজ হলো স্টুডেন্ট ভিসা। কিন্তু দু-তিন লাইনের ভুল ইংরেজি দেখলেই বুঝতে পারা যায় তাদের যোগ্যতা। একজনের ভাই এ দেশে। কিন্তু সে অপেক্ষায় আছে মিথ্যা বিয়ে দেখিয়ে স্পাউজ ভিসায় আমেরিকায় আসবে। ভাবতেও অবাক লাগে, এখনো মানুষ এমন ভাবে। আর মিথ্যা ধোঁকাবাজি দিয়ে কি আদৌ কেউ বড় হতে পারে? আমি যা বুঝি তা হলো, ‘কাজ করো। একটা সময় তার ফল পাবে। আরেকজন রাজনীতি করে বাপের হোটেলে খায়। ১০-১৫ লাখ টাকা খরচ করে হলেও আমেরিকায় আসতে চায়। এই যদি হয় স্বপ্ন, এমন স্বপ্ন কি পূর্ণ হয় কখনো? আর হলেও তার ফল যে খুব একটা ভালো হয় না, তা তো আমরা এখানে দেখছি।
সম্ভাবনা থাকলেও অনেক ছেলেমেয়ে বাঙালি রেস্তোরাঁ বা স্টোর ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করতে যেতে চায় না শুধু তাদের সাধারণ কিছু ঘাটতির কারণে। স্টুডেন্ট ভিসায় এলেও অনেকের পাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখনো সেই হতাশা।
আমি যা বুঝি, পড়াশোনা হোক আর কাজ হোক, নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাও। দেশে হোক আর বিদেশে হোক, একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। আর কিছু করলাম না, অন্য কেউ করে দেবে—এমন আশা হতাশারই জন্ম দেয়। খুব সত্য কথা, ‘তুমি নিজে যতক্ষণ নিজেকে সাহায্য না করছ, ততক্ষণ অন্য কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না।’