প্রতীকী ছবি

বর্তমানে ফোনের প্রয়োজনীয়তা আমাদের জীবনের বড় একটা অংশজুড়ে আছে। যেকোনো কাজে রয়েছে এর ব্যবহার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবহার আসক্তিতে রূপ নিচ্ছে, যা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।

স্মার্টফোনে আসক্তির ক্ষতিকর প্রভাবে শরীর ও মনে পরিবর্তন ঘটে, যা সত্যিই ভয়ানক বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ আসক্তি কিশোর বয়সীদের সামাজিক, মানসিক, শিক্ষা, মনোবৈজ্ঞানিক, আচরণগত ও পেশাগত জীবনে মারাত্মক আঘাত হানতে পারে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, গাড়ি, বাইক দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা এই মুঠোফোনের কারণে ঘটে থাকে। যানবাহন চালানোর সময় চালকেরা মুঠোফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁরা দুর্ঘটনার শিকার হন।

সামাজিকতা থেকে দূরে থাকা, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, পারিবারিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হওয়া, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, পড়াশোনায় অমনোযোগ, মস্তিষ্কের ক্ষয়—এ ধরনের বহু সমস্যা স্মার্টফোনে আসক্তি থেকে হয়ে থাকে। আচরণগত পরিবর্তন—যেমন মেজাজ খিটখিটে বা চড়া মেজাজে থাকা, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনকে এড়িয়ে চলা, সামাজিক সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটা, পর্যাপ্ত না ঘুমানোর ফলে মস্তিষ্কের দুর্বলতা, আগে ভালো লাগত এমন কাজ বিরক্তিকর মনে হওয়া ইত্যাদি। এতে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যে ব্যাঘাত ঘটে।

মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা ও বিষণ্ণতার মতো রোগ দেখা দেয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয়তা সম্ভবত বাস্তব ও স্ক্রিনবন্দী জীবনে সীমারেখা টেনে দিচ্ছে; একটি জীবন চেনে না আরেকটি জীবনকে। একই ব্যক্তির মধে৵ যেন দুটি সত্তা; একটি বাস্তবতার টানাপোড়েনে পরিপূর্ণ, অন্যটি স্ক্রিনের কৃত্রিম আলোর মতোই ঝলমলে ও চোখধাঁধানো। দুটি জীবনের কুশীলবেরা যেন অনেকটাই আলাদা। আমরা সচরাচর শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে স্ক্রিনবন্দী জীবনে আসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু আমরা যাঁরা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি, তাঁরাও কি এই আসক্তি থেকে দূরে আছি? শৈশব, কৈশোর বা যৌবনের পরিক্রমায় আমরা যে ভালো অভ্যাসগুলো অর্জন করেছিলাম, সেই অভ্যাসগুলো আমরা কি ধরে রাখতে পেরেছি? আমরা নিজেরা কি হারাতে বসিনি সামাজিকতা, মূল্যবোধ আর শিষ্টাচারের শিক্ষা? সম্পর্কের মধ্যে কি তৈরি করছে না অনেক বড় বাধা?

দক্ষিণ কোরিয়ার রেডিওলজির অধ্যাপক ইয়ুং সুকের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে এর প্রমাণ পেয়েছেন। যেসব কিশোর-কিশোরীর মস্তিষ্কে ব্যাপকভাবে এ পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে, দেখা গেছে, তাদের সবাই স্মার্টফোন বা ইন্টারনেটে আসক্ত৷

ফোন বা ইন্টারনেটে আসক্ত ১৯ কিশোর–কিশোরীর ওপর পরীক্ষাটি চালিয়েছেন সিউলের কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। ব্যবহারকারীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, তারা যে স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তা তাদের দৈনন্দিন জীবনে কী প্রভাব ফেলে?

চিকিৎসকেরা অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি ছবি তুলেছিলেন, যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে গামা অ্যামিনোবাটাইরিক অ্যাসিড বা জিএবিএর পরিবর্তন লক্ষ করতে চেয়েছিলেন৷ জিএবিএ মস্তিষ্কের একধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যেটি মস্তিষ্কের বার্তাগুলোর গতি ধীর করে দেয়৷ এ ছাড়া জিএবিএর দৃষ্টিশক্তি, আচরণ, মস্তিষ্কের আরও অনেক কাজ, যেমন নিদ্রা ও উদ্বেগের ওপর এর প্রভাব রয়েছে৷ পরীক্ষায় দেখা গেছে, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে আসক্ত কিশোর বয়সীদের মস্তিষ্কে উচ্চ মাত্রায় জিএবিএ আছে। এ ছাড়া শিশু ও তরুণদের ক্ষেত্রেও স্মার্টফোনের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। বাচ্চারা ফোনে কতটা সময় ব্যয় করছে, অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআরসি কগনিশন অ্যান্ড ব্রেন সায়েন্সেস ইউনিটের গবেষণা ফেলো অ্যামি ওরবেন বলছেন, স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রভাবকে সরলীকরণ করা যাবে না। এটি আগেও দেখানো হয়েছে, স্মার্টফোনের প্রভাব সব সময় একমুখী হয় না। ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন মানুষের মেজাজে প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনি মানুষের মনমেজাজ স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

আমাদের উচিত ফোন ব্যবহারে আরও বেশি সচেতন হওয়া ও অন্যদের সচেতন করা।
লেখক: মো. হাসিবুর রহমান, শিক্ষার্থী: বেঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটি, ভারত। ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট ফুল ফান্ডেড স্কলার।