স্বামী-স্ত্রীর সংসার

ফাইল ছবি: প্রথম আলো

মতিন মিয়া জন্মের পর থেকে তিতা করলা খান না। দুনিয়ায় নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে তিনি করলাকে বেচে নিয়েছেন। ৩২ বছর ধরে মমেনা বেগম ভালো করেই জানেন তাঁর স্বামী মতিন মিয়া করলা খান না। এদিকে মমেনা বেগম করলা ছাড়া ভাত খান না, কী মছিবত। বিয়ের পর থেকে মমেনা বেগম বহুবার চেষ্টা করেছেন তাঁর স্বামীকে করলা খাওয়াতে, কিন্তু পারেননি। বাঙালি নারীদের হেরে গেলে চলবে না। যেভাবে হোক মতিন মিয়াকে করলা খাওয়াবেন মমেনা বেগম। শেষমেশ চিন্তাভাবনা করে মমেনা বেগম প্রতিদিনের মতো সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে করলা কিনে এনেছেন। বিয়ের পর মতিন মিয়া কখনো বাজার থেকে করলা নিয়ে আসেননি, মমেনা বেগম নিজে খান, নিজে কেনেন।

এক সপ্তাহ ধরে মমেনা বেগম শুধু আলু দিয়ে করলা ভাজি করছেন, ভাত আর করলাভাজি ছাড়া আর কিছু নেই। মতিন মিয়া যা বোঝার সব বুঝে গেছেন। মমেনা বেগম তাঁকে করলা খাইয়ে ছাড়বেন। মতিন মিয়াও কম না, করলাভাজি থেকে বেচে বেচে আলু দিয়ে ভাত খেয়ে পেলেন। এ দৃশ্য দেখে মমেনা বেগমের চক্ষু চড়কগাছ। এবার মমেনা বেগম শুধু করলাভাজি করছেন। মতিন মিয়া রাগে–ক্ষোভে একাকার।

রান্না করতে জানেন না মতিন মিয়া নয়তো নিজেই রান্না করে খেতেন। মতিন মিয়া ভাত খাচ্ছেন না দেখে মমেনা বেগম শরীরের পুরো শক্তি খরচ করে চিৎকার দিয়ে বললেন,
—আজ যদি করলা না খেয়ে ভাত খাওয়ার টেবিল থেকে এক পা উঠে, পা কেটে গলায় ঝুলিয়ে দিব। বাঙালি নারীদের এখনো চেনো না। কী ভেবেছো? করলা রান্না করব আর তুমি করলা খাবে না, তা হবে না, তা হবে না। করলা খেয়ে আজ তুমি এখান থেকে উঠবে। আমি কোন বাড়ির মেয়ে তা তোমার জানা নেই।
মতিন মিয়া ভয়ে চুপসে গেলেন। ৫০ বছর বয়স ৩২ বছরের সংসারে তিনি এই প্রথম এত ভয় পেয়েছেন। তাড়াহুড়ো করে খাবার খেতে গিয়ে গলায় শুকনা ভাত আটকে মরি মরি অবস্থা। কিন্তু মমেনা বেগম কোনো দয়া না দেখিয়ে বললেন,
—ভাত গেলা ছাড়া পানি পাবে না।

মতিন মিয়া বাধ্য হয়ে করলা আর ভাতের লোকমা গিলে তারপর পানি খেয়েছেন। মতিন মিয়ার জীবনে এখন প্রতিপক্ষ হিসেবে রয়েছে তাঁর স্ত্রী। মতিন মিয়া করলা দিয়ে ভাত খাওয়া কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না। মতিন মিয়াও মনে মনে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মতিন মিয়াও কম না। দুই দিন করলা দিয়ে ভাত খাওয়ার পর মতিন মিয়ার মাথায় কোনো বুদ্ধি আসছে না। একদিন হোটেলে খেয়ে কোনোরকম মন–মেজাজ ঠান্ডা করলেন।

মমেনা বেগম ঝাল খান না। ঝাল হচ্ছে মমেনা বেগমের চির শত্রু। মতিন মিয়াও ঝাল খেতে পারেন না। এদিক দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মিল রয়েছে। মতিন মিয়া চিন্তাভাবনা করলেন, হোটেল থেকে খাবার নিয়ে যাবেন। হোটেলের বাবুর্চির সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করলেন।
—কাকা যত পারেন একটায় ঝাল দেন। যত ঝাল দিয়ে খাবার দিতে পারেন তত বকশিশ দিব। আরেকটাতে দেওয়ার দরকার নাই।
বাবুর্চিও খুশি হয়ে ইচ্ছেমতো ঝাল দিয়ে খাবার দিলেন মতিন মিয়াকে। মতিন মিয়া খাবার নিয়ে এলেন বাড়িতে। মতিন মনে মনে বলছেন, তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়।
—এই নাও আজকে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসছি। আর কয় দিন এভাবে করলা খেয়ে জীবন কাটাতে হবে।
—ভালো করেছো, আমিও ভেবেছি তোমাকে বলব হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসার জন্য। তুমিও তাড়াতাড়ি চলে আসলে।
—এই প্যাকেট তোমার আর এটা আমার।

মতিন মিয়া চলে গেলেন ফ্রেশ হতে। এদিকে মমেনা বেগম খাবার টেবিলে পরিবেশন করতে গিয়ে তরকারি দেখে একটু সন্দেহ করলেন। মমেনা বেগম পাক্কা রাঁধুনি। তিনি তরকারির কালার দেখে বুঝে ফেলেছেন এটা ঝাল দিয়ে ভরপুর অন্যদিকে মতিন মিয়ার খাবারের তরকারি আলাদা। মমেনা বেগম স্বামীর এমন কর্মকাণ্ড দেখে মঙ্গল গ্রহ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। মতিন সাহেব ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগে আগে মমেনা বেগম খাবার পাল্টে ফেললেন।

মমেনা বেগম নিজে নিজে বললেন, মমেনা বেগমকে এত তাড়াতাড়ি হারানো সহজ নয়।
মতিন মিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেতে বসলেন। মমেনা বেগমও বসলেন। মমেনা বেগম খাবার খাচ্ছেন, মতিন মিয়া তাকিয়ে আছেন। মতিন মিয়া মনে মনে ভাবছেন, ঘটনা কী? সে তো ঝাল খেতে পারে না। নিশ্চিত বাবুর্চি প্রতারণা করেছে।
—কী হলো খাচ্ছো না কেন?
—এই তো খাচ্ছি।

মতিন মিয়া কয়েক লোকমা দিয়ে জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা। ঝালে অবস্থা খারাপ। পানি খেতে খেতে কখন যে লুঙ্গি খারাপ করে ফেলেছেন, তিনি নিজেই জানেন না। তাড়াতাড়ি ডুকলেন বাথরুমে। মতিন মিয়া আরেকজনের জন্য গর্ত করে সে গর্তে নিজেই পড়েছেন। মমেনা বেগম হিহি করে হাসছেন। এদিকে মতিন মিয়া বাথরুমে আসা–যাওয়া করতে লাগলেন। শেষমেশ বাথরুম থেকে বের না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাথরুম থেকে বের হলেই আবার ডুকতে হয় বুড়ো বয়সে এত কষ্ট সহ্য হয় না মতিন মিয়ার।

*লেখক: গাজী ফরহাদ, আল-কাছিম, সৌদি আরব