স্বাধীনতা দিবসে অন্তরার গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চিকিৎসক অন্তরা বসে আছেন তাঁর কাচঘেরা ঘরে, ছাদবাগানের পাশে। নিজের ছোট্ট আপন পৃথিবীতে। ২৫ মার্চ। এ বছর এ সময় হুট করেই বেশ গরম পড়ে গেছে। তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সারা দিন কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলায় হাত–মুখ ধুয়ে নামাজ পড়ে এক কাপ চা হাতে বসেছেন তিনি। দিনটা অসম্ভব বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর জন্য। কারণ, ১৯৭১ সালের এদিন রাতে তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামীকে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলির ফোন পেলেন। তিনি সাংবাদিক। অনেক দিন থেকে তাঁর পিছু ছাড়ছেন না। একটা সাক্ষাৎকার দিতেই হবে তাঁকে। অন্তরা বললেন, ‘কলি জানো, আমার নাতনির সঙ্গে তোমার স্বভাবচরিত্র অনেকটাই মেলে। তাই তোমাকে আজকে রাতে সময় দেব। বাংলাদেশি অসংখ্য মেয়ের মতো আমার জীবনটাও সহজ সরল। তবু যখন জানতে চাইছ…’—এই বলে ফোনটা স্ট্যান্ডে রেখে ভিডিও চ্যাট অন করলেন অন্তরা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। এদিন দিয়েই জীবন শুরু করলেন অন্তরা, ‘এর আগের জীবনটা আর দশটা মেয়ের মতোই। মেডিকেলে পড়ার সময় এসপি শাহেদের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। সুখের কোনো সীমা ছিল না। শাহেদ সব সময় বলত, “অন্ত তোমাকে সার্জন হতে হবে।” এর মধ্যে শ্রাবণ আর বর্ষা নামের দুটি বাচ্চা এল জীবনে। ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই শুরু হয়ে গেল উত্তাল আন্দোলন দেশজুড়ে। দেশের সেবায় শাহেদ ব্যস্ত হয়ে গেল। ছোট শিশুদের নিয়ে আমিও ওর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করে গেলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের মদদদাতা হিসেবে শাহেদকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হলো। পরদিন স্বাধীনতার ঘোষণা এল। এ রকম গৌরবময় একটা দিন তার সঙ্গে হাত ধরে আর দেখা হলো না আমার।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘প্রথম কয়েক মাস বালিশে তার গন্ধ, ঘরে সব জায়গায় তার ছায়া, রান্না করলে ভালোমন্দের কথোপকথন—সব মিলিয়ে চলে গেলাম ডিনায়েলে, মানে না মেনে নেওয়ার জায়গায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শেষ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সেই সময়েও কিছু বন্ধু কোরআন শরিফ দিয়ে গেল, যখন তারা জানে, শাহেদের দেওয়া কোরআন বাংলা অর্থসহ আমি পড়ি। মুরব্বি গোছের কেউ কেউ তো হজ করার কথা বলে ফেললেন। অসহায় দুটি শিশুমুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা হয়ে গেল দুর্বার। আগে তো বেঁচে থাকতে হবে, জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষটার চলে যাওয়াতে আমার তো কোনো হাত ছিল না। এখন জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকতে সব তো একহাতে সামলাতে হবে। ছেলেটা বড় হোক, ওর সঙ্গে যাব হজে।

মাস কয়েক যেতে না যেতে কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে রাগ হয়েছিল। কেন কেউ আমার জীবন বোঝে না? কেন উপদেশ দেওয়ার জন্য দুঃখভারাক্রান্ত একজনকে বেছে নেয়? তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হব। মানুষকে কষ্টের সময় পার করিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউন্সেলিং করা একটি আর্ট।’ কলি বললেন, ‘ম্যাম, সে জন্যই কি আপনি মোটিভেশনাল স্পিচ দেন বড় বড় কোম্পানিতে বিনা পয়সায়?’ তিনি হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, জীবনটা গুছিয়ে নিয়ে বাকি জীবন অসহায় মানুষের পাশে থাকার ব্রত নিয়েছি; একদিন আমার যা প্রচণ্ড দরকার ছিল। খুব অল্প সময়ে শাহেদ সে বোধ আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দেশ স্বাধীন হলো। বাচ্চারাও একটু একটু করে বড় হতে লাগল। একদিন সরকারি চাকরি পেলেন অন্তরা, ধীরে ধীরে ডিগ্রি নিয়ে প্রমোশনও পেতে লাগলেন। শুধু যে মানুষটা সবচেয়ে খুশি হতো, সে সঙ্গে নেই। একটা দেশের স্বাধীনতার কাছে এটা অনেক বেশি আত্মত্যাগ নয়। তবে আনন্দ ও সুখ আরেকজনের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য তাঁর মনটা ব্যাকুল হয়ে থাকত। অন্তরা বলছেন, ‘অপেক্ষা করছি, পরকালে তার সঙ্গে কখন দেখা হবে। এমন সময় কিছু আজেবাজে মানুষ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল। বিবাহিত, কিন্তু বিপদগ্রস্ত হিসেবে সাহায্য করতে চায় ইত্যাদি। বলে দিলাম, “যে মেয়েটা পাগলের মতো ভালোবেসে আপনার সঙ্গে আছেন, তাঁর চোখের পানির বদদোয়ায় কোনো তাজমহল গড়তে পারবেন না।

আর নিজের যে সম্পদ, তা হারিয়ে ফেলবেন না যেন। কারণ, জীবনে সৎ ও ভালোবাসাময় সঙ্গী পাওয়া অনেক সৌভাগ্যের।” কেউ কেউ আসে টাকাপয়সার লোভে, আর কেউ কেউ স্রেফ অসহায় চিন্তা করে সুযোগ নিতে। কিন্তু দেশটা স্বাধীন হয়েছে এখন। আমার স্বামী জীবন দিয়েছেন সে জন্য। আমি কেন মাথা উঁচু করে বাঁচব না?’ কলি হাসল। বলল, ‘ম্যাম তারপর?’

‘তারপর বছর গড়িয়ে চলল নিজের গতিতে। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। নাতি–নাতনির মুখ দেখছি। ৮৫ বছর বয়সেও সচল একজন মানুষ আমি। প্রিয়জন হারানো মেয়েদের পাশে দাঁড়াব—এই প্রত্যয়ে বেশ আছি আমি।

‘অল্প বয়স মানুষকে অনেক ইমোশনাল করে রাখে। প্রিয় কাউকে হারালে কষ্ট হবেই। নিজে চলে যাওয়া পৃথিবী ছেড়ে, সেটা কোনো অপশন নয়। সময় দুঃখ ভুলিয়ে দেবে, সুন্দর ভবিষ্যৎ পড়ে থাকে সামনে। তাকে আসতে সুযোগ দিতে হবে। মানুষ নিজের জন্য শুধু বাঁচে না। যত বেশি প্রতিকূলতা, তত বেশি সমাধান। তাই কাউন্সেলিং করে, আশা জাগিয়ে বেঁচে থাকতে চাই কলি ও আমরা।’

কখন মধ্যরাত পেরিয়েছে অন্তরা বা কলি কেউ বুঝতে পারেননি। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর। আকাশে চাঁদ আলো ছড়িয়ে চলেছে। অন্তরা ঘুমাতে যাচ্ছেন, আর কলি বিদ্যুতের বেগে টাইপ করছে। আজ সবাইকে জানাতেই হবে, সবার ভালোভাবে বেঁচে থাকার কারণ আলাদা, কিন্তু সুন্দর জীবন সবার জন্যই হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে।