স্বপ্নের কাছে ফেরা
শ্বশুরবাড়ি শেষ কবে এসেছিলাম? ২০০২ সালের জুলাইয়ের এক পড়ন্ত বিকেলে। সেই আসাটা বেদনাবিধুর ছিল। শ্বশুরের মৃতদেহ নিয়ে লাশবাহী গাড়ির সঙ্গে আসা। গ্রামের বাড়িতে গাছগাছালি ঘেরা ছায়াময়-মায়াময় পরিবেশে বাবাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করে সেই যে গিয়েছি প্রবাসে, এসেছি আজ ১৬ বছর পর! পৃথিবীর জন্মের হিসাবে ১৬ বছর হয়তো কিছুই না। কিন্তু মানব জন্মের হিসাবে এ বড় দীর্ঘ সময়। এক জীবনে আরও ১৬ বছর বেঁচে থাকব কিনা, সে নিশ্চয়তা নেই। তবুও এই যে বিদেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সন্তানদের নিয়ে তাদের দাদার বাড়ি এসেছি, আসা হয়েছে, এ-ই বা কম কী!
শেষ যখন এসেছিলাম, সে সময়ে অনেক কিছুই অন্যরকম ছিল। মুখর ছিল বাড়ি, উঠান ও বৈঠক ঘর। সবকিছু বদলেছে বিস্তর। বদলেছে মানুষ। এসেছে পরবর্তী প্রজন্ম। বাবা নেই, মেজো কাকা নেই। নেই মানে বেঁচে নেই। ‘লোক পাইলে মনে করে ভিটামিন ওষুধ পাঠাইও’ এমন দরদমাখা চাওয়াও নেই। গ্রামের সরু পথের ধারে বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি ক্ষণিক। পারিবারিক কবরস্থান। সেখানে চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন একসময় এ মাটি যাদের পদচারণায় মুখরিত ছিল, সেই সব মানুষেরা। সবুজ ঘাস কেমন নির্মল সতেজভাবে শুয়ে আছে পুরো কবর জুড়ে! যেন মৃতদের শীতল ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে। বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে রঙ্গন ও হলদে জবা ফুটে আছে। পাশেই মসজিদ। প্রার্থনার স্থান। সব মিলে এমন শান্তির পরিবেশ আমি আগে দেখিনি! খানিকটা অসুস্থতা নিয়ে বেঁচে আছেন কেবল ছোট কাকা। গ্রামের আলো-বাতাস থেকে দূরে, বহুদূরের যানজটের শহর ঢাকায়, চিকিৎসার সুবাদে। নিশ্চয়ই তাঁর মন পড়ে আছে নিজ হাতে লাগানো সবুজ গাছে, পুকুরের স্বচ্ছ জলে কিংবা সাজানো গোছানো বাড়িটিতে।
বাড়ি ঘিরে মানুষের স্বপ্ন বেঁচে থাকে, স্বপ্ন পূরণ হয়। কিন্তু মানুষ থাকে না চিরকাল। থাকা হয় না স্বপ্নের বাড়িতে। আর দূর পরবাসে যাঁরা থাকেন, তাঁরা যেন থেকেও থাকেন না কোথাও। তাঁদের স্বপ্ন, একদিন অবশ্যই ফিরব। ফিরে আসব বাড়িতে, শেকড়ে। তাঁদেরও ফিরে আসা হয় না কোনো দিনই। মূলত শেষ অবধি মানুষের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
...
রিমি রুম্মান: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।