স্বপ্নার স্বপ্ন

মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছি ভোরে। আমি আর মি. চৌধুরী হাঁটতে বের হই একসঙ্গেই, ফিরি আলাদা। হাঁটার সময় সঙ্গী পেয়ে যাই আমি, ফলে তাঁকে আগেই ফিরে আসতে হয় বাড়িতে।
আজ লেকের ধারে দেখি এক মেয়ে বসে দাঁত ব্রাশ করছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে বোতলের পানি। বয়স কত হবে, বড়জোর একুশ! খটকা লাগল। এত সকালে এ মেয়ে এখানে কেন? আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে আছি। তা দেখে মেয়েটি ধমকের সুরে বলল, এদিকে কী দেখেন? হাঁটতে যান!’
ও আমার মেয়ের বয়সী। ওর ধমক গায়ে না মেখে বললাম, ‘এই মেয়ে, উঠে এসো। কথা বলব।’
‘আপনি ভদ্রলোকের বউ। আমার সঙ্গে কী কথা?’
আমি বললাম, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলতে সমস্যা কী?’
‘আমি খারাপ মেয়েমানুষ। আমার সঙ্গে ভদ্রলোকদের কোনো কথা নাই। আপনি যান।’
মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গি খেয়াল করছিলাম। সাহসী আর স্পষ্ট কথাবার্তা। ওর এই সাহসই আমাকে আকৃষ্ট করল। আমি হেসে দিলাম।
আমাদের এই আলাপচারিতা খেয়াল করছিল আমার স্বামী আর আশপাশে জড়ো হওয়া মানুষ। বেশ বুঝতে পারছিলাম, তারা কেউ আমাদের এই কথাবার্তা পছন্দ করছিলেন না।
একটু পর মি. চৌধুরী বললেন, ‘এবার চলো। তুমি বুঝতে পারছ না, কার সঙ্গে কথা বলছ?’
আমি বললাম, ‘খুব বুঝতে পারছি। আজ আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। এই মেয়েটার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলি। ওর সঙ্গে চা খাব।’
মি. চৌধুরী খুব রাগ করলেন। সোজা চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘চারদিকে এত পরিচিত মানুষ! তোমার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি!’
আমি বললাম, ‘আমার ভাল্লাগছে ওর সঙ্গে কথা বলতে।’
মেয়েটি আমার কথা শুনছিল। চৌধুরী সাহেব চলে যাওয়ার পর ও হেসে বলল, ‘আপনি তো ডেঞ্জারাস মহিলা! স্বামীর কথা শোনেন না!’
মেয়েটিকে বললাম, ‘চলো, আজ তোমার সঙ্গে নাশতা করব।’
লেকের পাড়ে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম আমরা। পরোটা, ডিম ভাজা আর চা দিতে বললাম। তারপর মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম।
ওর নাম স্বপ্না। নেত্রকোনায় বাড়ি। বয়স ২৪। পড়েছে ক্লাস এইট পর্যন্ত। ছয় ভাইবোন। স্বপ্না সবার বড়। ওর বাবা রিকশা চালাতেন। সব ছেলেমেয়েকেই পড়াতে চাইতেন। দুবেলা রিকশা চালিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। তিনি যখন মারা যান, তখন স্বপ্না ক্লাস সেভেনে পড়ত।
স্বপ্না প্রথমে কিছুই বলতে চায়নি। কিছু প্রশ্ন করার পর যখন ও কথা বলতে শুরু করল, তখন প্রশ্নের চেয়ে উত্তরগুলো হতে থাকল অনেক বড়।
নাশতা চলে এল। আমি এখন একজন চব্বিশ বছর বয়সী পতিতার সঙ্গে বসে চায়ে পরোটা ডুবিয়ে খাচ্ছি। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি স্বপ্নাকে দেখছি। মিষ্টি চেহারা, কিন্তু তাতে বেদনার ছাপটাও দেখা যাচ্ছে। আহারে! সারা রাত ধরে মেয়েটার ওপর দিয়ে কত-না ধকল গেছে! কত যন্ত্রণাময় এক একটা রাত পার করে মেয়েটা! তার প্রমাণ ওর হাতে, গলায়, মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘আরও কিছু খাও।’
স্বপ্না বলল, ‘না। আর খেলে বাসায় যেতে কষ্ট হবে।’
চায়ের দোকানের খদ্দররা আড়চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। ফিসফিস করে আমাদের নিয়ে কথা বলছিল। আমি ও সব পাত্তা দিচ্ছিলাম না।
ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ভরা বর্ষার লেকের পানি টলমল করছে। আমরা চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে লেকের ধারে পাথর বাঁধানো ঘাটে বসলাম।
একটু পর ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি যে তোমার বাবার কথা বলছিলে, তার স্বপ্নের কথা বলছিলে। তিনি তো মারা গেলেন। এরপর তোমাদের কী হলো?’
স্বপ্না এখন কথা বলছে। অনেক কথা। ‘আমার বাবা খুব পরিশ্রমী ছিলেন। গরিবের সন্তান পড়াশোনা করতে পারেননি। পাঠশালা পাশ করার পর খেতে-খামারে কাজ করতেন। এক সময় ঢাকা শহরে চলে আসেন। এসে রিকশা চালানো শুরু করেন, মৃত্যুও হয় রিকশার প্যাডেলে পা রেখে। একটা বাস আমার বাবার প্রাণ কেড়ে নেয় আর আমাকে পতিতা বানিয়ে দেয়।’
খুব সহজে কথাগুলো বলে স্বপ্না।
‘বাবা বলতেন, স্বপ্না, তুই লেখাপড়া করে মাস্টারনি হবি। আমার ছোট তিন বোন আর দুই ভাই। ওদেরকে বলতেন, তোমরা বড় অফিসার হবা। সরকারি অফিসে কাজ করবা। আহা! আমরা ছিলাম বাবার কলিজার টুকরা। আমি বড় মেয়ে, আমার আদর সবচেয়ে বেশি ছিল। আর আজ দেখেন আমার অবস্থা!’— বলেই স্বপ্না মুখে ওড়না চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ।
‘বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! ঢাকা শহরে এতগুলো মানুষের সংসার চালানো অসম্ভব। সবাই ছোট, আমি কেবল একটু বড় হয়েছি। বাবার হত্যার বিচার হয়নি। মা থানাতে মামলা করেছিল। কিন্তু বাসের মালিক মায়ের হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে মীমাংসা করে ফেলেছিল। মা তখন এতগুলো ছেলেপেলে নিয়ে দিশেহারা। মীমাংসা হওয়াতে কিছু টাকা পাওয়া গেছে। তখন এই টাকাই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। এই টাকায় বেশ কিছু দিন চলার পর ফের অভাব অনটন দেখা দিল। আমি তখন মাকে বুঝিয়ে বললাম, আমি বাসাবাড়িতে কাজ করব, তুমিও কাজ করো। আমার আর লেখাপড়ার দরকার নেই, আমরা দুজনে মিলে সবাইকে মানুষ করব। বাবার স্বপ্ন পূরণ করব। মা নিরুপায় হয়ে আমরা কথা মেনে নিলেন, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
‘তারপর?’
‘আমরা থাকতাম রায়ের বাজারের এক বস্তিতে। আমার পাশের ঘরের এক খালা আমাকে একটা বাসায় বাঁধা কাজে লাগিয়ে দেন। বেতন মাসে দুই হাজার টাকা। বেগম সাহেব খুব ভালো মানুষ। তার দুই ছেলে। এক ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকতেন, আরেকজন তাদের সঙ্গে। নতুন চাকরি ভালোই চলছিল। প্রায় আট নয় মাস ধরে কাজ করছিলাম। আমার সঙ্গে সবাই খুব ভালো ব্যবহার করতেন। আমি তাদের সার্ভেন্ট রুমে থাকতাম। আমার বয়স কম, তাই খালাম্মা (বেগম সাহেব) আমাকে ভেতর থেকে দরজা আটকাতে নিষেধ করতেন। আমিও দরজা ভেজিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতাম।’
‘তারপর?’
‘একদিন মাঝরাতে কে যেন আমার মুখ চেপে ধরল। আমার কাপড়চোপড় খুলে ফেলল। আমি ভয়ে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। হঠাৎ জানালা দিয়ে একটু আলো এসে সেই পশুটার মুখের ওপর পড়ল, আমি দেখলাম আমার বাবার চেয়েও বয়সে বড় খালু আমার ছোট্ট শরীরটাকে খাবলে খাচ্ছেন। কতক্ষণ কি হলো জানি না। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, একদম চুপ থাকবি। কেউ যেন টের না পায়। যদি কাউকে কিছু বলিস, তবে খুন করে ফেলব। ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্ট সব একাকার হয়ে আমি পাথরের মতো হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ এভাবে পড়ে থাকার পর, ভোরে উঠে আমার রক্তাক্ত শরীর আর কাপড়চোপড় ধুয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। খালাম্মা সকালবেলা এসে জিজ্ঞেস করলেন, এত বেলা হয়ে গেছে, এখনো শুয়ে আছ কেন? বললাম পেট ব্যথা করছে, মাসিক হয়েছে, খুব কষ্ট হচ্ছে। উনি ওষুধ দিয়ে বললেন, শুয়ে থাক। ২/৪ দিন আরাম করার পর আবার কাজে মনোযোগ দিলাম। যখনই সাহেবের দিকে চোখ পড়ত, ভয়ে ঘৃণায় অস্থির হয়ে যেতাম। আমি লজ্জায় মাকেও বলতে পারিনি, কেবল নিজে নিজে কাঁদতাম। আমি বুঝিনি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। প্রায় প্রতি রাতে এই অত্যাচার চলতে লাগল। এক সময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সারাক্ষণ বমি করতাম, কিছু খেতে ইচ্ছে করত না। তখন আমার বয়স ১৬-র মতো হবে। একদিন খালাম্মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সঙ্গে কি কারও প্রেম-ট্রেম হয়েছে কিনা। বাসায় চালক, দারোয়ান কারও সঙ্গে কিছু হয়েছে কিনা? আমি যতই না করি খালাম্মা ততই রেগে যান। আমাকে নিয়ে ডাক্তারখানায় গেলেন, রোগ ধরা পড়ল, আমি গর্ভবতী! তারপর আর কিছুই লুকাইনি, সব খুলে বললাম। বেগম সাহেব ওই দিনই আমাকে ওয়াশ করালেন। আর হাতে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বিদায় জানালেন।’
আমি শুনছি।
‘আমার মা সব শুনে শোকে পাথর হয়ে বসে রইলেন। আমাকে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করলেন না। আমি শুয়ে-বসে দিন কাটাতে লাগলাম। এভাবে কিছুদিন চলার পর আমাদের বস্তির এক আপার সঙ্গে পরিচয় হলো। সব সময় বেশ সাজগোজ করে থাকে, পরিবারের অবস্থাও ভালো। সেই সংসার চালায়। ওকে দেখে আমারও লোভ হলো। একদিন বললাম, ‘আপা কি কাজ করো, আমাকে কি একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারবে?’ সে হাসি মুখে রাজি হলো। কিন্তু একটা কথা তখন বলেছিল, ‘কাজটা কঠিন মনে করলে কঠিন আর সহজ মনে করলে সহজ। তবে টাকার অভাবে নেই। তুমি ভেবে দেখো, এখনই কিছু বলার দরকার নেই, দুদিন সময় নাও।’ আমি দুদিন অনেক ভাবলাম, চিন্তা করলাম, আমার তো সবই গেছে! আর কি যাওয়ার বাকি আছে? আমার ছোট পাঁচটা ভাই-বোন আর পুষ্টিহীন চেহারার মায়ের কথা ভেবে বুকটা হুহু করে উঠল। পরের দিন আপাকে জানালাম, ‘আমি যেকোনো কাজ করতে রাজি আছি। আমার অনেক টাকার দরকার।’ সেই আপা বাড্ডার এক বাসায় নিয়ে গেলেন। পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে আমার আর বুঝতে বাকি নেই, আমাকে এখানে কি করতে হবে। সেই থেকে আমার এই পতিতাবৃত্তি শুরু। আজ প্রায় আট বছর এই পেশায় আছি। মা জেনেও না জানার মতো করে থাকে। তবে আমার দিকে তাকাতে যে মার লজ্জা করে, সেটি আমি বুঝি। ভাই বোনেরা সবাই লেখাপড়া করছে, সচ্ছলভাবেই সংসার চলছে। মা সব সময় মন মরা হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ঘুমাতে গেলে আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে কেঁদে বুক ভাসায়। আমার বাবার অতি আদরের কন্যা ভ্রাম্যমাণ পতিতা!’
স্বপ্নার গল্প শুনতে শুনতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আমার কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠল। আমি স্বপ্নার হাত ধরে বললাম, ‘আমি যদি তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাই, তুমি যাবে? তোমাকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যেকোনো একটি বিষয়ে ভর্তি করিয়ে দেব। তুমি ট্রেনিং নিয়ে সম্মানের সঙ্গে কাজ করবে, তোমার মাও নিশ্চয়ই খুশি হবেন।’
আমার কথা শুনে স্বপ্না হা হা করে হাসতে লাগল। আমাকে বলল, ‘আপনি কি জানেন, আমার প্রতিদিন ইনকাম কত?’
আমি বললাম, ‘কি করে জানব?’
সে বলল, ‘প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২০০০ হাজার। আমি সপ্তাহে পাঁচ দিন খাঁটি আর দুই দিন আরাম করি। ঘরে বসে মার সঙ্গে আকাশ-পাতাল গল্প করি। ভাইবোনদের সাফল্যে আনন্দে হাসি আর নিজের কষ্ট লুকিয়ে চোখ মুছি। আমি আর এ পথ থেকে ফিরতে পারব না।’
এই কথা বলে স্বপ্না নামের মেয়েটি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার সঙ্গে আরও আট বছর আগে কেন দেখা হলো না?’