স্বপ্নফেরি
হাইস্কুলের যখন ছাত্র ছিলাম, তখনই স্বপ্ন দেখতাম শিক্ষক হব। আর শিক্ষক যদি হই, তবে গ্রামের কোনো প্রাইমারি স্কুলেই পড়াব, এমন সিদ্ধান্তই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে জব করার জন্য আবেদন করলাম। প্রিলি, লিখিত, ভাইভা পরীক্ষা দিলাম। মামা-চাচা ছাড়াই চাকরিটাও হয়ে গেল। আমাদের নিজেদের দেশ সম্পর্কে অনেক বাজে ধারণা প্রচলিত আছে। এই ধরুন যেমন, মামা-চাচা কিংবা ঘুষ ছাড়া সরকারি চাকরি হয় না, হবে না! আমারও শুনতে শুনতে এমন ধারণা একদম হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল! বিসিএস দিতে গিয়েই বুঝলাম মেধার এখনো মূল্যায়ন এই দেশে হয়। ভাবতে ভালো লাগে! কিন্তু সে চাকরিতে যোগদান না করে গ্রামের একটি মিশনারি প্রাইমারি স্কুলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমার বন্ধু-স্বজন মোটেও খুশি ছিল না। আমার বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি পর্যন্তও গড়ায়। মেয়েটি আমার কাছে শুধুই একজন মেয়ে ছিল না, একটা অদ্ভুত স্বপ্নের মতো ছিল! সে যা-ই হোক, সে আমার জীবনের স্বপ্ন ছিল ঠিক, কিন্তু মানুষ গড়ার কারিগর হবার স্বপ্নের কাছে হার মেনেছিল আরেকটি স্বপ্ন!
বিসিএসে যোগদান না করার ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে গেল পরিবারের কানেও! এ নিয়ে বন্ধুমহলে হাসির রোল পড়ে গেল। টক অব দ্য ফ্রেন্ড সার্কেল তো বটেই, বন্ধুদের সীমানা পেরিয়ে অভিভাবক মহলে টপিকটার ঢেউ আছড়ে আছড়ে পড়ল! আমার বাবা প্রাইমারির টিচার। খুব কড়া প্রকৃতির মানুষ। তিনি খেপে গিয়ে আমাকে সালাম দিয়ে পাঠালেন।
দুই.
বাড়িতে ঢুকেই একটু হোঁচট খেলাম। ছোটখাটো বিচার সালিস-জাতীয় কিছু মনে হলো। কাঁধের ব্যাগ নামানো গেল না। অমনি আমার বাবা খেঁকিয়ে উঠলেন...
-তুই নাকি বিসিএসের চাকরিটায় জয়েন করছিস না? আমি ঠিক শুনেছি?
-না বাবা। জয়েন করছি না, তুমি ঠিক শুনেছ।
-তা কী করবে শুনি?
-বাবা, তুমি আমার ছেলেবেলার হিরো, বড়বেলারও হিরো! আমিও তোমার মতো প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করব...
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে প্রাইমারিতে পড়াবি? মাথা ঠিক আছে তো? মানসম্মান বোধটাও তোর নাই? সেলফ ডিগনিটি বলে একটা ইংরেজি শব্দ আছে, জানিস?
-এতে মান-সম্মানের প্রশ্ন আসছে কেন?
-ছি ছি ছি ছি। পাড়ার সবাই হাসাহাসি করছে। ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে বলছে।
-অন্যের বলাতে কী আসে-যায়?
-মুখে মুখে তর্ক করিস! লজ্জা নাই তোর? মানুষ হ মানুষ! তোকে নিয়ে আমাদের কত বড় স্বপ্ন ছিল। আজ সব শেষ হয়ে গেছে। সব শেষ!
-কোথায় তর্ক করলাম? আমি তো তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি...
-বিসিএসের চাকরিটা করবি না কেন? আমরা জানতে চাই? তোর চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে কেউ ম্যাজিস্ট্রেট আছে? না কখনো হবে?
আমি একটা লম্বা বক্তৃতা করলাম। বললাম...
-দেখো বাবা, সবারই জীবনের আলাদা স্বপ্ন থাকে। আমারও একটা স্বপ্ন আছে। আমি যদি এই চাকরিতে জয়েন করি, আমি ম্যাজিস্ট্রেট হব। গারো আদিবাসী আর মধুপুরবাসী গর্ব করে বলতে পারবে, আমাদের ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট! তারপর? একদিন ইউএনও, এডিএম, এডিসি, ডিসি হব! শেষ বয়সে গিয়ে হয়তো সচিব হব। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ হয়তো করার সুযোগ হবে। অনেক নাম কুড়াব। যা হব, তা আমি একাই হব। কিন্তু আমি মনে করি, আমি তা না করে শিক্ষক হলে আমি শত শত ছেলেমেয়েকে ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, সচিব বানাতে পারব! আমার ছাত্রছাত্রীরা মন্ত্রী হবে, দেশ চালাবে, পুরো পৃথিবী চালাবে। জাতিসংঘের মহাসচিব হবে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে তারা একদিন। তারা সারা পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। বাইবেলে বর্ণিত ‘গমের দানা’ না হয় আমিই হলাম। যাকে মাটিতে পড়তে হবে, মরতে হবে, তা না হলে ওই একটা বীজই থাকবে! আমি একা ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাই না। আমি চাই...
আমার কথা শেষ না হতেই আমার বাবা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল! আমার বুকটা শুকিয়ে গেল! আমি ভাবছি ঠাস করে চড় বসিয়ে দেবে না তো! কেমন বড় বড় চোখে তাকাচ্ছে! আজ বুঝি আর শেষরক্ষা হলো না। বৃষ্টি যখন অবধারিত, তখন সাথে ছাতা নেই এই ভেবে সময় নষ্ট না করে, বরং বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ উপভোগ করাই শ্রেয়! তাই আমিও মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম, উপায় যখন নেই, তখন চড় খাওয়াটা উপভোগ করাই বেটার হবে। সবার কপালে তো আর এই বয়সে চড় জোটে না!
নাহ্! বাবা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কঠিন মানুষটা একদম শব্দ না করে নীরবে কাঁদল! নীরব কান্না একটা আর্ট; সবাই তা রপ্ত করতে পারে না। আমার বাবা-মা দুজনই বোধ করি বড় আর্টিস্ট! তাদের কান্নার শব্দ কখনো শুনিনি! বাবা বেশ কিছুক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। তারপর বলল, ‘আমি খুব খুশি বাবা, তুই মানুষ হয়েছিস! অনেক বড় মানুষ হ। দোয়া করি। অনেক দোয়া করি। তোর শত শত ছাত্রছাত্রী সৎ ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, সচিব হোক! তোর ছাত্রছাত্রীরা সৎ মন্ত্রী হোক। জাতিসংঘের মহাসচিব হোক। পুরো পৃথিবী তোর ছাত্রছাত্রীদের আলোয় আলোকিত হোক!’
তাকিয়ে দেখলাম, সবার চোখে জল! আমার কারও চোখে জল দেখতে ভালো লাগে না! আমার ভেতরটাও হু হু করছে! যেন নিমেষে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তে। আমি সবাইকে এভাবে কাঁদাতে পারি, কষ্ট হচ্ছে বিশ্বাস করতেও। খুব কষ্ট হচ্ছে।
চুপি চুপি একবার মায়ের দিকে তাকালাম! এবার আমার মা-ও কান্নাকাটি শুরু করে দিল। সে কান্না আনন্দের কি দুঃখের বোঝা গেল না। আমি ভাবলাম তাকে বলি, ‘মা, আমি আর মাস্টারি করব না। তোমাদের ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।’ কিন্তু বলা হলো না। আমার ছেলেবেলার স্বপ্ন আমি গ্রামের কোনো প্রাইমারি স্কুলের টিচার হব। আমার হৃদয়জুড়ে সে স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে। হয়তো বাবাকে ছেলেবেলা থেকে দেখে দেখেই। এ স্বপ্ন সকলের একদিনের কান্নার বানে ভেসে যাবার নয়! ভালোবাসা বানে ভেসে যায়, স্বপ্ন চিরঞ্জীব। স্বপ্ন বানে ভাসে না, চৈত্রের খাণ্ডব দাহনে শুকোয় না, ‘স্বপ্ন মরে না কখনো!’
তিন.
জলছত্র মিশনের উত্তর-পূর্ব পাশের শালবনের মাঝখানে একটা গ্রাম। মায়াময় শ্যামলে-সবুজে ঢাকা। গ্রামের নাম গায়রা। কেমন কোমল কোমল নাম। গায়রা। এ নামে কেমন একটা মাদকতা আছে, আছে অসম্ভব এক ভয়াবহ দৃঢ়তা। গায়রা। অদ্ভুত সুন্দর! মিশন থেকে গ্রামের দূরত্ব চার-পাঁচ মাইল হবে বোধ করি। ২৫ মাইল থেকে একটা তিন চাকাওয়ালা ভ্যান ভাড়া করলাম ১০ টাকায়। এর আগে ভ্যানে চড়া হয়নি। এবারই প্রথম। রিকশা থেকে বেটার। বেশ আরামপ্রদ। ভ্যান এগিয়ে চলছে। রাস্তার দুই পাশে গভীর, ঘন কালো শালবন। এ যেন অপরূপ রূপের শাল-অরণ্য। যে আমাকে ছেড়ে গেল, সে এই শাল-অরণ্যের মেয়ে। এই সবুজ শাল-অরণ্যে সে আর হয়তো ফিরে আসবে না; আমি এখানে আসি, সেটাও সে চায় না! এই একটি মতপার্থক্য ছাড়া জীবনের ৯৯টি মতের মিল ছিল আমাদের। শুধু এই একটি মত, একটি স্বপ্ন আমাদের চিরজীবনের জন্য আলাদা করে ফেলল! দীর্ঘ সাত-আট বছরে প্রেম কত ঠুনকো বিষয়। ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন ডুবে গেলাম। কী সব ভাবছি? অতীত সময় নষ্ট করছি কেন? কেন?
আমার আজকের দিনটি উপভোগ করা উচিত। উচিত! শাল-অরণ্যে কত রকমের পাখি গান করে চলেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি! সব ছাপিয়ে ঘুঘুর ডাকটা কানে লাগছে খুব। কত সুরেলা আর করুণ সুরে বিরহের গান গেয়ে চলেছে একাকী! ঘুঘুটিও কি আমার মতো একা? বুকের ভেতর কি তারও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে? আহ্! কী সব ভাবছি আমি আবার?
রাস্তার দুই পাশে প্রাণ-বৈচিত্র্যের মেলা। শত শত প্রজাতির গাছ, লতা-গুল্ম এই মধুবনে। আর তার মাঝখান দিয়ে আমি আর ভ্যানচালক দুজনে টেলকি নামক গ্রামের দিকে যাচ্ছি। টেলকি থেকে গায়রার দূরত্ব মাইলখানেক হবে শুনেছি। আমার হাতে কবি আবুবকর সিদ্দিকের ছোটগল্পের একটা সংকলন। বইটির ‘শালবন ধর্ষণ’ গল্পটি পড়ছিলাম এখানে আসার আগে। মধুপুর, জলছত্র, টেলকি, নয়াপাড়া, গায়রা, কাকড়াগুনি, বেদুরিয়া, সাধুপাড়া, জয়নাগাছা এলাকার গারোদের জীবনসংগ্রাম, বন বিভাগের নির্বিচারে বন ধ্বংস, আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অজস্র মিথ্যা মামলা, তাদের ভূমি, জীবনসংস্কৃতি স্বয়ং সরকার কর্তৃক ধ্বংস করার নীলনকশা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে গল্পটিতে। পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসছিল!
নিজেকে বোঝাই, ছেলেমানুষকে কাঁদতে নেই। যা আমার বাবা সব সময় বলতেন! আমি সব ফেলে, সব হারিয়ে গ্রামে ফিরছি এই সব থেকে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবার জন্যেই! ছোটখাটো সেনাপতি গোছের আমিও! সেনাপতিরা কাঁদে না! মনে মনে বলি। মন কি আর কথা শোনে!
চার.
টেলকি পৌঁছেই একটা ছোট ধাক্কা খেলাম। আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য গ্রামের একুশ জন এসেছেন। গ্রামের মাতব্বরসহ এঁরা সবাই এসেছেন হেঁটে। যাঁদের বাড়িতে আমার থাকার আয়োজন, সে বাড়ির কর্তা জীপেন তালুকদার নিজে এসেছেন। তিনি আমার সাথে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘আমি জীপেন পল রুগা। সবাই জীপেন তালুকদার বলেই চেনে! আপনার যাতে কষ্ট না হয়, আমরা দেখব। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না!’ সাথে তাঁর সাত-আট বছরের একটা পিচ্চি ছেলে। আপেলের মতো লাল দুটো গাল। গোলগাল চেহারা। বোকা বোকা চাহনি। পাপোশের মতো ঘন, কালো চুল!
আমি ভ্যান থেকে নামতেই সবাই নমস্কার দিল। পিচ্চিটা নমস্কার দিয়ে হাতটা নমস্কারের ভঙ্গিতেই বুকের কাছে রেখে দিয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে! আমি তাকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম...
-তোমার নাম কী?
-রৌদ্র
-বাহ্! খুব সুন্দর নাম।
-থ্যাংকয়্যু
-ওয়েলকাম
-কিসে পড়ো তুমি?
-ক্লাস ওয়ান পাস করেছি। টু পড়ব...
-তুমি তো অনেক বড় ক্লাসে পড়ো!
-আমার দিদি আরও বড় ক্লাসে পড়ে...
কথাটা শুনে হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু হাসলাম না। কথা শুনে রৌদ্রকে মেধাবী মনে হলো না মোটেও। এমন বোকা একটা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে ভেবে একটু চিন্তান্বিত হলাম।
আমি অবাক হলাম। বোকা বোকা চেহারার ছেলেটাই ক্লাস টুর ফার্স্ট বয়! যত দিন যায়, তত এই বোকা ছেলেটার মধ্যে নিজের ছবি দেখি! খেয়াল করলাম, সে পাঠ্যবইয়ের বাইরে কিছু বই পড়ে, যা ওই বয়সের অন্য ছেলেমেয়েরা পড়ে না! এই যেমন কমিকস, কার্টুন, সিন্দাবাদ, রাক্ষস কক্ষসের গল্প, রহস্য পত্রিকা, ভবেশ রায়ের লেখা বই, গোপাল ভাঁড়ের কমিকস, ছোটদের রবীন্দ্রনাথ, ছোটদের শেকস্পিয়ার-এই সব! কোত্থেকে সে এসব বই পায়? সে-ই আমাকে বলল, ‘আমার মেজ মামা ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে চাকরি করে। সে-ই আমাকে এগুলো পাঠায়।’ ওর মামার নাম অমল নকরেক। এই অমল নকরেকের অনেক গল্প আমি রৌদ্রের কাছেই শুনেছি। তাঁর তিন ভাইকে মানুষ করার জন্য তিনি স্কুল শেষ না করেই টেকনিক্যাল স্কুলে পড়ে ঢাকায় চাকরি করে ভাইদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। সমাজে অনেক উঁচু স্থানে তাঁদের অবস্থান। সে বলে, ‘আমার মামা যা ভবিষ্যদ্বাণী করে, সব অক্ষরে অক্ষরে ফলে, জানেন?’
-না বললে জানব কী করে?
-হ্যাঁ, আমার মামা সারা দিন সময় পেলেই বই, পত্রিকা পড়ে। সে সব জানে!
-তাই?
-জি স্যার।
-তা তোমার সম্পর্কে তাঁর কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নাই?
-আছে...
-কী সেটা?
-আমি বড় হয়ে ব্যারিস্টার হব...
-তা তোমার কি ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছে আছে?
-নাহ্।
-তাহলে!
-কিন্তু মামা বলছে তো, ইচ্ছে না করলেও হয়ে যেতে পারি!
-ও মা! কেমনে?
-আমি তো ফাদার হব! আবার না-ও হতে পারি। ফাদাররা বই পড়ার সময় পায় না। আমার তো বই ছাড়া চলবে না। মূর্খ হয়ে বাঁচার থেকে না বাঁচা ভালো! তাই না, স্যার? আর তারপর ব্যারিস্টার যদি হতেই হয়...
ওর কথা শেষ হয় না। মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে নিজেকেও ওর সাথে কথা বললে!
পাঁচ.
বছর কেটে গেল গায়রা গ্রামে! তালুকদারবাড়িতে আমার দিন খারাপ কাটছে না। মাটির তৈরি দোতলা বাড়ি। আমি আর রৌদ্র থাকি দোতলায়। অসম্ভব সুন্দর বাড়ি। শাল-শোড়শীর তক্তা দিয়ে তৈরি আমাদের ঘরের মেঝে। অদ্ভুত সুন্দর। অদ্ভুত। তালুকদার সাহেবের সৌন্দর্যপ্রিয়তা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর তাঁদের শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখে কেবলই ছেলেবেলার কবিতা, ‘শিক্ষকের মর্যাদা’র কথা বারবার মনে পড়েছে।
আমার সাথে পিচ্চিটার বেশ বন্ধুত্ব। ক্লাসে আমি তার শিক্ষক বটে, কিন্তু বাসায় আমরা বন্ধু! ধীরে ধীরে সে শুধু আমার হৃদয়ে জায়গা করে নেয় নাই, আমার শোবার ঘরেও তার ঘুমানোর খাট রাখবার জায়গা করে নিয়েছে এত দিনে!
একটা বিষয় খেয়াল করলাম তার। রাত হলে সে একা হাঁটে না! ঘুমাতে গেলে লাফ দিয়ে খাটে ওঠে। ঘুম থেকে উঠে খাট থেকে লাফ দিয়ে! আর এত শব্দহীন লম্ফ সে রপ্ত করেছে, বলা বাহুল্য। লক্ষ করলাম খুবই ভিতু ছেলেটা। রাতে চেয়ারে পা তুলে বসে। তার ধারণা, চেয়ারের নিচে কত কী থাকে! পা টেনে ধরতে পারে! খাটে লাফ দিয়ে উঠলে নিরাপত্তা বাড়ে! এক শীতের রাতে তাকে খুব অস্থির অস্থির লাগল, খুব। কী হয়েছে জানতে চাইলাম। সে বলল, ‘কিছু হয়নি।’ তোমাকে অস্থির দেখাচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নে শান্ত হয়ে বলছে, ‘কই স্যার! আমি তো খুব স্থির আছি।’
আমি আর রৌদ্র দোতলায় ঘুমাই। সে সাধারণত রাত সাড়ে নয়টা বা দশটায় ঘুমাতে যায়। এক রাতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ঘুমিয়ে পড়ল! একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি। আবার ভাবলাম, ছেলেমানুষ। হয়তো ক্লান্ত! তাই আর ডাকাডাকিতে গেলাম না! রাত চারটায় চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল। কেউ একজন চিৎকার করে সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিল! কিছুটা বিরক্ত হয়ে বাইরে এলাম। প্রায় আধা মাইল দূরের এক বুড়ো নানা গলা চড়িয়ে কথা বলছেন রাত চারটায়! তার গলার স্বরে আশপাশের পরিবারগুলোর লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। বোঝার চেষ্টা করলাম, কী ঘটনা! নানার কথা শুনে সবাই হাসাহাসি করছে। আমারও হাসি পেল। তিনি বলছেন:
-আমি নিজের চোখে দেখেছি, রৌদ্র আমার খেজুরগাছে উঠে খেজুরের রস...
-আমার ছেলে এই রাত চারটায় আপনার খেজুরের গাছে...। কোনো দিন না, কোনো দিন ন...
-আমি দেখেই বলছি
-আপনি ভুল দেখেছেন। আপনি ভুল দেখেছেন। ভুল দেখেছেন। ভুল...
-আমি ভুল দেখিনি! আমি এখনো চশমা পরি না...
-রৌদ্র রাতের বেলা একা ঘরেই ঢোকার সাহস পায় না, সে ঘুমানোর আগে খাটে লাফ দিয়ে উঠে পাছে খাটের নিচে ভূত পা-টা টেনে ধরে! আর এই ছেলে রাত চারটায়...না না না না, হতেই পারে না। আপনারাই বলেন, ছেলেটা এখনো ঘুমাচ্ছে, আর উনি বলছেন আমার ছেলে তাঁর খেজুরগাছে...
রৌদ্রর বাবা ওর মাকে থামাতে যায়। ‘আহা! তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? ছেলে অন্যদের সাথে যেতেও তো পারে...
-তুমি তাল দিয়ো না। আমার ছেলে কী পারে আর কী পারে না আমি জানি না? আট বছরের একটা ছেলে রাত চারটায় একা যাবে খেজুরের রস পাড়তে! গল্প শুনতে ভালো লাগে না...
উপস্থিত কেউ সে গল্প বিশ্বাস করেনি। সারা গ্রামের মানুষও না। আমি দোতলায় গিয়ে দেখলাম ছেলেটা নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে! কিন্তু সারা গ্রাম তাকে নিয়ে ঘটনায় তোলপাড়!
পরের দিন টক অব দ্য ভিলেজ ছিল রৌদ্রের কাহিনি। বুড়ো নানা দোকানপাতে গিয়ে কাহিনি বলছেন আর সবাই এ নিয়ে হাসাহাসি করছে। কেউ বিশ্বাস করছে না তাঁর কথা। কিন্তু তিনিও দমবার পাত্র নন। বেলা ১১টার দিকে নানা স্কুলে এলেন। তিনি বললেন...
-মাস্টার মশাই, আমাকে সবাই পাগল বলছে! আপনার কী মনে হয়, আমি পাগল?
-না, আপনি তা নন...
-আপনার ছাত্র গত রাতে...আপনি বিশ্বাস করেন?
-অসম্ভব কিছু না। কিন্তু নিশ্চয়ই আরও কেউ সাথে ছিল?
-না, আমি তাকে একাই দেখেছি...
-সেটা অসম্ভবের কাছাকাছিই বটে!
-আপনি আপনার ছাত্রকে ডাকুন। তার মুখ থেকেই শুনি!
অগত্যা আমি ছাত্রকে ডাকলাম। ছাত্র শান্ত গলায় বলল, ‘স্যার, আমি তো কিছু জানি না! আমি না আপনার রুমেই ঘুমিয়েছি? আপনি দেখেননি?’
-হ্যাঁ, তাই তো! কিন্তু উনি যে বলছেন...
-আমি কেন যাব? আমি তো ঘরের ভেতরেই...
-ঠিক আছে, তুমি যাও...
আমি নানাকে বললাম, দেখুন, সে অনেক ছোট। সন্ধ্যার পর সে একা ঘরেও ঢোকে না ভয়ে! আর সে একা আপনার ওখানে খেজুরের রস...? কেমন খটকা লাগছে না?
-কিন্তু আমি তো তাকে দেখেছি!
-আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি কোথাও ভুল করছেন...
-না মাস্টার, আমি ভুল দেখিনি, ভুল বলছি না, ভুল করছি না...
-আপনি আবার ভেবে বলুন!
-দেখুন মাস্টার, শুনেছি আপনি খুব বিদ্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাড়াইয়া আইসেন এইখানে, মাস্টারি করছেন ওজপাড়াগাঁয়ে! আপনার তো দেখি জীবন ১৬ আনা মিছা!
-মানে?
-কী পড়ান ছাত্রদের? সব চোর-ছুটটা বানাইতেছেন, মানুষ তো বানাইতে পারছেন না! কী লাভ? শহরে ফিরে যান। সরকারি চাকরি করেন, ঘুষ খান। যত্ত সব...
এই বলে তিনি হনহন করে হেঁটে গেলেন। তাঁর কথায় মনে হলো, সরকারি চাকুরে সবাই ঘুষ খায়! আমি তাঁর যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখলাম...বুক চিরে একটা আকাশসম দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল...ইশ্! এই সময় যদি সে পাশে থাকত! কারণে-অকারণে মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে পড়ে। তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে! সে কি তা বোঝে? বুঝবে কি কোনো দিন? বুকের ভেতরটা সমুদ্রসমান ফাঁকা ফাঁকা লাগে!
ছয়.
পরের দিন রাতে সারা রাত ঘুম হলো না আমার। এপাশ-ওপাশ করে রাতটা কাটল! মেয়েটার কথাও একটু মনে পড়ল! হায় মেয়ে! বেচারি জানলই না সে কী হারিয়েছে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল হৃদয়ের গভীর থেকে। সে দীর্ঘশ্বাস বলে বোঝানোর মতো নয়। আমি ভাবি, আমি ভুল করলাম না তো? মেয়েটি কি সত্যি সত্যি আমাকে ভুলেই গেল? ভালোবাসা কি এমনই ঠুনকো বিষয়? কত চিঠি লিখলাম, একটিরও উত্তর করেনি সে আর! ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করেছে শুনে অভিনন্দিত করে কার্ড আর এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা পাঠিয়েছি, কিন্তু জবাব আসেনি! এত এত রাগ আর অভিমান সে কোথায় রাখে? আমি ভাবি আর ভাবি! প্রতীক্ষা করি মেয়েটির মান ভাঙবে একদিন। সে ঠিক ঠিক আবার ফিরবে তার নিজস্ব ঠিকানায়...
ভোর হয়ে এল। কাকডাকা ভোর। পাখির কলতানে মুখর পুরো গ্রাম। একটি অস্থির চিত্ত আমার দিকে তাকিয়ে! আমি ডাকলাম ‘মেঘ’, কিছু বলবে?
-স্যার, আমাকে আমার মা ছাড়া এই নামে অন্য কেউ ডাকে না! আপনি কেমনে জানলেন আমার আরেকটা নাম আছে?
-আমি সব জানি, তোমার আরেকটা নাম আছে, রোদ্দুর!
-আপনি আমার এই নামটাও জানেন, স্যার?
-আমি তোমার আরও অনেক কিছু জানি?
-ও! স্যার আপনার আজ ঘুম হয়নি? শরীর খারাপ?
-না। ঠিক আছি। তোমার ভালো ঘুম হয়েছে?
-না স্যার। আমি সারা রাত আজ চোখ বন্ধ করে রাত পার করেছি।
-কেন? কী হয়েছে তোমার? মাথাব্যথা করছিল?
-না, স্যার। আচ্ছা স্যার, আপনার কি মনে হয় আমি খেজুরের রস চুরি করার জন্য ওই রাতে গিয়েছিলাম?
-না, একদম নাহ!
-কিন্তু স্যার, আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি সেটা কাউকেই বলতে পারছি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে স্যার...এই বলে ছেলেটি ঝরঝর করে কেঁদে দিল। আমি তার মাথায় হাত রেখে বললাম, এই তো আমি তোমার সাথে। আমাকে বলো আসলে সে রাতে কী হয়েছিল? আমার ধারণা, রৌদ্র সে রাতে সেখানে যায়নি। সে এখন হয়তো একটা গল্প বলবে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কে কে ছিলে তোমরা?
-প্রশান্ত, অনন্ত, ওয়ালজান, পল, রন, জন, সালজং, সালান্তি, তপু, তূর্য, রবীন সবাই ছিল।
-কিন্তু বুড়ো নানা যে বলল তুমি একাই ছিলে?
-উনি যখন আমাকে দেখেন, তখন আমি একাই ছিলাম...
-মানে!
-আমরা এক সপ্তাহ আগে নানার কাছে খেজুরের রস খেয়ে দেখার আবদার করেছিলাম। তিনি আমাদের তাড়া করেছিলেন। তাই আমরা সেদিন টিফিনে একটা প্ল্যান করি...
-তার মানে?
-আমরা চুরি করার প্ল্যান করি। এবং চুরি করে সবাই চলেও আসি!
-মাই গড! তারপর?
-স্কুলমাঠে এসে পল বলল, ‘শালা বুড়া, কালকে আসল খেজুরের রস খাও! আমাদের সাথে চালাকামি!’ আমি তার মানে জানতে চাই। সে বলল, ‘আমি খেজুরের পাত্রে হিসি দিয়ে আচ্ছি!’
-কী বলো তুমি!
-জি স্যার।
-হুম! তারপর...
-ওরা সবাই চলে গেল...
-তারপর...
-তারপর আমিও বাসায় এলাম। কিন্তু ঘুমুতে পারছিলাম না। আমাদের বুড়ো নানা সকালে...খাবে ভেবে ভেবে কান্না আসছিল। তাই আমি একাই সেটা ফেলতে গিয়েছিলাম...
-বলো কী!
বাকি অংশ ৪৩ পৃষ্ঠায়
৪২ পৃষ্ঠার পর
-জি স্যার। ফেলতে গেলে পাতিলটা মাটিতে পড়ে গিয়ে শব্দ হতেই নানা আমার চোখে...
-কিন্তু তুমি তো খুব ভয় পাও একা!
-সেদিন থেকে আমার আর ভয় কাজ করে না...
-ভেরি গুড! রৌদ্র আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়। তার পুরো চোখের আকাশজুড়ে মেঘবৃষ্টি! আমি ছেলেটারে কাছে টানি। আমার হাতের ছোঁয়ায় ঝড়ের তীব্রতা বাড়ে। দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে! আমি অসহায়ের মতো শুধু তার মাথায় হাত রাখি...
সাত.
দুপুরবেলা রৌদ্রকে বললাম, ‘চলো, বুড়ো নানার ওখানে যাই।’ সে বলল, ‘আমার যেতে ইচ্ছে করে না।’
-তুমি সরি বলো, উনি অনেক বড় মানুষ।
-জানি স্যার। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না...
অনেক বুঝিয়ে রাজি করালাম তাকে। সে ক্ষমা চাইবে। পা ধরেই ক্ষমা চাইবে। কারণ, খেজুরের রস খাওয়ার আইডিয়াটা ছিল তারই! আর আমারও বুকের ভেতর খচখচ করছে। আমি শুধু চোর বানাই, মানুষ বানাতে পারি না! আমার জীবন ১৬ আনা মিছে। এসব কানে সারাক্ষণ যন্ত্রণা করে! আমি রৌদ্রের মতো সাহসী ছেলেও বানাই এইটা প্রমাণ করার খুব সাধ মনে। আমরা তৈরি হয়ে বের হব নানাবাড়ি যাওয়ার জন্য। ঠিক এমন সময় ঘণ্টার আওয়াজ শোনা গেল। মিনিট দুই পর জানলাম নানা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন না ফেরার দেশে!
এগুলো অনেক বছর আগের কথা...
আমি মাস্টারি ছেড়ে বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে এসেছি। খুব কাছের মানুষেরা আমাকে গাড়িচাপা দিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছে কিছু রাজনীতিবিদের সাথে হাত মিলিয়ে! আমার বন্ধু অনিন্দ্য এনএসআইয়ের জাঁদরেল অফিসার। সে-ই আমাকে কিছু কথোপকথনের রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছে আমাকে মারতে পারলে কে কত টাকা ভাগে পাবে! এর জন্য যা যা করা দরকার তারা করবে। ওপর মহল টাকা ঢালবে। একাধিক রাজনৈতিক দল পেছনে থেকে কাজ করবে। সামান্য কিছু টাকার লোভে খুব কাছের কিছু মানুষ তাদের সাহায্যের হাত বাড়ায়! এই সব মানুষের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসায় একটা ছোট্ট অভিমান নিয়ে আমি দেশ ছাড়ি! তত দিনে একিউট এপিক্সট্যাক্সিসটা ক্যানসারে রূপ নিয়েছে! খোদা চায় নাই, কেউ আমার খুনি হোক! ক্যানসার হলে কি কেউ বাঁচে? আমার মনে হয় আমি বেঁচে যাব! মারা গেলেই ভালো হতো খুব। আমার মনে হয়। মেয়েটার একটা শিক্ষা হতো!
এই সব পাগলের চিন্তায় ঘুম আসছিল না। তাই ফেসবুকে ঢুকেছিলাম। একটা স্কাইপ রিকোয়েস্ট এল ‘শূন্যমেঘ মারাক’। মারাক লেখাটা দেখেই গ্রহণ করি। আর সে অবাক করে দিয়ে আমাকে স্কাইপে কল দিল! আমার এক এক করে ফেলে আসা সোনালি দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। হৃদয়টা হু হু করল। ছেলেটি বলল,
-নমস্কার স্যার, ভালো আছেন?
-নমস্কার। কে তুমি?
-আমি রৌদ্র মারাক! আপনার ছাত্র।
-ও মাই গড! রৌদ্র! কোন রৌদ্র? রৌদ্র মারাক?
-জি স্যার। আমাদের কথা আপনার মনে আছে?
-মনে থাকবে না কেন? কী খবর? কী করছ? পিএইচডি করার জন্য দেশের বাইরে আছ শুনছিলাম একবার। তারপর তোমাদের আর খোঁজ পাই না।
-না স্যার, আমি পিএইচডিটা এখনো শেষ করতে পারিনি! কিন্তু বার-এট-ল শেষ করেছি।
-অভিনন্দন ব্যারিস্টার রৌদ্র! অমল মামার ভবিষ্যদ্বাণী তাহলে অব্যর্থ?
-থ্যাংক ইউ, স্যার! আমি বিসিএসে কোয়ালিফাই করে ফরেন মিনিস্ট্রিতে জয়েন করেছি বছর পাঁচেক আগে! এখন নিউইয়র্কে পোস্টিং। জাতিসংঘে আদিবাসী-বিষয়ক সেমিনারগুলোতে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে আমি এখন অ্যাটেন্ড করি বাংলাদেশ সরকারের হয়ে! আমরা আপনার স্বপ্ন এক এক করে পূরণ করে চলেছি, স্যার!
-আসকি, বালশ্রী, সিল্গা, আব্রি, সিলচি, সালান্তি, তূর্য, রবি-ওদের খবর কী?
-আসকি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এখন। সিল্গা জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। আর বালশ্রীর কথা তো জানেনই মনে হয়। সে লন্ডনে থাকে। ওখানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে পলিটিকস করত। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সিনেটর এখন। আব্রিও তো জাতিসংঘে জয়েন করছে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে আগামী মাসে, জানেন?
-ও মা! আদিবাসী ছেলেমেয়েরা অনেক এগিয়ে গেল! এই খবর তো আমি রাখিনি...
-স্যার, আরও কত কত ভালো খবর আছে! জানেন?
-না তো!
-তূর্য এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ায়। হোয়াইট হাউসে তাঁর অবাধ যাতায়াত। প্রেসিডেন্টের আইটি-বিষয়ক উপদেষ্টা!
-তাই নাকি! কী বলছ?
-স্যার, ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালের এডিটর তো মান্দি মেয়ে, জানেন?
-তাই নাকি! কে এই মেয়ে? ওর নাম অদ্রি সাংমা। আপনার ছাত্রী কিন্তু সে-ও।
-আর সিলচির সাংমার কথা জানেন, স্যার?
-নাহ!
-সে যুগ্ম সচিব ছিল। আমার মামা জর্জ নকরেকের মেয়ে। এবার মধুপুর টাঙ্গাইল-১ আসন থেকে এমপি হলো! শিক্ষামন্ত্রী হতে পারে বলে পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। সে-ও কিন্তু পিএইচডি করা পাবলিক!
-একজন বাঙালি ছেলে ছিল না তোমাদের ক্লাসে? তপু রাহমান?
-ও হ্যা স্যার। তার মা কিন্তু গারো, জানেন স্যার? সেই তো এখন প্রধান ইলেকশন কমিশনার! আর আমাদের রবিই তো চিফ জাস্টিস রবীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ। তিনি এখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি! একজন আদিবাসী ছেলে চিফ জাস্টিস! ক্যান ইউ ইমেজিন স্যার? আপনি যখন আমাদের এই সব স্বপ্ন দেখাতেন, সবাই হাসাহাসি করত, মনে আছে স্যার? এখন সব সত্যি, সব স্বপ্ন এখন সত্যি। স্যার, শুনতে পাচ্ছেন?
-আর রুনা খন্দকার নামের আরেকজন বাঙালি মেয়ে ছিল যে!
-ও তো এখন স্পেনে। সে-ও তো সিনেটর!
-একজন চাকমা ছেলে ছিল...
-জি স্যার, উচি মং? সে তো এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পরিচালক! জানেন না স্যার?
-পত্রিকায় নাম দেখি। কিন্তু এরা যে সব আমার ছাত্রছাত্রী, তা চিন্তাও করিনি! পল নামের ছেলেটা?
-সে তো বিশপ ছিল হালুয়াঘাট ডায়োসিসের। বাংলাদেশ থেকে যে প্রথম কার্ডিনাল হচ্ছে, ওই তো আমাদের পল সাংমা, স্যার! আর ময়মনসিংহ নটর ডেম কলেজের প্রিন্সিপাল নকরেক ওয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর তিন আগেই আইন বিভাগে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছিল। ব্যারিস্টারি শেষ করে ফিরল লন্ডন থেকে গত মাস! শোনা যাচ্ছে ভিসি হয়ে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য লিখে দেওয়ার কাজ সে-ই তো করে আসছে! ওই যে স্যার যে সব সময় বিতর্কে আমাকে হারিয়ে দিত! বিরিশিরিটাও ডায়োসিস হয়ে যাবে, জানেন?
-কেউ বলেনি এসব আমাকে!
-আর প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকাতেই আপনার স্টুডেন্ট আছে। টাইমস ম্যাগাজিনেও তো ডেপুটি এডিটর আচিক ছেলে!
-ও! পুলিশ, সেনাবাহিনীতে কেউ নেই?
-কত আছে স্যার। টাঙ্গাইল আর ময়মনসিংহ জেলার এসপি তো আমাদেরই ক্লাসমেট। আর সেনাবাহিনীতে ওয়ানগালা চিরান আর ওয়ালজান আছে।
-আমি সেই কবে দেশ ছেড়েছি! আসলে দেশের খবর রাখিনি আর... আচ্ছা, সালজং নামের একটি ছেলে ছিল, তোমাদের সিনিয়র; সে কী করে?
-উনিই তো স্পিকার এখন স্যার!
-আর চৈতালি? চৈতালি ত্রিপুরা নামের মেয়েটি?
-উনিই তো এখন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভানেত্রী! এবার তো আদিবাসী ফোরাম যাকে সমর্থন দেবে, সেই দলই সরকার গঠন করছে! মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলই সরকার গঠন করবে এবারও! এমন হলে চৈতালি যদি প্রধানমন্ত্রীও হন, অবাক হবার কিছু নেই, স্যার!
-তোমরা তো পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছ দেখছি!
-জি স্যার। সব তো আপনার ত্যাগ আর সীমাহীন ভালোবাসার ফসল!
-পাগল ছেলে। তুমি ট্র্যাকের বাইরে চলে যাচ্ছ!
-সরি স্যার। স্যার আগামী বছর তো জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিবের সেকেন্ড টার্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। ডিপ্লোম্যাটিক জোনে কিন্তু সিলগার নাম খুব আলোচিত। আমরা পেয়েও যেতে পারি বাংলাদেশ থেকে একজন মহাসচিব স্যার, দোয়া করবেন! আপনি স্বপ্ন দেখতেন না একদিন বাংলাদেশি আচিক ছেলে বা মেয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব হবে? আমার মনে হয়, আমরা সে স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে!
এবার আমি সত্যি কেঁদে উঠলাম! অবন্তীকে হারিয়েও আমি কাঁদিনি! দুঃখিত, আমি এই নাম কাউকে জানাতে চাইনি; মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল! আমি সত্যি কাঁদছি। সুখে-দুঃখে, ধনে-দারিদ্র্যে, স্বাস্থ্যে-অস্বাস্থ্যে আজীবন একে অপরকে ভালোবাসার স্বপ্ন নিয়ে আমরা যে শপথ করেছিলাম, আমরা তা রক্ষা করতে পারিনি! আমি, আমার ভেতরটা কাঁদছে আর কাঁদছে! এই কান্না একটি স্বপ্ন হারিয়ে অনেক স্বপ্ন খুঁজে পাওয়ার কান্না কি না, জানি না! ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’ বলে নিজেকে বোঝাতে গিয়েও আর বোঝাতে পারিনি! আজ নিজেকে দিয়েই বুঝলাম ছেলেমানুষেরাও কাঁদে...
আসলে আজ আমার কাঁদবারই দিন। বাড়ির বাইরে বের হয়ে দেখি আকাশজুড়ে আজ জোছনাবৃষ্টি। এতটুকু মেঘ নেই আজ। মনের অজান্তে আমি হারিয়ে যাওয়া একটি স্বপ্নের হাত ধরি! গুনগুন করে গেয়ে চলি, ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে...
পুনশ্চ: গল্পটির কাহিনি ও চরিত্রগুলো কাল্পনিক। কারও জীবনের সাথে সামান্যতম মিলে গেলে তা নিতান্তই কাকতাল মাত্র।