স্বপ্নপূরণ

সুইজারল্যান্ডের সুন্দর গ্রাম
ছবি: সংগৃহীত

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আমার মায়ের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল। মাকে দেখতে ছুটে গিয়েছিলাম সুদূর আমেরিকায়। দিন পনেরো পর যখন মা একটু সুস্থ হয়ে উঠল, আমার চলে আসার সময় হয়ে গেল। আসার দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছিল আর বলছিল,
-আর কি দেখা হবে?
আমি বলেছিলাম,
-অবশ্যই দেখা হবে। তোমার অনেক কিছু দেখার আছে, জানার আছে। তুমি বলেছিলে সুইজারল্যান্ড তোমার স্বপ্নের দেশ, পৃথিবীর স্বর্গ! আর একটু সুস্থ হলেই তোমাকে তোমার স্বপ্নের দেশে নিয়ে যাব।

বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য ভাইয়ার গাড়িতে উঠে বসলাম। মা গ্যারেজের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বারবার চোখ মুছছে। গ্যারেজের অটোমেটিক দরজা নিচে নামতে শুরু করল, মা ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হতে লাগল। চোখের পানিতে আমার সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল।

ভাবলাম, আবার কি দেখা হবে!
যদি আবার দেখা হয়, তবে আমার মায়ের একটা স্বপ্ন আমি পূরণ করব। তাকে তার স্বপ্নের দেশে নিয়ে যাব।

নিজের মনে নিজেকে প্রতিজ্ঞা করলাম।
পারব তো?
এর পরের বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে মা আমার কাছে লন্ডনে বেড়াতে এসেছিল। খুবই দুর্বল মনে আর শরীরে। এক দুপুরে বললাম,
—এখনো ইচ্ছে আছে তোমার স্বপ্নের দেশে যাওয়ার?
মা বলল,
—এত সৌভাগ্য কি আমার হবে?
আমি বললাম,
—গরম কাপড় গুছিয়ে নাও। কাল যাব তোমার ভূস্বর্গে!
মা আনন্দে কেঁদে ফেলল।

পরদিন সকালে আমরা হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে রওনা দিয়ে বেসেল এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। এ এয়ারপোর্টটি বেশ মজার। তিন নদীর যেমন মোহনা থাকে, ঠিক তেমনি এই বেসেল হলো তিন দেশ ফ্রান্স, জার্মানি আর সুইজারল্যান্ডের মিলনস্থল। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলে করিডোরটা তিন দিকে ভাগ হয়েছে। সাইন দেওয়া আছে, ডান দিকে গেলে জার্মানি এক্সিট, বাঁ দিকে গেলে ফ্রান্স আর সোজা বের হলে সুইজারল্যান্ড।

আমরা সোজা বের হলাম। এরপর গেলাম রেলস্টেশনে। আমাদের গন্তব্য গ্রিন্ডারওয়াল্ড। ওখানে একটি আ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছি চার দিনের জন্য।

পাহাড়ি এলাকায় ঝপ্ করে রাত হয়ে যায়। আরেক ট্রেনে চললাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্টেশনে এসে পৌঁছালাম।

সেখানে আমাদের বাড়িওয়ালা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এতগুলো স্যুটকেস, ছেলেমেয়ে আর মাকে নিয়ে আমার আর আমার বরের অস্থির অবস্থা। বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখে বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করলাম।
পৌঁছালাম পাহাড়ের ঢালে আমাদের ভাড়া করা বাড়িতে।

এত ঘুটঘুটে আঁধার!
কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। গাড়ি থেকে নামার সময় শুধু মিষ্টি টুংটুং শব্দ পেলাম। কিন্তু শব্দ কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারছিলাম না। বাড়িওয়ালার স্ত্রী আমাদের তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিলেন। ষাটোর্ধ্ব অমায়িক হাসিখুশি একজন মানুষ। সমস্যা একটাই, একেবারেই ইংরেজি বোঝেন না। জার্মান ভাষায় কথা বলেন। তবে আমরা হাত–পা নাড়িয়ে, এটা সেটা দেখিয়ে ঠিকই কাজ চালিয়ে নিলাম। অনেক দেশে ঘুরে একটা জিনিস শিখেছি, ভাষা আর দেশ ভিন্ন হলেও ভালো মানুষের সংজ্ঞা পৃথিবীর সব জায়গাতেই এক।

মায়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের পুরো বাড়িটি ছিল কাঠের তৈরি আর পাহাড়ের ঢালের কারণে একদিকে বাঁকা। একটি ঘরের ছাদ একটু হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় আর তার পাশের ঘরের ছাদ বেশ উপরে। বেশ মজার ব্যাপার!
ছেলেমেয়েরা খুব খুশি। ভাগ্যিস, বুকিং ডট কমে অনলাইনে ভাড়া নিতে পেরেছিলাম!
ভোরে যখন ঘুম ভাঙল, প্রথমেই আমাদের জানালার পর্দাটা সরালাম। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম প্রকৃতির এক অপূর্ব রূপ! আমার সামনে বিশাল বরফ ঢাকা ‘ইগার মাউন্টেইন’! ছোট ছোট কেব্‌ল কারগুলো উপরে উঠছে আর নামছে। খেলনা গাড়ির মতো। চারদিকে সবুজ উপত্যকা! পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট সাজানো ঘরবাড়ি। ঠিক যেন সিনেমায় দেখা দৃশ্য!
দৌড়ে গিয়ে মাকে ঘুম থেকে জাগালাম। বললাম,
—দেখো, কোথায় চলে এসেছি!
আমাদের অবাক করে দিয়ে ছোট্ট একটা বাচ্চা হরিণ ঝোপ থেকে বের হলো ঠিক তখনি। আমরা দুজন বাকরুদ্ধ!

রাতে শোনা মিষ্টি ঘণ্টার রহস্য বের করলাম। এখানে গরুগুলোর গলায় ঘণ্টা বাঁধা। যখনই ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখনই ঘণ্টা বাজছে।

আমাদের সেদিনের গন্তব্য ছিল রিগি মাউন্টেইন। এই পাহাড়কে ‘কুইন অব মাউন্টেইন’ বলা হয়। তেরোটি লেক দৃশ্যমান হয়, যদি আবহাওয়া ভালো থাকে। আমাদের ভাগ্য বেশ ভালো ছিল সেদিন। আকাশ পরিষ্কার। লেক লুসার্নের ওপর দিয়ে রিভার ক্রুজে প্রায় এক ঘণ্টা অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছালাম রিগির কাছে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল মাউন্টেইন রেল।

কাঠের তৈরি রেলগাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। যত আমরা উপরে উঠছিলাম, প্রকৃতি যেন আরও নিজেকে মেলে ধরছিল। চারপাশের সবুজ উপত্যকা আর নীল লেকের সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল, এটা কি স্বপ্ন নাকি সত্যি!
মন্ত্রমুগ্ধ আমরা একসময় পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম।

আমাদের চারপাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছা করলেই যেন ছুঁয়ে দিতে পারি।
এবার তাকালাম আমার মায়ের দিকে!
মা তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। তার বড় বড় চোখে অবাক বিস্ময়! নীল আকাশ, সাদা মেঘের মাঝে হলুদ ওভার কোট পরা মায়ের বিস্মিত মুখখানি দেখে আমার মনে হলো এ মুহূর্তে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দৃশ্যটি দেখলাম।

পাহাড়ে গ্রাম
ছবি: লেখক

মনে হলো, আমার সামনে এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি তার চারদিক আলো করে দাঁড়িয়ে আছে! এই ভূস্বর্গের অপরূপ দৃশ্য তার অবাক চোখের কাছে কিছুই না!
মা দেখছে তার স্বপ্নের পৃথিবীকে আর আমি দেখছিলাম আমার মাকে।

পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-পারলাম কি তোমার অন্তত একটা স্বপ্ন পূরণ করতে?
মা কিছু বলল না।
পেছন থেকে দেখতে না পেলেও জানি তার চোখে পানি। পানি আমার চোখেও।
দুজনের চোখের পানি একরকম হলেও কারণ ছিল একেবারেই অন্যরকম।

মায়ের ছিল স্বপ্ন পূরণের আনন্দ আর আমার ছিল তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারার আনন্দ!
সারাদিন বেড়ানোর পর যখন বাসায় ফিরলাম চারদিকে গভীর আঁধার!
আমার ছেলে বলল,
-মা, আকাশে দেখো কত তারা!
সত্যি, এত তারাঝলমল আকাশ আমি আগে দেখিনি। হয়তো কোনো এক তারায় বসে গভীর আগ্রহে আব্বু আমাদের দেখছে। আমাদের চমকে দিতে একটা তারা খসে পড়ল হঠাৎ।
আমার মেয়ে বলল,
-মা, wish for something!!
ভাবলাম কি wish করব।
রবি ঠাকুরের গান গুনগুনিয়ে গাইলাম...
‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে
জাগে আমার গান!!’
স্বপ্ন পূরণ হলো আমার ...আমার মায়ের স্বপ্নপূরণের মাঝে!!
পরিশিষ্ট
আমার মা শামসুন নাহার।

বিএড, এমএড করা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। সারা জীবন দেখেছি নিজের সংসার, বাবার সংসার আর আমাদের জন্য করা তার অসংখ্য আত্মত্যাগ। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় কখনো পায়নি। ছোটবেলায় একবার বলেছিল, সুন্দর সুন্দর দেশ ঘোরার তার অনেক শখ। বিশেষ করে সুইজারল্যান্ড, পৃথিবীর ভূস্বর্গ! যাওয়ার উপায় তখন ছিল না, তাই আমার মা সিনেমা হলে গিয়ে রোমান হলিডের মতো ইংলিশ সিনেমাগুলো মন দিয়ে দেখত আর ভাবত, কখনো কি আমি যেতে পারব?

আমরা সম্তানেরা সব সময় দেখে এসেছি মায়েদের সারা দিন রান্নাঘরে গরমে ঘেমে, নেয়ে আমাদের পছন্দের খাবার তৈরি করতে, অসুস্থ হলে রাত জেগে সেবা করতে, জায়নামাজে বসে আমাদের মঙ্গলের জন্য দোয়া করতে! কখনো ভাবি না, তাদের কোনো স্বপ্ন থাকতে পারে, তাদের কোনো প্রিয় খাবার থাকতে পারে অথবা তাদের কোথাও যেতে ইচ্ছে হতে পারে। বয়স হলে অযথাই বকাবকি করি। নতুন প্রযুক্তি বোঝে না বলে জ্ঞান দেই। আমরা তাদের ‘taken for granted’ করে নেই।
কারণ তারা মা!

আমরা ভেবেই নেই, সারা জীবন তারা আমাদের জন্য করে এসেছে এবং করবে।
আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ছিল আমার ‘taken for granted’ মায়ের একটা স্বপ্ন অন্তত পূরণ করার।
পেরেছি কি?
মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে!