স্ত্রী ও মেয়েকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সুযোগ দেবেন তো
পৃথিবীতে অনেক মেধাবী পুরুষ সেলিব্রিটি পদার্থবিদ, আর গাণিতিক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী আজ পর্যন্ত এসেছেন। জন্মগতভাবে তাঁদের সন্তানদেরও একই বুদ্ধিমত্তা থাকার কথা ছিল যদি বাবার কাছ থেকেই বুদ্ধিমত্তা জিনিসটা বংশীয়ভাবে আসত। যেহেতু সেটা হয়নি, তাই বলা যায় যে বাবার কাছ থেকে সন্তানের বুদ্ধিমত্তা সরাসরি হয়তো আসে না। কেন বলছি একটু পরেই ব্যাখ্যা করছি।
এক অর্থে চিন্তাভাবনা করাই কিন্তু একজন গবেষকের কাজ। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের সূত্রাবলি এবং সিমেট্রি (প্রতিসাম্য) সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি এবং জ্ঞানের অংশ। পবিত্র আল-কোরআন তো আল্লাহ ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যই নাজিল করেছেন। আল-কোরআনে যেখানে আল্লাহ স্বয়ং চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করতে সবাইকে উৎসাহিত করেছেন, সেখানে মেয়েদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ বা গবেষণা করার ইচ্ছেটাকে ধর্মীয় অনুশাসনের আবরণে দাবিয়ে রাখা ঠিক নয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দিন।
যে পুরুষেরা হীনম্মন্যতায় ভোগেন যে স্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিজের চেয়ে বেশি হলে বা স্ত্রী পিএইচডি ডিগ্রি পেয়ে গেলে নিজের আত্মসম্মানে লাগবে, তারা এটা ভুল ভাবছেন। আপনি কোনো খেলার প্রতিযোগিতায় নামেননি। স্ত্রীর সঙ্গে কম্পিটিটিভ নন বরং সাপোর্টিভ হন। চিন্তা করেই দেখুন, আপনার স্ত্রী উচ্চশিক্ষিত কিংবা ধরুন পিএইচডি ডিগ্রিধারী হলে আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের পড়াশোনা অনেক খানিই এগিয়ে থাকবে। একাডেমিক্যালি প্রচুর দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ পাবে। দিন শেষে সন্তান ভালো কিছু করলে গর্ব ও নাম নেওয়ার ব্যাপারে বাবারাই তো এগিয়ে থাকে!
আর আপনি মেধাবী হলেও আপনার সন্তানেরা যে মেধাবী হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শুরুতেই বলেছি, যত পুরুষ মহারথী পদার্থবিজ্ঞানী আর অতিমানবীয় গাণিতিক মেধার বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এসেছেন, তাঁদের সন্তানেরা সর্বক্ষেত্রে কি তাঁদের কার্বন-কপি হয়েছে? এটা এককথায় উত্তর দিলে ‘না’ বলতে হয়।
বুদ্ধিমত্তা খুবই সূক্ষ্ম বিষয়। কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন অতীত গবেষণায় পাওয়া গেছে যে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বাবাদের তুলনায় মায়েদের কাছ থেকেই বেশি আসে। যদিও এটা কোনো সার্বিক সিদ্ধান্তে আসার মতো গবেষণা নয় এবং বুদ্ধিমত্তার উৎপত্তি নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা এখনো কোনো ঐকমত্যে আজও আসতে পারেননি।
তবে আসুন, কিছু বিজ্ঞানী দম্পতি সম্পর্কে জেনে নিই। আমার প্রকৌশলবিজ্ঞানের গবেষণায় বিচরণের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু অতীত উদাহরণ তুলে ধরব। উপসংহারে পৌঁছানোর ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিনির্ভর।
যেমন কুরি ফ্যামিলি। বাবা পিয়েরে কুরি, মা মেরি কুরি দুজনেই পদার্থ ও রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর তাঁদের সন্তান আইরিন কুরিও পরে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মায়ের মেধার গুণে নাকি বাবার গুণে আইরিন কুরিও মেধাবী বিজ্ঞানী হয়েছিলেন তা হয়তো বোঝা গেল না, তাই না? তাহলে আসুন আরেকটা উদাহরণ বিবেচনা করি।
পদার্থবিজ্ঞানের মহারথী আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী মিলেভা ম্যারিক ছিলেন একজন গণিতবিদ আর তাঁদের প্রথম সন্তান হ্যান্স আইনস্টাইন ছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির প্রকৌশল অনুষদের অধ্যাপক। হ্যান্স কিন্তু প্রকৌশলবিজ্ঞানে অনেক অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু সেটা মায়ের গুণে নাকি বাবার গুণে এখানেও অবশ্য বোঝা গেল না। তবে এই দুটি উদাহরণ থেকে এটুকু অন্তত বোঝা গেল, মা-বাবা দুজনেই মেধাবী হলে সন্তানদের মেধাবী হওয়ার সম্ভাবনা তীব্র।
আচ্ছা এখন এই উদাহরণে আসি, যদি বাবা শুধু মেধাবী হন, সে ক্ষেত্রে সন্তান কি হতে পারে? আইনস্টাইনের পরবর্তী প্রজন্মের পদার্থবিজ্ঞানের আরেক মহারথী ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। ফাইনম্যান ও তাঁর স্ত্রী গোয়েনেথ হাওয়ার্থের সন্তান কার্ল ফাইনম্যান। কার্ল তাঁর বাবার অতিমানবীয় মেধার এক ছটাকও পাননি। দর্শন ও ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক করেছিলেন কার্ল। এরপর সুপরিচিত বিজ্ঞানী বাবার নাম ও প্রভাব ব্যবহার কোনো রকম সম্মান বাঁচাতে মাস্টার্স করেছিলেন তড়িৎ প্রকৌশলে। প্রথমে ভাষাবিজ্ঞান ও দর্শন এবং তড়িৎ প্রকৌশল। এরপর আর কোনো পড়াশোনা করেননি।
আইনস্টাইনের পরে সবচেয়ে মেধাবী পদার্থবিদ বলা হয়ে থাকে রিচার্ড ফাইনম্যানকে। কার্ল তাঁর বাবা রিচার্ড ফাইনম্যানের ১ শতাংশ মেধা উত্তরাধিকারী সূত্রে পাননি। এটা কি ফাইনম্যানের স্ত্রী গোয়েনেথ নিতান্তই সাধারণ নারী ছিলেন শুধুই সে কারণে? সে জন্যই কি হয়তো কার্ল তার মায়ের দিক থেকে বংশীয়ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক মেধা পাননি। যদিও বাবা রিচার্ড ফাইনম্যান অতিমানবীয় মেধাবী ছিলেন? রিচার্ড ফাইনম্যান যদি আরেকজন মেধাবী নারীকে বিয়ে করতেন, তাহলে কি তাঁদের সন্তান মেধাবী হতো? প্রশ্নগুলোর উত্তর কারোরই জানা নেই। আমারও জানা নেই। তবে ব্যাপারগুলো বেশ ভাবনার উদ্রেক করে।
ওপরের বিচ্ছিন্ন উদাহরণগুলোর হয়তো আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। হয়তোবা আছে। কেউই জানে না। আমিও না। এত সামান্যসংখ্যক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে কোনো সার্বিক উপসংহারে পৌঁছানো যায় না। তবে উদাহরণগুলো থেকে হয়তো কিছুটা অনুমান করা যায় যে আপনার স্ত্রী ও মেয়েকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও উচ্চতর পড়াশোনায় সুযোগ দিলে তারা আপনাকে মেধাবী প্রজন্ম উপহার দেবে।
লেখক: মো. নাজমুল হাসান তপু, পিএইচডি গবেষক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা