স্ক্যাম কল
সোনালি একদম সাদাসিধে বাঙালি নারী। অনেক দিন ধরে নিউইয়র্ক নগরের বাসিন্দা হয়েও এই অত্যাধুনিক নগরীর মানুষগুলোর মতো তেমন আল্ট্রামডার্ন হতে পারেনি। মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত, তেমনি সোনালির দৌড় তার কাজের জায়গা পর্যন্ত। কাজের জায়গায় কাজ, আর বাসায় ফিরে গৃহস্থালি কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখে। বাইরের জগৎ নিয়ে তার তেমন আগ্রহ নেই। সোনালির যুক্তি হচ্ছে, বাইরে কাজ সেরে সংসার সামলাতেই যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে জগৎ-সংসার নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ নেই। বাংলাদেশে যে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সময় বের করে কথা বলবে, সেটাও সম্ভব হয় না। এমনকি আফিমের চেয়ে শক্তিশালী আসক্তির ফেসবুকে পর্যন্ত সময় কাটানোর মতো সময় হয় না সোনালির।
করোনার প্রকোপে সারা বিশ্বের মতো স্থবির ব্যস্ত নগরী নিউইয়র্ক। লকডাউন ঘোষণার পর থেকে সোনালির কাজে যাওয়া বন্ধ। করোনার মরণকামড়ে নিউইয়র্কে খুব করুণ দশা! রীতিমতো এক মৃত্যুর মিছিল চলছে। প্রতিটি মানুষ আতঙ্কে ভুগছে। দরজার সামনে যেন মৃত্যুর ফাঁদ পেতে দাঁড়িয়ে আছে করোনা। সবাই নিজ নিজ বাসার ভেতরে বন্দী হয়ে আছে। যেন এক বাক্সবন্দী জীবন। সোনালির হাতে এখন অনেক অলস সময়। গৃহস্থালির কাজ করেও সময় কাটে না। অবসরে টিভি, ফেসবুক স্ক্রলিং ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে খোঁজখবর নিয়ে সময় কাটছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলেও সোনালি সাধারণত কোনো অপরিচিত কল রিসিভ করে না।
একদিন দুপুরে সে গৃহস্থালির কাজ সেরে ফেসবুকে স্ক্রল করছে। এমন সময় একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। মোবাইল স্ক্রিনে দেখতে পায় কলটি টেক্সাস থেকে এসেছে। ওখানে তার পরিচিত এক বাঙালি বান্ধবী থাকে, যার সঙ্গে ফেসবুকেই পরিচয়। সে ভেবেছে হয়তো ওই বান্ধবী কল দিয়েছে। তাই রিসিভ করতে বিলম্ব করেনি। কিন্তু কল রিসিভ করামাত্রই এক মহিলা ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করেন, তাঁর নাম ম্যানিলা। তিনি টেক্সাসের সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসের অ্যান্টি ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটিস ডিপার্টমেন্ট থেকে কল করেছেন। তিনি তাঁর আইডি নম্বর দিয়ে আরও বলেন, সোনালির নামে অনেকগুলো ক্রাইম রিপোর্ট তাঁদের কাছে আছে; যেমন-একাধিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, ড্রাগ ও আর্মস বিজনেস, মানি লন্ডারিং ইত্যাদি।
এসব কথা শুনে সোনালির তো মাথা খারাপ অবস্থা! রীতিমতো পিলে চমকে উঠেছে। সে সবকিছুই অস্বীকার করে এবং ম্যানিলাকে ‘রং নাম্বার’ বলে কল কেটে দিতে চায়। ঠিক তখন ম্যানিলা সাবধান করেন, সে যেন ভুলেও কল না কাটে। তার সব কথা রেকর্ড করা হচ্ছে। করোনার কারণে মোবাইল ফোনে তার জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছে। তাই তাকে যা যা প্রশ্ন করা হবে, সে যেন ঠিক ঠিক উত্তর দেয়। একই সঙ্গে এসব কথা কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না বলেও সতর্ক করেন তিনি। এমনকি পরিবারের কারও সঙ্গেও না। সোনালি সঠিক জবাব দিলে তার কোনো বিপদ হবে না। তাদের সহযোগিতা করলে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করতে সুবিধা হবে। আর নয়তো পুলিশ এসে সোনালিকে এক ঘণ্টার মধ্যে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে এবং এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
এমন কথা শুনে সোনালির মনে হলো পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার চেয়ে ফোনে কথা বলাই ভালো। তাই সে নির্বিঘ্নে কথা বলতে একজন বাঙালি অনুবাদকের জন্য অনুরোধ করে। তখন ম্যানিলা জানাল, তার সিনিয়র অফিসার একজন বাঙালি। তিনি কল ফরোয়ার্ড করে ওই অফিসারের কাছে দিচ্ছেন। ওই বাঙালি অফিসার নিজের নাম ও আইডি নম্বর দিয়ে সোনালির সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। তখন সোনালি প্রশ্ন করে, তারা যে আসলেই সঠিক, এর প্রমাণ দিতে। তখন সোনালিকে অবাক করে দিয়ে বাঙালি অফিসার সোনালির সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বরের শেষ তিন ডিজিট বলেন। সোনালির তখন বিশ্বাস না করে আর কোনো উপায় নেই। বাঙালি অফিসার বিস্তারিতভাবে সোনালির বিরুদ্ধে একের পর এক অপরাধের বিবরণ দিলেন এবং এসব অপরাধের শাস্তি সম্পর্কেও বিস্তারিত জানালেন।
দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসাররা মৃদু হেসে ওঠেন। ওই মহিলা পুলিশ অফিসার সোনালির মোবাইল ফোন নিয়ে যেই ‘হ্যালো’ বললেন, তখনই লাইন কেটে গেল। এরপর কল দিয়ে দেখা গেল ওই মোবাইল নম্বর বন্ধ। তখন মহিলা পুলিশ অফিসার জানালেন, ‘আপনি খুব সহজ-সরল। তাই বুঝতে পারেননি এটা স্ক্যাম কল। আপনি তো সাংঘাতিক রকমের ভুল করতে যাচ্ছিলেন। ভাগ্য ভালো, আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে।
সোনালির কান্নাকাটি অবস্থা! সে বারবার এসব অপরাধের কথা অস্বীকার করছে। সে জীবনে কখনো টেক্সাসে যায়নি। তাহলে এসব অপরাধ কীভাবে করবে? বাঙালি অফিসার সোনালিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, হয়তো কেউ আপনার সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর ব্যবহার করে টেক্সাসে এসব অপরাধ করেছে। চিন্তার কিছু নেই, আপনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সহযোগিতা করেন। আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করব। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে আপনিই অপরাধী, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রমাণিত হচ্ছে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আপনি করেননি। তাই আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় যা কিছু আছে, আগামীকাল ক্রোক করাসহ আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তখন সোনালি কাঁদতে কাঁদতে ওই বাঙালি অফিসারের কাছে সহায়তা চায়।
তখন বাঙালি অফিসার বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করেন। প্রশ্ন করতে করতে এক সময় সোনালির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ও বাসায় কত ডলার আছে, জেনে নেন। তারপর তিনি আরও একজন সিনিয়র অফিসারের কাছে কল ফরওয়ার্ড করেন। তিনি সোনালিকে ফোনে রেখে ওই অফিসারের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে থাকেন। তখন ওই বাঙালি অফিসার সোনালি সম্পর্কে বলেন, তাঁর ধারণা সোনালি নির্দোষ। কেউ তাকে এসব অপরাধে ফাঁসিয়েছে। বাঙালি অফিসারের কথা শুনে সোনালি মনে মনে বেশ খুশি। হয়তো এই বাঙালি অফিসার তাকে এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। যা হোক, ওই সিনিয়র অফিসার কিছু নির্দেশনা দেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী বাঙালি অফিসার সোনালিকে বললেন, সে যেন এই মুহূর্তে গিয়ে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সব ডলার তুলে নিয়ে জ্যামাইকা অ্যাভিনিউয়ে যায়। সেখানে তাদের একজন প্রতিনিধি থাকবেন। তার কাছে ডলার গচ্ছিত রেখে আসতে হবে সোনালিকে। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঝামেলা শেষ হওয়ামাত্রই তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ডলার ফেরত দেওয়া হবে।
সোনালি তার স্বামীর সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে বাঙালি অফিসার জানান, এই মুহূর্তে কল কাটা যাবে না। আর এই বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলা মানে গোপনীয়তা ভঙ্গের কারণে নতুন করে আরও একটা অপরাধ করা। তাই কালবিলম্ব না করে ব্যাংকে গিয়ে সব ডলার তুলে নিয়ে সোনালি জ্যামাইকা অ্যাভিনিউয়ের দিকে পা বাড়ায়। তখন তার মনে বাধ সাধে। সে ৯১১ নম্বরে কল দিতে চায়। কিন্তু বাঙালি অফিসার তাকে একদম কড়া ভাষায় নিষেধ করে। তিনি জানান, ৯১১ নম্বরে কল দিয়ে এসব জানালে সোনালি আজকেই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হবে। নিউইয়র্ক পুলিশ এখনো এসব জানে না। জ্যামাইকা অ্যাভিনিউয়ে যাওয়ার পথে রাস্তায় পেয়ে যায় একদল পুলিশ অফিসার। সোনালিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দেখে এক মহিলা পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার কোনো সমস্যা, আমরা কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ তখন সোনালি সাহস নিয়ে মোবাইল ফোন চেপে ধরে হড়বড় করে সব ঘটনা খুলে বলল।
দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসাররা মৃদু হেসে ওঠেন। ওই মহিলা পুলিশ অফিসার সোনালির মোবাইল ফোন নিয়ে যেই ‘হ্যালো’ বললেন, তখনই লাইন কেটে গেল। এরপর কল দিয়ে দেখা গেল ওই মোবাইল নম্বর বন্ধ। তখন মহিলা পুলিশ অফিসার জানালেন, ‘আপনি খুব সহজ-সরল। তাই বুঝতে পারেননি এটা স্ক্যাম কল। আপনি তো সাংঘাতিক রকমের ভুল করতে যাচ্ছিলেন। ভাগ্য ভালো, আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। নয়তো এই চক্রের কাছে ডলারের সঙ্গে আপনার প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটতে পারত। ভবিষ্যতে কখনো এমন কল এলে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দেবেন। সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিস কিংবা আইআরএস থেকে কখনোই এমন কল আসে না।’ সোনালি এসব শুনে আতঙ্কে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। মহিলা পুলিশ অফিসার তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে সোনালিকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যান।