সোনাভান

সোনাভানের বয়সের তুলনায় একটু বাড়ন্ত শরীর। আসলে শরীরটা বাড়লেও বুদ্ধিটা বয়সের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে আছে। কথাবার্তার ধরন ধারণই আলাদা। এখন এই বাড়ি, তো তখন ওই বাড়ি। সারা দিন গ্রামটাকে মাথায় করে রাখে। কার বাড়িতে কয়টা আমগাছ, গাবগাছ, নারকেল—কোন বাগানে কাঁচামিঠা আম আছ, কার গাই কবে বিয়োবে, কোন মাস্টার ছাত্রীর সঙ্গে ‘লটরপটর’ করতে গিয়ে গ্রামছাড়া হয়েছে—সোনাভান সব জানে। কারও বাচ্চা কাঁদছে; সোনাভান কোলে তুললেই শান্ত। শিকদার চাচির বাড়িতে মেহমান আসছে, চাচি একা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না; সোনাভান আতপ চাল নিয়ে ঢেকিঘরে। মাওই মার সারা দিন জ্বর—সোনাভান পাক করা, মাথায় জলপট্টি দেওয়া থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ গুছিয়ে দিচ্ছে। বিষয়গুলো কার কাছে কেমন লাগল তা নিয়ে সোনাভানের কোনো মাথাব্যথা নেই। কেই বলে মেয়েটা আধ পাগলি, কেউ বলে অল্প বয়সেই মেয়েটা ‘গেল গা’। কেউ বলে, ‘আসলে মাইয়াডার ওপর জিনের আছর আছে।’ —এই হলো সোনাভান।

—ওই ছেমরি, ওমন ফালাইয়া ফালাইয়া চলস ক্যান? মাইয়া মানুষ, বড় অইছস, লজ্জা শরম নাই?

—ওই বুড়ি, বড় অইছি তো কি হইছে? আমার লজ্জা শরম নাই তাতে তুমার কী হইছে? আমি তুমার দামানের খাই না শাড়ি চুড়ি পিন্দি?

—ও সোনাভান হোন, তর ভালার লাইগ্যাই কইতাছি। গিরামের মানুষ নানা কতা কয়। খারাপ লাগে। তা ছাড়া তর বিয়া শাদি দেওন লাগব না?

—বিয়া শাদি দেওন লাগব না! ওই বুড়ি, ওই বুড়ি আমার বিয়া শাদি লইয়া তুমার তুমার ঘুম হারাম করন লাগবো না। আমার বিয়া পাকা অইয়া আছে বুঝলা?

—কার লগে ঠিক অইলো? কেডা ঠিক করলো রে মাগি?

—ঠিক করছে তুমার ভাতারে, আর বিয়া অইবো আজরাইলের লগে।

—ধুর ধুর পোড়া কপালি, চুপ কর

সোনাভান দাদির দিকে চেয়ে জিব কাটে। হাসতে হাসতে ছুটে যায় তার ‘নৈমিত্তিক কাজে’।

সব মানুষ এক রকম হয় না। নানাজন নানা রকম। কেউ একজনের দুঃখে কাঁদে। কেউ হাসে। কেউ মাটির মানুষ। কেউ সাক্ষাৎ শয়তান। এই ভালোমন্দ মিলিয়ে জগৎ সংসার। সোনাভান এই জগৎ সংসারের ধার ধারে না। সে আছে আপন খেয়ালে। আপনার মতো। সোনাভান পাঁচ ভাইয়ের এক বোন। সবার ছোট। তাই বাবা মা ভাই আত্মীয়স্বজন সবারই চোখের মনি। সবাই আদর করে। যখন যা চায় তাই এনে দেয়। সোনাভান তার খাবার দাবার কাপড়চোপড় গ্রামের অসহায় মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। এ নিয়ে ওকে কেউ কিছু বলে না। বরং বাবা মনে মনে খুশিই হন। স্ত্রীকে ডেকে বলেন, ‘মাইয়াডার এই স্বভাবডা ঠিক তুমার মতনই হইছে।’ সোনাভানের মা ভালো-মন্দ কিছু বলে না। শুধু হাসে।

.
.

এবার ঈদে কিনে দেওয়া নুন শাড়িটা কাজের বুয়ার মেয়ে রহিমার পরনে দেখে মোল্লা সাহেবের মাথায় রক্ত উঠে যায়। এত দামের শাড়িটা! ‘সোনাভান, ঈদে যে শাড়িডা দিলাম ওইডা কই?’ বাপের মুখের দিক চেয়ে সোনাভান বুঝতে পারে ‘আজ হবে’। তাই লুকোচুরি না করে সোজা উত্তর দেয়, ‘রহিমারে দিয়া দিছি।’

—রহিমারে দিয়া দিছস মানে?

—হ, আমার তো কত আছে। মিয়া ভাই একটা দিছে। মাইজা ভাই একটা দিছে। অর তো একটাও নাই। বাপের ঘাড়ের গামছা দিয়া লজ্জা ঢাকে।

—যাউক গা, অত কতা কওনের কাম নাই। তুমি তো দাতা হাতেম তাই, আর হোনো, বড় অইছ, এট্টু বুইঝা সুইঝা চলবা। বুঝলা?

সোনাভান মাথা নাড়ে। মুখে কিছু বলে না। এই ঘটনার পর দুই দিন দুই রাত কিছুই খায়নি। শুধু বিছানায় পড়ে কেঁদেছে। মা অনেক বুঝিয়েছে, ‘এমন করে না মা; তর বাজানে যা কয় তা তর ভালোর জন্যই কয়। নে ভাত খা।’ সোনাভান নির্বিকার। জগতের সবাই ওকে যা বলুক, গালাগাল দিক, মারুক, কোনো অসুবিধা নাই। শুধু বাবা একটু জোরে কিছু বললেই হয়ে গেল।

পরে বাবা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন, ‘মা রে আমার ভুল অইয়া গ্যাছে। আসলে আমারই তো উচিত ছিল রহিমারে কাপড় কিন্যা দেওয়া। এমন ভুল আর অইবো না।’ সোনাভান বাপের বুকে মুখ গুজে কিছুক্ষণ কাঁদে। তারপর সব ঠিক। বাবাও দুহাতে চোখ মোছে। মনে মনে বলে, ‘মাইয়াডারে লইয়া কি যে করুম—।’

পাশের বাড়ির ব্যাপারী বাড়ির ছেলেটি খুবই ভদ্র। দেখতে শুনতে ভালো। সহজ সরল। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। এখন জমি জিরাত দেখে। বড় ছেলে দুটি লেখা পড়া করে বড় চাকুরে—বিদেশে থাকে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়। ব্যাপারী সাহেব বছর বছর জমি কেনেন। বাড়িতে নতুন নতুন ঘর তোলেন। গিন্নি বলেন, ‘দিলু রে তর ল্যাখা পড়ার কাম নাই। বড় দুইডারে ল্যাখাপড়া শিখাইছিলাম। বুকটা খালি কইরা চইলা গ্যালো—ঘরটা অন্ধকার অইয়া গ্যালো। তুইও ল্যাখাপড়া করলে চইলা যাবি। দরকার নাই অমন ল্যাখাপড়ার।’ মায়ের এই অযৌক্তিক আদরেই দিলুর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাপারী সাহেব মা ছেলের কথা শুনে মিচকি মিচকি হাসেন। কিছু বলেন না। প্রবাসী ছেলে দুটির কথা মনে হলেই বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। চোখের জল এড়াতে কাউকে কিছু না বলে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে যান।

দিলুর মা বুঝতে পারে না সোনাভানকে সবাই এত খারাপ বলে কেন। মেয়েটা সব সময় মাথায় কাপড় দিয়ে চোখ নিচু করে নরম পায়ে হাঁটে। যখন দেখা হয় তখন কদমবুছি করে। আস্তে আস্তে কথা বলে। তিনি মনে মনে বলেন, ‘আসলে মাইয়াডা খুব লক্ষ্মী। মাইনষে যে ক্যান ওর পিছনে লাগে আল্লাই জানে।’

আসলে প্রতিটি মানুষেরই একটা দুর্বল জায়গা থাকে। একজন মনের মতো মানুষ থাকে। হোক সে আপন কিংবা পর। যার কাছে নিজের সুখ দুঃখের কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারে। এই দুর্দান্ত একরোখা চিরচঞ্চল মেয়েটা ব্যাপারী বাড়ির ত্রি সীমানায় এলেই অন্যরকম হয়ে যায়। হঠাৎ করে বীরাঙ্গনা বেশ বদলে যায়। কোমরে জড়ানো শাড়ির আঁচল মাথায় উঠে আসে। পলকেই অন্য মানুষ হয়ে যায় সোনাভান।

ব্যাপারী বাড়িতে এলে দিলুর মায়ের সঙ্গে কথা হয় সোনাভানের।

—কিরে মা কেমন আছো?

—জ্বি ভালো চাচি

—তুমার মা বাবা ভালো আছে তা?

—জ্বি

—ভাইদের খোঁজখবর নেও?

—হ, সেই কথা কইতেইতো আইছি। মিয়া ভাই চিঠি ল্যাখছে, আপনে, চাচা, দিলু ভাই সবার কথা জানতে চাইছে। মিয়াভাই কয়, ব্যাপারী বাড়ির চাচির মতন মানুষ এই জগতে আর নাই।

—কইছে বুঝি? আসলে তর সব কয়ডা ভাই-ই ভালো।

সোনাভান চাচির কাছে গিয়ে বসে তার মাথায় হাত বুলায়।

—দে রে মা দে। কয়দিন ধইরা উকুনের জ্বালায় ঘুমাইতে পারি না।

সোনাভান চাচির চুলে বিলি কাটে। আস্তে আস্তে এই কথা সেই কথা বলে। চাচি হ্যা-না উত্তর দেন।

—চাচি, দিলুভাই পালায় রাজার পাঠ করে দেখছেন। কী সুন্দর যে দেহায় দিলু ভাইরে! এক্কেবারে রাজার নাহাল। দ্যাখলে চিনতেই পারবেন না।

—দ্যাখ পাগলে কয় কি! আমি যামু পালাগান দ্যখতে! তর চাচায় শুনলে তরে শুদ্ধা আমারে মাইরা চ্যাপ্টা করব না! হ্যারে সোনাভান তুই দ্যাখছস নাকি?

সোনাভান লজ্জায় জিব কাটে। চাচি সে দৃশ্য দেখতে পান না।

—না চাচি আমি দেহি নাই

—তয় যে কইলি দিলু ভাইরে রাজার নাহাল দেহা যায়

—মাইনষে কয় তাই হুনছি

—মাইনষে কয়, না?

—চাচি?

—কি

—আমারে সবাই পাগল কয়। আমার লগে নাকি জিন আছে। আপনের কী মনে অয়?

—ধুর! মাইনষের কতায় কী আসে যায়। তর চাচায় কিন্তুক তরে খুব পছন্দ করে। হ্যায় কয়, সোনাভানের মতো মাইয়া অয় না। মাইয়াডা খুব ভালো

—দিলু ভাইতো আমারে দ্যাখতেই পারে না। দ্যাখা অইলেই ঘেউ ঘেউ কইরা আসে। এই ভুতের নানী গেলি, নাকি ফকির ডাকুম।

—অর কতা বাদ দে। ও অইলো একটা বলদ। কিচ্ছু বুঝে না।

নিজের অজ্ঞাতেই সোনাভানের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চাচীর পিঠে।

—কি রে, কী অইলো রে মা?

—কিচ্ছু না। বলেই সোনাভান এক দৌড়ে বেরিয়ে যায়। চাচি কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। শুধু সোনাভানের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

মোল্লা সাহেব সবাইকে চমকে দিয়ে হুট করে সোনাভানের বিয়ে দিয়ে দিলেন। চাচি খুব কষ্ট পেলেন। ভাবলেন, মেয়েটা সকাল-সন্ধ্যা আসতো। কত কথা বলতো। গল্প ঠাট্টা করত। ইচ্ছা ছিল সোনাভানকে দিলুর বউ করবেন। ব্যাপারী সাহেব একদিন রাতে কথায় কথায় বলেওছিলেন, ‘দিলুর মা, মাইয়াডারে দিলুর বউ করলে ক্যামন অয়?’ জবাবে দিলুর মা জবাব দিয়েছিল, ‘আমিও চিন্তা করছি, ব্যাপারডা অর মায়েরেও কইলাম। হে কয়, “ছেলে মেয়ে দুইজনেরই বয়স কম। তাড়াহুড়ার কী আছে? ” ’

কিন্তু ‘তাড়াহুড়া’ করেই সোনাভানের বিয়ে হয়ে যায় আর ব্যাপারী গিন্নীর আশা আশাই থেকে যায়। সেদিন ফেরত নাইওর থেকে এসে ব্যাপারী চাচীকে সালাম করতে গেল সোনাভান। নতুন শাড়িতে ওকে অপূর্ব লাগছে। সেদিন সে আরও লাজুক, আরও বিনয়ী। মাই নুইয়ে যখন সে দুই হাত দিয়ে চাচীর পায়ে সালাম করতে গেল তার চোখের পানিতে চাচীর দুই পা ভিজে গেল।

চাচি সান্ত্বনা দেয়। ‘হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত আর বিয়া অইলো আল্লার হাতে। মাইনষের কিছু করনের নাই। কান্দিস না মা, কান্দিস না। দেহিস তুই ভালোই থাকবি। তর মতো মাইয়া ভালো না থাইকা পারে?’

চাচীর সান্ত্বনা পেয়ে সোনাভান হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। ‘চাচি আমি কি এতই খারাপ?’ তারপর চাচীর সঙ্গে সোনাভানের কী কী কথা হয় তা কেউ কোনো দিন জানতে পারেনি।

ফিরে যাওয়ার সময় দিলুর সঙ্গে দেখা হয় সোনাভানের। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকা। দিলু তর চোখের জল বুকের কষ্ট কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু সে বুঝতে পারে সোনাভানের আজকের এই চলে যাওয়ার বিষয়টি তাঁকে যেন কেমন উতলা করে তোলে।

—দিলু, খাইতে আয়। ব্যাপারী গিন্নি ডাক দেয়

-না, খামু না। শরীলডা ভালা লাগতাছে না

-কী অইছে মানিক? এদিকে আয় দেহি।

মা ছেলের গায়ে হাত বোলান। ‘না, শরীর তো ঠান্ডাই’।

-তুমি খালি খালি ব্যস্ত অইতাছ, তেমন কিছু না

-তয় খাবি না ক্যান?

-দেও, ভাত দেও

মায়ের মুখ হাসি ফোটে।

-কি যে পাগলামি করস মাঝে মাঝে। ডর লাগাইয়া দ্যাস

ভাত খেতে দিলু সোনাভানের প্রসঙ্গ টানে, যা সে আগে কোনো দিনই করেনি। মা ছেলের মুখের দিকে চেয় বুঝতে চেষ্টা করেন তার কষ্টা কোথায়? কিন্তু কিছুই করতে পারেন না। কদিন আগে হলেও হয়তো দিলুর মনের মতো কোনো উত্তর দিতে পারতেন। কিন্তু ছেলেটা এমন সময় সোনাভানের কথাটা পাড়লো যখন কিছুই করার নেই।

-হ, রে বাপ, মাইয়াডার জন্য আমারও খারাপ লাগে। কি কান্দনডাই না কানলো আমারে ধইরা। তর কতা কইল, ‘চাচি, দিলুভাই আমারে দেখতে পারতো না। পারবই বা ক্যান? আমি তো খারাপ মাইয়া। আমার ঘাড়ে বদ জিন আছে। চাচি আমি আর যেহানে যেমুন আপনাগো বাড়িতে আইলেই কেমন যেন অইয়া যাইতাম। কন দেহি এমন অয় ক্যান? দিলুরে আমি তার কোনো কতার উত্তর দিতে পারি নাই।’

দিলুর হাতের খাবার মুখে রোচে না। পাছে মা কষ্ট পায় সেই ভয়ে আস্তে আস্তে খাওয়া শেষ করে। দিলু ভালো করেই বুঝতে পারে সোনাভান বাইরে যাই করুক ভেতরে ভেতরে সে এ বাড়ির একজন হতেই সে এ বাড়ির সবার সঙ্গে অন্যরকম আচরণ করেছে। আসলে সেটাই তার সত্যিকারের রূপ। সোনাভানের এই অপরূপ রূপ দিলু যেদিন বুঝল সেদিন সোনাভান আর সোনাভান নাই। সে অন্য কেউ হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে চাচি দিলু কী করবে? সামাজিকভাবে সোনাভান যখন দিলুর খুব কাছে ছিল তত দিন প্রয়োজনটা সে অনুভব করেনি। মনে হয়েছে সে সোনাভানতো আছেই। যখন-তখন তাকে দেখা যায়। বিচ্ছিন্ন ভাব কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আজ যখন সে সামাজিকভাবে দূরে সরে গেল তখনই দিলুর সোনাভানকে হৃদয়ের খুব কাছের একজন বলে মনে হলো।

দিলুর খাবারে অরুচি, কাজে মন বসে না। দিনে দিনে সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। বাবা ব্যস্ত হলেন। মায়ের চোখের ঘুম হারাম হলো। ডাক্তার-কোবরেজ দেখানো হলো। কিছুতেই দিলুর অবস্থার উন্নতি হলো না। জনে জনে নানা কথা বলাবলি শুরু হলো। কেউ বলে অভিশাপ। কেউ বলে, ‘ভাব ধরছে, দু-চার ঘা দিলেই ঠিক হয়ে যাবে’। কেউ বলছে, ‘বিয়ার অসুখ। বেপারীরে কও জোয়ান একটা মাইয়া দেইখ্যা পোলারে বিয়া দিতে। সব ঠিক অইয়া যাইবো।’ কেউ বলল, ‘সোনাভানের জিন অর ঘাড়ে আছর হইছে। এইডা খুব বদ জিন। দিলুরে না খাইয়া যাইবো না।’ হলোও তাই। কদিনের অসুখেই দিলু সেই যে শয্যাশায়ী হলো আর ফিরল না। একেই বলে নিয়তি, কারও কোনো দোষ নেই, অথচ কত অল্প সময়ের মধ্যে কত বড় অঘটন ঘটে গেল। এখানেই মানুষ বড় অসহায়।

সোনাভানের কানে যখন এই খবর পৌঁছাল তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন শত চেষ্টা করেও তাকে ধরে রাখতে পারেনি। সোজা চাচীর পায়ে আছড়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করল ‘কেমনে কী অইল চাচি? আমারে একটাও খবর দিলেন না? চাচি আপনেও আমারে ঘেন্না করতেন।’

-চুপ কর হতভাগি। তুই-ই আমার দিলুরে খাইছস! আর কী চাস? আমারে খাবি? নে-খা

চাচীর কণ্ঠে ঘৃণা, রূপ ভয়ংকর সোনাভান কোনদিন যা দেখে নাই। সোনাভানের মাথায় যে আকাশ ভেঙে পড়ে। এরপর কোনো কথা বলার থাকে না। সে সোজা দিলুর কবরের কাছে এসে আছড়ে পড়ে।

-আমার কী দোষ? চাচি আমারে যা-না তা কয়। অহন আমি কই যাইমু?

সোনাভানের মুখে হাজারো প্রশ্ন! চোখ স্থির রণ-রঙ্গিনী রূপ। মাথার কাপড় কোমরে বাঁধে। আস্তে আস্তে সোজা হয়ে হয়ে দাঁড়ায়।

-ওই শালা শুওরের বাচ্চারা, আমারে জিনে ধরছে! আমি নষ্ট হইয়া গেছি, দিলুরে খাইছি না? অহন আমি সব শালাগো খামু। দেহি আমারে কে ঠেকায়।

সকলেই বুঝলো মাইয়াডারে সত্যি সত্যিই জ্বীনে ধরছে। তার শ্বশুর বাড়ির লোক এ খবর পাওয়ার পর আর এ বাড়িমূখী হয় নাই।

‘মা-রে, বা-বা-রে, আ-মা-রে মাইরা ফালাইলো, কে কই আছ আমারে বাঁচাও’-বিকট চিৎকার শুনে বেপারী সাহেব স্ত্রীকে জিজ্ঞাস করল, ‘কী অইছে? কান্দে কেডা?’

-সোনাভান

-অর কী অইছে?

-ফকির আইছে-জিন ছাড়াইতাছে।

-জিন ছাড়াইতেছে!

-হ; গ্রামের সবাই কইছে। ফকির দেখাও। জিন ছাড়াও। নইলে আর কয়জনরে খায়।

বেপারী সাহেব আস্তে আস্তে জটলার কাছে আসেন। কজন মিলে পলো দিয়ে চেপে ধরেছে মেয়েটাকে। আর গরম তৈল ছিটানো হচ্ছে ওরা সারাগায়। মাঝে মাঝে হুংকার ছেড়ে বলছে, ‘ক যাবি অর ঘাড় থাইক্যা। অহনও সময় আছে, নইলে আরও কঠিন দাওয়াই আছে।’ গ্রামের লোকজন পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে অমানবিক, পাশবিক এ দৃশ্য। কেউ কেউ উপভোগও করেছে।

-এই মিয়া কি অইতাছে? বন্ধ কর

ব্যাপারী সাহেবের কথায় ফকির গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, ‘বদ-জিন, সহজে যাইব না’

-মানুষটা মরে যাচ্ছে, আর তুমি জিন ছাড়াচ্ছ?

ব্যাপারী সাহেবের ক্রুদ্ধ চেহারা দেখে ফিকর বলে ওঠে, ‘ওই হালারেও জিনে ধরছে, অরেও হান্দাও পলোর মধ্যে।’

বেপারী সাহেব বুঝলেন, সহজে কাজ হবে না। কারণ এটা ফকিরের রুটি-রোজগার ও ইজ্জতের ব্যাপার। সে সহজে হারবে না। তা ছাড়া গ্রামের সব লোকজনই এত দিনে সোনাভানের বিপক্ষে চলে গেছে, এমনকি তার মা বাবাও। বেপারী সাহেব কোনো কথা না বলে ঘর থেকে কাঠের হান্টার নিয়ে এলেন। কোনো ভূমিকা ছাড়াই শুরু করলেন ফকিরের গায়ে এলোমেলো পেটানো। মুহূর্তেই ফকির বুঝতে পারল তার জারিজুরি আর চলবে না। তাই হাত জোড় করে বলল, ‘স্যার আমার ভুল হইয়া গেছে আমারে মাফ কইরা দেন। এমন কাম আমি কোনো দিন করমু না।’ বেপারী সাহেব সকলের সামনে তাকে দিয়ে তার মিথ্যা জারিজুরির কথা স্বীকার করালেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। বেপারী সাহেব সকলকে যার যার বাড়ি চলে যেতে বললেন। সোনাভান অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তার বাবা-মা নির্বিকার। কী করবেন কী বলবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। বেপারী সাহেব মোল্লা সাহেবের ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ‘আমি মাইয়াডারে লইয়া গেলাম।’ মোল্লা সাহেব এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন-আর পারলেন না। বেপারী সাহেবকে জড়িয়ে ধরে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন। সোনাভান কদিনের মধ্যেই অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। বেপারী সাহেব তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘মা-রে আমারও মস্ত বড় ক্ষতি হইয়া গ্যাছে। তর চাচি খানা-পিনা ছাইড়া দিছে। চিন্তা করিছ না মা, আমি তরে আবার বিয়া দিমু।’

সোনাভান বেপারী সাহেবের মুখের দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল, মুখে কিছুই বলতে পারল না।