সেরা স্বামী প্রিন্স ফিলিপ
বিলেতে অনেক পুরুষকেই বলতে শুনেছি, ‘আমি তো প্রিন্স ফিলিপের মতো দুহাত পেছনে রেখে বউয়ের সঙ্গে শপিংয়ে যাই।’ কথাটা এমনিতেই প্রচলিত হয়নি। একটা ব্র্যান্ডেড ছবি সবাই দেখে অভ্যস্ত যে রানির প্রতিটা রাজকার্যে প্রিন্স ফিলিপের দুহাত পেছনে রেখে হাঁটার অভ্যাস, যা কারোর নজর এড়াত না।
আসলেই সদ্য প্রয়াত রানি এলিজাবেথের ৭৩ বছরের জীবনসঙ্গী প্রিন্স ফিলিপ ব্রিটিশরাজের নীরব অবদান ওই স্বামীদের মতোই।
একদা শরণার্থী গ্রিক-ড্যানিশ নাগরিক প্রিন্স ফিলিপ ব্রিটিশরাজের জিরো থেকে হিরো হওয়ার গল্পটা একটু অবাক করার মতোই। একটু পেছনে মাত্র ১০০ বছর আগে থেকেই শুরু করা যাক। সোনার চামচ মুখে নিয়ে গ্রিক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফিলিপ। ওই সময়কার গ্রিক, জার্মান, ডেনমার্ক, ব্রিটেন ও রাশিয়ার রাজরাজড়া ছিলেন একে অপরের আত্মীয়। কিন্তু গ্রিক-ড্যানিশ রাজবংশ ছিল ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো। সেই রাজবংশে জন্মেছিলেন ফিলিপ। টিপ্পনী করে তাই ফিলিপ বলতেন, তাঁর শরীরে বেশি Blue Blood তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথের থেকে!
ফিলিপের বাবা এন্ড্রু ও মা এলিসের বিয়ে ছিল ‘শতাব্দীর সেরা’ বিয়ে, যেখানে রাশিয়ার সম্রাট জার নিকোলাস থেকে শুরু করে ইউরোপের সব রাজবংশ যোগ দেন। ভাগ্যের পরিহাস কি না কে জানে। গ্রিক-টার্কি যুদ্ধের সেই সময়টাতে ফিলিপের মায়ের প্রসববেদনা হঠাৎ হওয়ায় বাড়ির ডাইনিং টেবিলই ফিলিপের জন্ম হয়। জন্মের ১৮ মাসের মাথায় সেনাবাহিনীর ক্যুর কারণে ফিলিপের বাবা এন্ড্রুকে কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত করা হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের তৎপরতার কারণে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে শরণার্থী হয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নেয় ফিলিপের পরিবার। কথিত আছে, সেই ছোট্ট ফিলিপকে ফলের বাক্সে লুকিয়ে আনা হয় ফ্রান্সে।
সেই হিসাবে ফিলিপ গ্রিসের নাগরিক ছিলেন মাত্র ১৮ মাস। গ্রিক ভাষা জানতেন না। এ কারণেই কিনা এলিজাবেথ রানি হওয়ার পর গত ৭০ বছরে শ্বশুরবাড়ি গ্রিস সফর করেননি!
ফ্রান্সে থাকার সময়ে মাত্র ৯ বছর বয়সে মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, বাবা চলে যান মোনাকোর বিনোদন শহর মন্টিকার্লোতে। শুরু করেন বিলাসী জীবন। আর মা এলিস! একেবারে উল্টো। ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মানসিক সমস্যাও ধরা পড়ে। বড় চার বোনের বিয়ে হয় জার্মান রাজপরিবারের প্রিন্সদের সঙ্গে। সব ছেলেদের মতো ফিলিপের কৈশোর জীবনে মা-বাবার আদর-ভালোবাসা অধরাই রয়ে যায়। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইংল্যান্ডে মায়ের আত্মীয়ের কাছে। আর সেই আত্মীয় হলো আমাদের অতিপরিচিত অখণ্ড ভারতের লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিবার। ভর্তি করা হয় ইংল্যান্ডে কিন্তু স্কুল ফির টাকা বাঁচানোর জন্য তিন বছর পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় জার্মানিতে নিজ বোনের জামাই কর্তৃক পরিচালিত স্কুলে। ১৯৩৩ সালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইহুদিদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করে। সেই স্কুলের ইহুদি প্রতিষ্ঠাতা Mr Kurt Hahn চলে আসেন স্কটল্যান্ডে এবং প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত Gordonstoun স্কুল।
Kurt Hahn-ই ফিলিপের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন তখন। ফিলিপ চলে আসেন Gordonstoun স্কুলে। Mr Kurt বেশি জোর দেন শরীরচর্চা ও খেলাধুলার ওপর। ফিলিপ ব্যক্তিত্বের কারণে হয়ে যান স্কুলের First boy। খেলাধুলা ও সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন স্কুলের মধ্যে।
১৮ বছর বয়সে স্কুল শেষ করে নেভিতে ভর্তি হন। পড়াশোনাকালীন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কাকতালীয়ভাবে ব্রিটিশদের পক্ষে ফিলিপ ভারত সাগরে আর নিজ দুই বোনজামাই যুদ্ধ করছেন জার্মানির হয়ে। তখনো ফিলিপকে গ্রিক বলেই মনে করত ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী, তাই ভূমধ্যসাগরে পাঠায়নি। ১৯৪০ সালে ইতালির মুসোলিনি বাহিনী গ্রিস আক্রমণ করে। তখনই ফিলিপকে ইতালি ও জার্মানির বিপক্ষে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় ভূমধ্যসাগরে। শিক্ষা ও যুদ্ধনৈপুণ্যের কারণে ১৯৪২ সালে, ২১ বছর বয়সে হয়ে যান সবচেয়ে কম বয়সী লেফটেন্যান্ট।
প্রেম-বিয়ে
১৯৩৯ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ ১৩ বছর বয়সী মেয়ে এলিজাবেথ ও মার্গারেটকে নিয়ে Devon-এ নেভি কলেজ পরিদর্শনে যান। মাউন্টব্যাটেন তাঁর ভাগনে ১৯ বছর বয়সী ফিলিপকে দায়িত্ব দেন রাজকন্যাদের দেখাশোনা করার জন্য। সেই পরিচয়েই কিশোরী এলিজাবেথ প্রেমে পড়েন ফিলিপের। চলে তাঁদের মধ্যে চিঠি-চালাচালি। তাঁদের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাজপরিবার। এলিজাবেথের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকেই ফিলিপ ১৯৪৬ সালে রাজার কাছে গিয়ে সরাসরি তাঁর কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
মেয়ের ভালোবাসা মেনে বিয়ের অনুমতি দিলেও নানা শর্ত দেন রাজা জর্জ। শর্ত মেনেই গ্রিসের নাগরিকত্ব ছেড়ে ব্রিটেনের নাগরিকত্ব ও ইংলিশ নাম গ্রহণ করেন প্রিন্স ফিলিপ। ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তাঁরা। ওই দিনই ফিলিপকে খেতাব দেওয়া হয় ডিউক অব এডিনবরা। বিবিসি রেডিওর সরাসরি প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনে বিশ্বের ২০ কোটি লোক। পরের দিন টিভিতে প্রচারিত হয়। যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির ওপর চাপ কমাতে অনেক কৃপণতা করা হয় রাজকীয় সেই বিয়েতে। দুই হাজার অতিথি নিমন্ত্রিত হন।
বিয়েতে জার্মানিতে থাকা তিন বোন ও জামাইদের আনতে পারেননি। কারণ, যুদ্ধোত্তর জার্মানদের শত্রু হিসেবে দেখা হতো ব্রিটেনে। তবে মাকে ঠিকই এনেছেন।
বিয়ের কয়টা বছর খুব আনন্দে কাটান এ দম্পতি। ১৯৫২ সালে এলিজাবেথ-ফিলিপের কেনিয়া সফরকালেই আকস্মিক খবর আসে রাজা জর্জ আর নেই। ফিলিপকে দায়িত্ব দেওয়া প্রিন্সেস এলিজাবেথকে জানানোর। সেই যে রাজপরিবারের দায়িত্ব নিলেন, তা ছাড়লেন মাত্র কয়েক বছর আগে বয়সের কারণে।
১৯৫৩ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণের পর ফিলিপ নিজের সব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে রানির পাশে দাঁড়ান। সাংবিধানিক কোনো দায়িত্ব না থাকলেও তাঁর কাজ ছিল স্ত্রীকে সব কাজে সহযোগিতা ও রাজকীয় দায়িত্ব পালন করা। এই দম্পতির চার সন্তান রয়েছে। কিন্তু নিজের সন্তানদের পিতৃপরিচয়ে পরিচিত করাতে না পারার আক্ষেপ ছিল তাঁর মনে। যদিও মজা করে বলতেন। পিতৃহারা হন যুদ্ধকালীন ১৯৪৪ সালে। দেখা হয়নি বাবার সঙ্গে তখন।
মা-ভক্ত ছেলে ফিলিপ কিন্তু নিজের বিয়েতে মাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলেন। মাকে শেষের দিকে নিজের সঙ্গে ‘বাকিংহাম প্যালেসে’ রেখেছিলেন। ১৯৬৯ সালে মারা যাওয়ার আগে মা তাঁর উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘Dearest Philip, be brave, and remember I will never leave you, and you will always find me when you need me most।’
রানির দায়িত্ব নেওয়ার পর চিন্তা করেন কীভাবে যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনীতিতে রাজপরিবার সাহায্য করতে পারে। গুরুত্ব দেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিক ব্যবসাকৌশলে। শুরু করেন রাজকীয় লবি, যা আজও ব্রিটিশ অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। State dinner, Charity, Royal Visit, Commonwealth—এসব ক্ষেত্রে রানিকে পেছন থেকে সাহায্য করেছেন। আজও আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, আরব ও ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রধানেরা রানির সঙ্গে দেখা করে ধন্য হন।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁদের ৫০তম বিবাহবার্ষিকীর বক্তব্যে বলেছেন, তাঁর সব কাজে প্রিন্স ফিলিপ উৎসাহ ও সাহায্য করে যাচ্ছেন। প্রিন্স ফিলিপ প্রায় ২২ হাজার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। মেজ ছেলে প্রিন্স অ্যান্ড্রু বলেছিলেন, মা এলিজাবেথ থেকে আদর-সোহাগ বেশি পেলেও বাবা ফিলিপ ভাইবোনদের নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা ও শাসনে রাখতেন। রানির রাজকার্যে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, তাই ফিলিপ তাঁদের বেশি সময় দিতেন। খেলাধুলা, ঘোড়া দৌড়ানো, বারবিকিউ, ফার্মে বেরোনোর শখ বেশি ছিল।
৮০০ চ্যারিটি সংগঠনের হয়ে কাজ করেছেন জীবদ্দশায়। বয়সের কারণে চার বছর আগে সব রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। শিক্ষাগুরু Mr Kurt Hahn-এর অনুপ্রেরণায় পরবর্তী সময়ে প্রিন্স ফিলিপ প্রতিষ্ঠা করেন Duke of Edinburg Award scheme, ১৯৫৬ সালে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুবসমাজকে অভিযাত্রী, শারীরিক ও খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য। বাংলাদেশেও আছে Duke of Edinburgh award। এ পর্যন্ত বিশ্বের ছয় লাখ যুবক-যুবতী যুক্ত হয়েছে এই অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রামে। অনুজপ্রতিম বন্ধু সুমন সাহা, এখন ইংল্যান্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একসময় বাংলাদেশে এই Award programme-এর প্রধান ছিল। তার থেকেই বেশি শুনেছি প্রিন্স ফিলিপের যুবসমাজকে নিয়ে স্বপ্ন।
জলবায়ুর ভয়াবহতা নিয়ে গত ১৫-২০ বছর বেশি আলোচনা হচ্ছে কিন্তু প্রিন্স ফিলিপ ৬০ বছর আগেই সতর্ক করেছেন বিশ্ববাসীকে। তখন অস্ট্রেলিয়া সফরকালে একটি দ্বীপ পরিদর্শন করে বুঝে গিয়েছিলেন পরিবেশের বিপর্যয় কীভাবে মানুষের শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণেই নিজেকে জড়িয়েছেন পরিবেশ সংরক্ষণে। একবার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের সংগঠন World Wide Fund for Nature (WWF)-এর।
রাজপরিবারে অন্দরমহলের ছবি ১৯৬৯ সালের আগে নিষিদ্ধ ছিল পারিবারিক গোপনীয়তার জন্য। কিন্তু অন্য দশটা পরিবারের মতো নিজের পরিবারকে সবার কাছে তুলে ধরার জন্য ডেকে আনেন এক রয়াল আলোকচিত্রীকে। বিশ্বে ছড়িয়ে যায় সেই লিভিং রুমের ছবি, যেখানে রানি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে সাদাকালো টেলিভিশন দেখছেন। ফিলিপের যুক্তি ছিল ‘Instead of speculation about Royal better to watch’।
সর্বদা হাস্যরসাত্মক কথার ফুলঝুরিতে সবাইকে আনন্দ দিতেন। রানিও বাদ পড়েননি। রাজপরিবারে রাজার স্ত্রী ‘Queen’ উপাধি পান কিন্তু রানির স্বামী ‘King’ উপাধি পান না। এ নিয়মের কারণে ফিলিপকে প্রিন্স উপাধি নিয়ে থাকতে হয়েছে। এটা নিয়ে মজা করতেন! আরেকবার মজা করে বলেছিলেন, তিন ছেলে ও এক মেয়ে কিন্তু কেউই পিতৃপরিচয়ে বড় হবে না। প্রায়ই হাস্যচ্ছলে বলতেন, আমি তো শরণার্থী এই দেশে।
কিন্তু জীবদ্দশায় সবচেয়ে বড় কষ্টটা পেয়েছেন ছেলে প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়নার বিবাহবিচ্ছেদ এবং পরবর্তী সময়ে ডায়নার মৃত্যুতে। যদিও মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও মেজ ছেলের বিবাহবিচ্ছেদ হয়, তা আড়ালেই চলে যায়। প্রিয় দুই নাতি মা-হারা উইলিয়াম ও হ্যারিকে আগলে রেখেছেন।
ওয়াইন্ডসর ক্যাসলের কাছে গির্জায় শেষকৃত্যে কোভিডের কঠোর নিয়মের কারণে মাত্র ৩০ অতি ঘনিষ্ঠজন উপস্থিত ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের জায়গা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন শেষকৃত্যে থাকেননি। প্রিন্স ফিলিপের নিজেরই নকশা করা ল্যান্ড রোভার গাড়িতে কফিন আনা হয় গির্জায়।
সব বিশ্বনেতার শোক প্রকাশ দেখেই বোঝা যায় কত বড় স্থানে ছিলেন প্রয়াত প্রিন্স ফিলিপ। কোভিড না থাকলে হয়তো বিশ্বনেতারা হাঁটতেন সেই কফিনের পেছনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিদায় জানানোর জন্য।
এমন অদম্য সাহসী নাবিক, মানবিক ও সুশৃঙ্খল স্বামী, বাবা, বন্ধু ও কিছু দেশে দেবতুল্য এই মানুষটি কতই না জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসা নিয়ে প্রায় ১০০ বছর ইহলোকে কাটিয়ে পরপারে চলে গেলেন। বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন শরণার্থী হয়েও কীভাবে ‘বিশ্বসেরা স্বামী’ হওয়া যায়।
*লেখক: তপন সাহা, ইংল্যান্ড