সেই সব দিনের কথা

‘পুরোনো সেই দিনের কথা, ভুলবি কিরে হায়/ ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়...।’
সময়টা ২০০৯ সালের। আজ থেকে সাত বছর আগের কথা। আমরা তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স পরীক্ষার্থী। শিক্ষকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নিয়ে কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিন যাবেন শিক্ষা সফরে। সমুদ্রের ডাকে সবাই যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সবাই চেয়েছিল এই শিক্ষা সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে। কিন্তু বাঁধ সাধল মেয়েদের পরিবার। অনেক মেয়েরই পরিবার থেকে রাজি হলো না এত দূরে শিক্ষা সফরে যেতে দিতে।
সমুদ্রের প্রতি টান ছিল আমার শৈশব থেকেই! সমুদ্র আমায় কেবল হাতছানি দিয়ে ডাকত। কতবার যে চেয়েছি যেতে কিন্তু পারিনি। সুযোগ ছিল কিন্তু সম্মতি ছিল না। শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত সুযোগটা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছিলাম না। বাবা-মা কিছুতেই রাজি হলেন না, বিশেষ করে আমার মা। সমুদ্রে যাব সে কথা শুনেই আমার মা আমাকে কল্পনায় সমুদ্রে ভেসে যেতে দেখলেন। স্নেহের বাঁধন আরও শক্ত করে বললেন, কোনোভাবেই যাওয়া যাবে না। আমার সমুদ্র বিলাসী মন ভেঙে খান খান হয়ে গেল। তবুও হাল ছাড়লাম না। বাবার আদরের মেয়ে তাই হৃদয়ভাঙা ঢেউ নিয়ে হাজির হলাম বাবার সামনে। বাবার মন গলল কিন্তু মা শর্ত দিলেন আমি একা যেতে পারব না, আমার সঙ্গে খালাতো বোনকে যেতে হবে। আমার খালাতো বোন মৃদু আমার জানের দোস্ত সেই জন্মের পর থেকে। সমুদ্রে যাওয়ার কথা শুনে তো সে এক পায়ে খাঁড়া। মা আমার দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন। বিষয়টা জানালাম ডিপার্টমেন্টে কিন্তু শিক্ষা সফরে কেবল একই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রী যেতে পারবে। আমার বোন তো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের। আবারও হতাশা। কিন্তু বন্ধু বলে কথা। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা স্যারদের রাজি করিয়ে ফেলল। আমার আজন্ম সমুদ্র দর্শনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলল।
আমার রাস্তা তো পরিষ্কার হলো, এবার পালা আমার বন্ধুদের। লিজা, অপা, মিশু আর আমি, এই চারজন ছিলাম ভার্সিটিতে এক আত্মা। অপা অনার্স শেষ করে ঘর বেঁধেছিল লন্ডনে। বাকি ছিলাম আমরা তিনজন। সমুদ্রযাত্রায় লিজা ও মিশুর পরিবারকে রাজি করানোর দায়ভার এসে পড়ল আমার ওপর। লিজার বাবাকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করালাম। এরপর গেলাম মিশুর বাসায়। ওর মাকেও পটিয়ে ফেললাম। সমুদ্র বিলাস কি আমি একলা করতে পারি? বন্ধু ছাড়া জীবন অর্থহীন। তিন বন্ধুর পরিবার যখন এত কাঠ কয়লা পোড়ানোর পর সম্মতি দিল, তখন আমাদের আর পায় কে!
এরপর এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। ডিসেম্বর মাস। প্রচণ্ড শীত! পুরো দেশে শৈত্যপ্রবাহ চলছে। কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিক। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সমুদ্র সফরে যাওয়ার দিনে আমাদের শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা ছিল। ছয় ঘণ্টার পরীক্ষা! দিনে পরীক্ষা আর রাতে কক্সবাজারের পথে যাত্রা। সমুদ্রে যাওয়ার টান টান উত্তেজনা আমাদের পরীক্ষার হলে অস্থির করে তুলেছিল। কখন হল থেকে বের হয়ে যাব সে দিকেই ছিল মন। মিশু আর আমিতো এক ঘণ্টা আগেই বের হয়ে গিয়েছিলাম। নীল সমুদ্রের ডাক যেন আমরা পরীক্ষার হল থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম...আয় আয় আয় তোদের আর পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না। যাই হোক পরীক্ষা শেষে বাড়ির পথে রওনা হলাম।
বাড়িতে সেদিন প্রায় শোকের ছায়া। সবার ভাবখানা এমন যেন মেয়ে যাচ্ছে শ্বশুর বাড়ি। লিজার বাবাও আমাদের বাসায় এসেছেন নিজেকে নিয়ে। আমার মা, খালা-খালু, আমি, লিজা, মৃদু রওনা হলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেদিন আমার মমতাময়ী মা আমার সব বন্ধুদের ধরে ধরে বলেছিল, স্বাতীকে কিন্তু কোনোভাবেই সমুদ্রে নামতে দিয়ো না। ও সাঁতার জানে না।
কথায় বলে অনেক আকাঙ্ক্ষার কিছু পেতে হলে অনেক কাঠ কয়লা পোড়াতে হয়। তেমনই হয়েছিল সেদিন। একে তো ছিল শৈত্যপ্রবাহ তার ওপর ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত। বাস রওনা দিল সমুদ্র পানে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পথে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি বাসটা কোনো দুর্ঘটনার কবলে পড়ল। এক একটা সময় মনে হতে লাগল, এখনই সব শেষ। এ জন্মে আর বোধ হয় সমুদ্র দেখা হলো না! পুরোটা রাত যেন বাসে বসে থাকা আমাদের সব বন্ধুদের চরম দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তবে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সেদিন আমাদের অনেক সাহস জুগিয়েছেন। তাঁরাও সেদিন আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সকালবেলা বাস গিয়ে থামল সাফারি পার্কের দুয়ারে। সবাই খুব বিরক্ত হলাম। এখানে কেন? শিক্ষা সফর বলে কথা। ছাত্র-ছাত্রীদের সাফারি পার্ক দেখানো হবে। ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত সবাই চেয়েছিলাম বাস থেকে নেমেই সমুদ্রে ঝাঁপ দেব তা না এখন সাফারি পার্কে পশু-পাখি দেখ।
যথারীতি আমরা যার যার বন্ধুদের নিয়ে পশু-পাখি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি, লিজা, মৃদু সুন্দর সবুজের পথ ধরে হাঁটছি আর ছবি তুলছি। হঠাৎ দেখলাম দূর থেকে রোকসানা, রুবি আর মিশু ছুটে আসছে আমাদের দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের বেগে দৌড়াতে দৌড়াতে ওরা বলল পালাও। তাকিয়ে দেখি হাতি, মস্ত বড় এক হাতি আমাদের দিকে ছুটে আসছে। প্রাণ হাতে নিয়ে দিলাম দৌড়। সমুদ্র দেখার সাধ জন্মের মতো মিটে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল পত্রিকার হেডলাইন...হাতির পদতলে পিষ্ট হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রীদের মৃত্যু। আর ভাবতে পারছিলাম না। রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম! হাতিটি খুব কাছে চলে আসল। তার দিকে তাকিয়ে আমাদের চোখ কপালে উঠল। যে হাতির ভয়ে এত লম্বা দৌড়, সে হাতির পায়ে শেকল আর পেছনে একজন লোক। নিজেদের এত বড় নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেরাই লজ্জা পাচ্ছিলাম।

একরাশ ক্লান্তি নিয়ে আবার বাসে উঠলাম। স্বাদের সমুদ্র আমাদের এভাবে ভোগাবে ভাবিনি। কক্সবাজার পৌঁছলাম। হোটেলে গিয়ে ব্যাগ রেখে সবাই ছুটলাম সমুদ্র পানে। সেই সমুদ্র যার জন্য এত ভোগান্তি। আজন্মলালিত স্বপ্ন সমুদ্র দর্শন পূরণ হলো! আমরা সব বন্ধুরা সমুদ্রের সামনে গিয়ে নিজেদের আর ধরে রাখতে পারলাম না। ঝাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রের বুকে। সে কী উচ্ছ্বাস, সে কী আনন্দ। আজীবন স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে রইল আমাদের বন্ধুদের সেই সমুদ্র দর্শন।
আজ এত বছর পর পুরোনো সেই স্মৃতির অ্যালবামটা আবারও খুলে বসলাম। বন্ধুরা কেউ আর কাছে নেই। দেশ-বিদেশে, দূর-দুরান্তে ছিটকে পড়েছি। তবুও সেই সব দিনের কথা মনে পড়লে ঠোঁটের কোণে এক ফালি চাঁদ হেসে ওঠে। খুব মনে পড়ে বন্ধুদের কথা।
গত ৭ আগস্ট ছিল বিশ্ব বন্ধু দিবস। বন্ধু দিবসকে ঘিরেই আমার এই আয়োজন। বন্ধুদের জন্য প্রীতি উপহার। আমার বিশ্বাস, আমার এই লেখা পড়ে আমার বন্ধুরা পুরোনো সেই দিনে ফিরে যাবে আর বলবে, ‘আয় আর একটি বার আয়রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়, মোরা সুখের দুঃখের কথা কবো, প্রাণ জুডাবে তায়...।’