সুরাইয়া...

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘জালিম’—এ নামটা খুব পরিচিত
পাশের বাড়ির মেয়ে মনে হয়।
তাই তো সেদিন দাদা বলল, ‘যদি পটে যেত বউটা!
এবার যদি মেয়ে হতো, সত্যি ওর নাম রাখতাম “সুরাইয়া”
জানিস তো, একই নামে সুরা ও সুর দুই-ই বর্তমান।’

সু রা ই য়া...
নাম ধরে ডাকতেই মনে হলো দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
দৌড়ে গিয়ে হুড়কো নামিয়ে দেখি,
একটা নীরবতা—দুরাকাঙ্ক্ষা—মৌন
একটা রঙিন, থমথমে মুখ
লাল-নীল সুতোয় বোনা একটা পুতুল...

গতকাল আমার মেয়ে পাশের বাড়িতে ফেলে এসেছিল,
এই যে পুতুলটা!
আচ্ছা, এ কি গান ভালোবাসে? সাজতে?
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বেগুনি রুমাল খোঁপায় জড়াতে?
এ কি গাইতে পারে?
‘ঘুংগট কি আড় সে দিলবার কা
দিদার আধুরা রেহেতা হে
যাব তাক না পারে আশিক কি নাজার
শৃঙ্গার আধুরা রেহেতা হে...’

তার সৌন্দর্য আকাশে ওঠে; কত গল্প কত কত কথা—
অদেখায় ঢাকা থাকল ঋজু পাঠ।
আমরা দুজন ছেলেবেলায় ভাঙা ধ্বংস সিঁড়ি বেয়ে
দুই-চার ধাপ টপকে, কত কুল পেড়েছি!
কাঁচামিঠা আম, আচারের বয়াম ভেঙেছি!
—সে কী ভয় ওর! দেখিস, আজ মা মেরেই ফেলবে!
পাপবোধে হাত দিয়ে, চোখ দেখি ভেসে যাচ্ছে—

কেমন একটা স্কুল পালানো ফন্দি,
পাঠ রোধ, ভুলভাল ব্যাকরণ,
আতঙ্ক বিজ্ঞান, বিফল গণিত।
গোলাপি-হাসনা বিলাস, তেলের বাটি
সবুজ শার্টিনের ফিতে, কাঠের চিরুনি, লম্বা কলা বেণি,
চুলটা আঁচড়ে দিতে দিতে ওর মায়ের বকুনি, ধাড়ি মেয়ে!
গোসল শেষে এক মাথা ভিজে চুল—ও টান খায় চুলে,
আমি বসে কান্নার সিঁথি কাটি দূরের দেয়ালে দেয়ালে...

জানিস তো, তোর নামটা নিয়ে কত খিস্তি-খেউড়
কাঁদতিস খুব বখাটে ছেলেটার খেপানোর শব্দ শুনে,
‘সুরাইয়া রে সুরাইয়া দিলি অন্তর জুড়াইয়া...’
—শোন বান্ধবী বলছি, তোর নাম আখ্যান আরব দেশের;
সুরা থাকে সুর থাকে, থাকে মাতলামি।
এখন কি তোর জন্য কেউ মাতাল হয়?
তোর কি রাগের গ্রীষ্মতাপ গায়ে লাগে?
তুই কি ভালো রাঁধিস এখন?
শুনেছি তুই স্কুলে পড়াস—দিদিমণি নাকি?
টিউশনটা জমেছে কি?
কেমন বুঝিস সংসার মাটির জ্যামিতি?
শুনেছি তোর উঠানভরা গাছ,
ফড়িং ওড়ে, ফলে-মূলে ঠোকরায় নাকি পাখি!

জানিস, আমি পেয়ারাটা এখনো খাই নুন আর ধানি মরিচ ছাড়াই,
তোর কথা ভাবি আর স্মৃতির জালখানি রোদে শুকাই।
জানি, তোর ঘরে আমার ভালোবাসা মাপবার যন্ত্রখানি নাই
নাই কোনো অনুভূতি, নাই সেই বোঝাপড়া।

মনে আছে তোর আমার লেখা চিঠি?
প্রেম করতিস তুই আর অনুভূতি লিখতাম আমি!
কত ডাকি তোরে, ‘ওরে বন্ধু, ওরে আমার সুন্দর...’
ডাকি দূরে থেকে...নিরুপায়...

এ কবিতাটা পড়বার একটা বিহিত অন্তত কর—
জানিস, আজ বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে মন,
স্মৃতির পাতা উল্টে যাচ্ছে জলে;
সেই অমলা ডোবার উল্টে দেওয়া হাওয়া—
ফ্রকের বেলুন উড়িয়ে যেন কিশোরবেলায় যাওয়া।
বুঝবি তো এই কবিতা? একেবারে সহজ বাংলায় লেখা
—পড়িস, যদি পত্রিকাতে ছাপে।

আমি চিরটাকাল ভ্রাম্যমাণ হিমালয়ের মতো উদাসীন।
জানি জানি জানি, আমি তোর জীবনে শিহরিত ছত্রাক!
যদি কখনো সময় পাই,
দেব প্রেম-সুধা-সিন্ধু এক আঁজলা ভরে
সুরা ও সুর এক করে ডাকব নতুন করে
‘সুরাইয়া’ আমার বাল্যবন্ধুরে...।

নাজমীন মর্তুজা: অ্যাডিলেড, অষ্ট্রেলিয়া।