
আমার কানাডা আসার সিদ্ধান্ত ছিল আকস্মিক। একসময় আমি হুটহাট সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। পরিণতি না ভেবেই অনেক কিছু করেছি আমি। অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সে জন্য আমাকে অনেক ভুগতে হয়েছে। তবে আজকাল হুটহাট সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করি। জেসমিনের জন্যই আমি অনেক নিয়ন্ত্রিত। তারপরও কি আমি উল্টাপাল্টা সব কাণ্ড করি না! করি। আজব আজব সিদ্ধান্ত নিই। আমি অনেক ভুল করি। এমন একটা কাজ করি, যা করা উচিত না। এমন একটা কথা বলি যা বলা উচিত না। আবেগের বশবর্তী হয়েই এসব করি। কিন্তু বেশির ভাগ আবেগই অন্যের কাছে মূল্যহীন। আমি হয়তো মহা আবেগ নিয়ে একটা কিছু বলতে যাই, জেসমিন কিছুক্ষণ শোনার পর এমন একটা মন্তব্য করবে যে আবেগটা মাঠে মারা যাবে তখনই। আমি মনে মনে ভাবি, ইশ্, কেন যে বিয়ে করতে গেলাম! যদি একলা থাকতাম, তাহলে যা মন চায় করতে পারতাম! যেখানে খুশি যেতে পারতাম। বিয়ে মানেই একটা শৃঙ্খল। একা একা গান গাই ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে...’।
কানাডা আসার সিদ্ধান্ত ছিল আমার একক। হঠাৎই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। একদিন প্রেসক্লাবে বসে আমরা কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেখানে খায়রুল আনোয়ার মুকুল, রেজোয়ানুল হক রাজা, আবদাল আহমেদ প্রমুখ ছিলেন। আমরা চা খাচ্ছি আর গল্প করছি। সেটা ২০০০ সালের কথা। আমি মাত্র কয়েক দিন আগে আমেরিকা থেকে ঘুরে গেছি। মিলেনিয়াম ২০০০ উপলক্ষে জাতিসংঘের একটা প্রোগ্রামে এসেছিলাম। মহাসচিব কফি আনানকে সেবার সামনে থেকে দেখেছিলাম। তখনো ৯/১১ ঘটেনি। আমেরিকা তখনো স্বর্গ।
নিউইয়র্কে আমার কয়েকজন বন্ধু আমাকে বলল, মল্লিক, থেকে যাও।
আমি বললাম, আমার ছেলেমেয়ে রেখে!
ওরা বলল, একসময় নিয়ে আসবা! কতজনই থেকে যায়।
আমি বললাম, মাথা খারাপ হইছে! ওদের রেখে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না।
অরিত্রি তখন খুব ছোট। হঠাৎ ওর কথা মনে করে আমার চোখটা ভিজে উঠল। এক মাস ধরে দেখি না! যদি কখনো কোথাও যাই একসঙ্গে যাব, নইলে না।
বসবাসের জন্য কোন দেশ কেমন ইত্যাদি নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম। আমেরিকা থেকে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলাম।
রাজা ভাই বলল, জসিম, আপনি কানাডা চেষ্টা করে দেখেন।
আমি বললাম, কানাডা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নাই। কেমনে যেতে হয় তা-ও জানি না।
আমার এক বন্ধু আছে। সে কানাডায় অভিবাসনের কাজ করে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সে আপনাকে তথ্য দিতে পারবে।
অভিবাসনটা কী আসলে!
রাজা ভাই হেসে বললেন, আপনি সে দেশে থাকার অধিকার পাবেন। নাগরিকত্ব পাবেন...। আগে আপনাকে অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে...।
ধুর, রাজা ভাই, আমার ওসব হবে না। তা ছাড়া আমার স্ত্রী কোনো দিনই রাজি হবে না। সে আমার সঙ্গে আমেরিকাই গেল না ঘুরতে।
রাজা ভাই তা-ও আমাকে তার বন্ধুর ঠিকানা দিলেন।
আমার মাথায় কেবল ঘুরঘুর করছে চলে যাব, চলে যাব, কোথাও চলে যাব দূরে। তখন আমি চাকরি নিয়ে খুব ফেডআপ ছিলাম। আমি অতিষ্ঠ। তখনই মাথায় ঢুকেছিল, এই দেশেই থাকব না। আমেরিকা থেকে ঘুরে আসার পরই বিদেশে যাওয়ার পোকা মাথায় ঢোকে।
২.
তাজমহল রোড। অফিসটার নাম সাউথ ইস্ট ইন্টারন্যাশনাল। একদিন দুপুরে গেলাম সেখানে। দোতলায় উঠলাম। গিয়ে দেখি লোকজন গিজগিজ করছে। এত লোকজন কানাডা চলে যেতে চায়! ভেবে আমি একটু লজ্জা পেলাম। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর আমার ডাক এল। একদম শেষের দিকে একটা রুমে ঢুকলাম। দেখি রিভলভিং চেয়ারে ফরসা টুকটুকে এবং নাদুসনুদুস টাইপ একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, রাজা ভাই আমাকে কার কাছে পাঠালেন! এ তো একজন বিদেশি! আমি ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করলাম। আমার নাম বললাম। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, বসেন। রাজা আপনার কথা বলেছে। ও, ইনি বাঙালি! আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কী বোকা আমি। আমি ভেবেছি ইংরেজ। তিনি আমার রেজুমি রেখে দিলেন। বললেন, অ্যাসেসমেন্ট করে যদি কোয়ালিফাই করি, তাহলে জানাবেন। শিগগিরই আমাকে জানানো হলো, আমি আবেদন করার যোগ্য। তখন পয়েন্ট দরকার হতো ৭০। আইইএলটিএস ছিল না। স্পাউসের পয়েন্টও পাব না আমি। তার ওপর কানাডায় আমার কোনো রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় নাই। এখানেও আমি পাঁচ পয়েন্ট হারিয়েছি। তা সত্ত্বেও আমি সাংবাদিক ক্যাটাগরিতে আবেদন করার যোগ্য হলাম।
কাগজপত্র জোগাড় করে আবেদন করলাম। কয়েক দিনের মধ্যে এক্সেপ্টেটেন্স লেটার পেলাম। এখন অপেক্ষা। আমার ফাইল পাঠানো হলো নয়াদিল্লি। এরপর বিষয়টা নিয়ে তেমন আর মাথা ঘামাচ্ছিলাম না। কারণ, যেদিন বললাম, কানাডার জন্য আবেদন করছি সেদিনই জেসমিন বলল, খাইয়া আর কাম পাওনা। তোমার কোনো দিন ওসব হবে না। শুধু শুধু পয়সা নষ্ট। আর আমি বিদেশে যেতে চাই না। সে আমাকে চরম অসহযোগিতা করল। আমি হতাশ হলাম মনে মনে। ওকে, না যেতে চাইলে না। বিদেশে না গেলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে না। তখন আমি মহাব্যস্ত চাকরি নিয়ে। কানাডা দেশটি সম্পর্কে বেশি কিছু জানিও না। এখনকার মতো এত তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারও হয়নি। এখন যাঁরা আসেন তাঁরা সব জেনেই আসেন, তাঁরা অনেক স্মার্ট এবং নিজেরাই আবেদন করেন। বছরখানেক যেতে বুঝতে পারলাম, দিল্লিতে ৫-৬ বছরের আগে হওয়ার সম্ভাবনা নাই। আমি চরম হতাশ, আশাও ছেড়ে দিলাম। এত দিন অপেক্ষা করতে হবে! কোনো মানে হয় না। আবার শুনি অভিবাসনের নিয়মকানুন প্রায়ই পরিবর্তন হয়। কখন কী হয় কে জানে!
হঠাৎ একদিন আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। নিজের বুদ্ধিতে নিজেই হতবাক। সেটা ২০০২ সাল। মাসটা ভুলে গেছি। একদিন আবার সেই ইংরেজ (শাহ জহির) মানুষটার কাছে গেলাম। তত দিনে আমরা বন্ধু হয়ে গেছি। আমরা প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে সোনারগাঁও হোটেলে যাই, আড্ডা হয়। খাই দাই। একদিন তাঁর অফিসে গিয়ে বললাম, আমার ফাইলটা আমেরিকায় ট্রান্সফার করেন।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, মানে কী!
দিল্লিতে মনে হচ্ছে অনেক সময় লাগবে, অত দিন অপেক্ষা করার ধৈর্য আমার নাই।
সবাইকেই একই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ওখানে তো আমাদের কোনো হাত নাই।
সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু ফাইল ট্রান্সফার করার কোনো উপায় কি আছে! শুনেছি, আমেরিকায় তাড়াতাড়ি হয়। অত চাপ নাই।
তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, অবশ্যই ফাইল ট্রান্সফার করা যাবে। ১০০ ডলার ট্রান্সফার ফি লাগবে শুধু!
আমি বললাম, ফাইন, তাহলে তা-ই করেন।
কিন্তু আমেরিকা যে যাবেন, ভিসা তো লাগবে।
আমি বললাম, ভিসা সমস্যা হবে না। পাঁচ বছরের মাল্টিপল ভিসা আছে।
৩.
যথারীতি ফাইল ট্রান্সফার হলো। আবার অপেক্ষা। এর মধ্যে ৯/১১ হওয়ায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। আমি চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলাম। আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে হঠাৎ কড়াকড়ি হয়ে গেল। যে আমেরিকা স্বর্গ বলে বিবেচিত হতো, তা হঠাৎ নরকে পরিণত হলো যেন। নিশ্চিত হলাম, আমার আম-ছালা দুটোই গেছে। কোনো তথ্যও পাচ্ছি না। কিন্তু বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। ডাক এসে গেল। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সাল, লস অ্যাঞ্জেলেসে আমার সাক্ষাৎকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকায় গিয়ে আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে হবে! তখন আবেগের বশবর্তী হয়ে ফাইল ট্রান্সফার করেছিলাম। আমি ভয়ে তখনই ঘেমে গেলাম। একে তো আমেরিকা যাওয়ার কড়াকড়ি, তার ওপর আমাকে সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে হবে! আমি সব সময়ই সাক্ষাৎকারে ভয় পাই এবং ফেল করি। একটা জিজ্ঞেস করলে বলি আরেকটা। ওদের ইংরেজি ঠিকমতো বুঝব না নিশ্চিত।
জেসমিনকে একদিন বললাম, আমি আমেরিকা যাচ্ছি।
জেসমিন আকাশ থেকে পড়ল যেন, বলল, কেন!
ইন্টারভিউ দিতে।
কিসের ইন্টারভিউ!
কানাডা ইমিগ্রেশনের।
না, তোমাকে যেতে হবে না।
কেন যাব না!
তোমার হবে না। তুমি পাস করতে পারবা না।
তা-ও গেলাম। মোটামুটি নির্বিঘ্নে পৌঁছলাম। উঠলাম আমার বন্ধু পিয়ালের কাছে। চার-পাঁচ দিন আগেই এসেছি। ইন্টারভিউ ছিল সকাল ১০টায়। পিয়াল আমাকে এলএর ডাউনটাউনে কানাডার ইমিগ্রেশন অফিসে নামিয়ে দিল। আমি দোয়াদরুদ পড়ে ঢুকলাম।
ইন্টারভিউ চলছে। একজন অতীব সুন্দরী অফিসার গ্লাসের ওপার থেকে প্রশ্ন করছে, আমি এপারে বসে উত্তর দিচ্ছি। যেন মনে হচ্ছিল, কোনো ভিন গ্রহ থেকে কেউ কিছু বলছে আমাকে। গায়েবি ব্যাপার। একজন বিশাল সাইজের পুরুষ, সেটা আবার পাশে বসে ওয়াচ করছে। কী উত্তর দিচ্ছি, নিজেও জানি না। ইন্টারভিউ শেষ। প্রশ্নকর্তা এবার বললেন, তোমার কোনো প্রশ্ন আছে!
আমি বললাম, আছে।
বলো, কী প্রশ্ন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি ইন্টারভিউতে পাস করেছি!
এটা আমার জানা খুব দরকার ছিল। কারণ, আমি কোনো অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে চাই না। আবার এটাও জানি, যদি ফেল করি, তাহলে আমার আমেরিকা ভ্রমণ মাটি হয়ে যাবে। আমি পুরো ফেব্রুয়ারি মাস থাকার প্ল্যান করে এসেছি। তা না হলে আমি মনের দুঃখে চলে যাব দেশে।
অফিসার মেয়েটি খুশি মনে বলল, হ্যাঁ, তুমি পাস করেছ। তোমার কাছে টাকা থাকলে ল্যান্ডিং ফি দিয়ে যেতে পারো।
কোথায় টাকা জমা দেব!
৬ নম্বর কাউন্টারে যাও।
৪.
আমি কয়েক দিন থাকলাম লস অ্যাঞ্জেলেসে। অস্কার নমিনেশন প্রোগ্রামে গেলাম, লাস ভেগাস গেলাম পিয়ালের সঙ্গে। মাঝখানে নিউইয়র্কে গেলাম সেখান থেকে। তারপর কলি আপাকে বলে টিকিট পরিবর্তন করে আগেই দেশে ফিরে এলাম। কলি আপা তখন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে চাকরি করেন। লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকেন। তারপর সবকিছু দ্রুত ঘটল।
এখন প্রস্তুতি। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় শিকড় গাড়া এত সহজ কাজ না। জেসমিন যেন কোনো উৎসাহ পাচ্ছে না। চাকরি থেকে রিজাইন করতে গড়িমসি করছে। আমার ওপর কোনো ভরসা নাই তার। বিদেশে গিয়ে আমরা কী করব! এর চেয়ে বড় বোকামি আর নাই—এটাই জেসমিনের ধারণা। আমার ছোট্ট অরিত্রি একদিন বলল, বাবা, আমি কানাডা যাব না।
কেন মা!
আমি তো আমার স্কুলের বন্ধুদের রেখে যেতে পারব না।
আমি বললাম, তাও তো কথা। কিন্তু ওখানে তুমি অনেক বন্ধু পাবা।
অরিত্রি ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল, আমাকে রেখে যাও বাবা।
তোমাকে ছাড়া যে আমরা থাকতে পারব না মা!
অর্কর কোনো ভাবান্তর নাই। সে কানাডা সম্পর্কে ইন্টারনেট ঘেঁটে তথ্য জানছে। কখন স্কুল শুরু—এসব নানা কিছু। এক মাসেই সে ১ হাজার ২০০ টাকা বিল তুলে ফেলল। তখন টিঅ্যান্ডটি ইন্টারনেট চালু করেছে।
আমরা সেই বছরই ২৮ জুন কানাডায় পা রাখলাম। প্রথম এক বছর অটোয়া ছিল আমার নিবাস। তারপর টরন্টো চলে এলাম।
তখনো অরিত্রি বলল, বাবা, আমি টরন্টো যেতে চাই না।
কেন মা!
আমি আমার বন্ধুদের রেখে যেতে পারব না।
টরন্টো গেলেও অনেক বন্ধু পাবা তুমি।
একদিন বড় হলো অরিত্রি। টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো সে। পড়া শেষ, এখন চাকরি করছে। তা-ও রাখতেই। কারণ টরন্টোর বন্ধুদের রেখে সে কোথাও যেতে পারবে না…! জীবনানন্দের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি
কোন দূর কুহকের কূল
লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল
কেবা তাহা জানে
অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে…!
টরন্টো, ২৬ নভেম্বর ২০১৭