সিমরানের নতুন নেশা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমার নয় দিনের ছুটিতে ট্রেন-কোচে ইউরোপের কিছু শহর ঘুরলাম। ঠিক বিলাসী ভ্রমণ নয়। রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটানো। ইউরোপ ভ্রমণের জন্য নয় দিন খুব কম সময়। ফ্রান্সের কিছু বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট আগে দেখা ছিল। তাই প্যাকেজ ভ্রমণের দল থেকে আলাদা হয়ে চার ঘণ্টা ফ্রান্সের মার্সেলের রাস্তায় হেঁটে বেড়ালাম। রাস্তাঘাট চিনি না। ছাগলের দুধের পনির আর ক্রসন খেয়ে মিটিং পয়েন্ট মনে রেখে আস্তে ধীরে হাঁটতে থাকি। পরের শহর বেলজিয়ামের ব্রাসেলস। তারপর হল্যান্ডের আমস্টারডাম।
এই শহরের রেড লাইন আর রেড লাইট আমার এবারকার সফরের মূল আকর্ষণ। রেড লাইন মানে সাইকেলের রাস্তা। খাল আর সাইকেল এই শহরের প্রাণ। পৃথিবী বিখ্যাত রেড লাইটের বারবনিতারা এখানকার টুরিস্ট আকর্ষণ। মেনিকেনের মতন তাদের আলো ঝলমলে দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়। ভোগবাদী দুনিয়ার রক্ত মাংসের পণ্য ডিসপ্লে। নিজের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এই রাস্তায় আসা সম্ভব নয়।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

রেড লাইট এলাকায় বিশাল ক্যাথিড্রাল চার্চ দেখে হাসলাম। পাপ, প্রায়শ্চিত্ত আর পুণ্য সবকিছুর ব্যবস্থা রাখা এক এলাকায়। সেন্ট্রাল স্টেশনের সামনে পিংক ফ্লয়েড নামের এক স্যান্ডউইচ বার বা ক্যাফেতে ঢুকলাম। নেদারল্যান্ডসে সব ক্যাফেতে গাঁজা, মারিজুয়ানা ও হ্যাশিশ পাওয়া যায়। পাঁচ গ্রাম পর্যন্ত পুলিশ অনুমোদন করে। তার বেশি হলে পুলিশ তা নিয়ে নেয়, কিন্তু শাস্তি দেয় না। কফির সঙ্গে একটা জয়েন্ট নিলাম। জয়েন্ট হচ্ছে গাঁজা আর অল্প তামাক দিয়ে রোল করা হাতে বানানো সিগারেট। ক্যাফের এক তরুণের কাছে শিখে নিলাম পরিমাণ মেশানোটা। হল্যান্ডের রাস্তাঘাটের লোকজন অনেক ভদ্র ও পরিবেশ সচেতন। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি রেখে তারা সাইকেল নিয়ে চলা ফেরা করে।
বেলজিয়ামের শহর ব্রুসে পৃথিবীসেরা বেলজিয়ান চকলেট আর বিয়ার চাখতে গিয়ে বুচার নামের রাস্তায় এক ক্যাফের সামনে বসে নরম রোদ গায়ে মেখে রাস্তার মিউজিশিয়ানের অপূর্ব গিটার শুনছি। সেখানে পরিচয় হয় সিমরান কাউরের সঙ্গে। ভদ্রমহিলার বয়স ৫৯। আমাদের দলের। আমার মতো একা এসেছেন। আমি রসিকতা করলাম, সিমরান? তোমার রাজ কই? বুঝতে পারে না। মুখে একচিলতে হাসি। বললাম, শাহরুখ-কাজলের ডিএলজি ফিল্মের কথা। সেখানে নায়িকার নাম সিমরান।
ওহ ইয়েস। ভদ্রমহিলা বালিকার মতো উচ্ছল হয়ে বলেন, ওই ফিল্মটা আমি অনেকবার দেখেছি।
গল্প শুরু হলো। সেই গল্প জার্মানির কোলন শহরে গিয়ে করুণ হয়। রাইন নদীর পাড়ে রাতের ডোম দেখতে দেখতে সিমরানের গল্প শুনতে গিয়ে আমার চোখে বাষ্প জমেছে। দুটা জয়েন্ট বানালাম। একটা তাঁকে দিয়ে, আরেকটায় টান দিয়ে ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে বলি, সব দুঃখ ধোয়ার মতন, রাতের অন্ধকারে বাতাসে উড়িয়ে দাও।
সিমরান জয়েন্ট আমার হাতে দিয়ে বলে, ছি!, আমি এগুলো খাই না। কি বাজে গন্ধ।
আমিতো রুটিন জীবনে ছুঁতে পারি না। ছুটিতে সব নিয়ম ভাঙি।
সিমরান আমার কথার আমল দিল না। তাঁর ফিরিয়ে দেওয়া জয়েন্ট আমি কানে পেনসিলের মতন গুঁজে রাখি। রাতের খাবার শেষ। একটু হাঁটাহাঁটি করে হোটেলে ঘুমাতে যাব। সকালে সুইজারল্যান্ডের বার্নের ট্রেন ধরতে হবে।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে সিমরানের কথা কানে বাজে, ‘আমার স্বামী, আমাদের সংসার আর বাড়ির মর্টগেজ টেনেছে। আমিও রোজগার করে একমাত্র ছেলের প্রাইভেট স্কুলের খরচ বহন করেছি। হলিডে বিলাসিতা ছিল। তাই কোথাও যেতে পারিনি। কেমব্রিজ থেকে পাস করে ছেলে জেপি মরগানের ইনভেস্টর হলো। সে আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে ভালো এলাকায় বাড়ি কিনে উপহার দেয়।’
এক ভোরে সিমরান তার ৩৫ বছরের ছেলের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু সংবাদ পায়। দুই বছর পর ছেলের বউয়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। তারপর কয়েক মাস আগে স্বামীর ক্যানসারে মৃত্যু শোক। লন্ডনের এক ভাগনি তাঁকে টিকিট করে দিয়ে বলে যাও ইউরোপ ঘুরে আস। তোমার একটু ভালো লাগবে।
ছোটখাটো স্লিম সিমরানকে বেশ কমবয়সী দেখায়। তার নাকের হিরার নাক ফুল অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে। আধো আলো, আধো অন্ধকারে চোখের অশ্রুও চিকচিক করে।
সিমরান বলে, আমি কি নিয়ে বাঁচব এখন? একা থাকতে ভয় পাই।
আমি তাঁর চোখের জল মুছে দিয়ে বলি, সিমরান transform your fear in to freedom, নিজেকে নিয়ে বাঁচবে। লোকজনরে সাহায্য করবে, মানুষকে কোনো কিছুর আশা না করে সাহায্য করলে দুঃখ কমে। ঈশ্বরকে ডাকবে, গান শুনবে, নাচবে। আমার মতন ফেসবুকিং করবে। কাজের কি অভাব আছে? তাই করবে, যাতে শান্তি পাবে। সময় এমন কোনো ক্ষত নাই যা ঠিক করে না। মানুষ পৃথিবীতে স্থায়ীভাবে থাকতে আসে না। জীবনের সম্পর্কগুলো বেশি সিরিয়াসলি নিলে সমস্যা, আবার না নিলেও।
বার্নে দুই ঘণ্টার ঘোরাঘুরি। সিমরান আমার সঙ্গী হতে চায়। আমি বলি, তুমি দলের সঙ্গে থাকো। আমি নিজের মতন আস্তে আস্তে হাঁটব। প্রত্যেকটা শহরের বাড়িঘর, দালানের কাঠামোর সঙ্গে একটা আলাদা গন্ধ আর ইতিহাস মিশে আছে। পুরোনো বার্ন শহরে হাঁটতে গিয়ে মনে হয় ইতিহাসের পাতায় হাঁটছি। ১৯৮৩ সালে ইউনেসকো এই বার্নকে পৃথিবীর হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তাই মধ্যযুগের বাড়িঘরও আছে আগের মতন।
বার্ন থেকে ফ্রান্স হয়ে স্পেনের বার্সেলোনায় সমুদ্র স্নান। তারপর লন্ডন ফেরার পথে আবার ফ্রান্স হয়ে যেতে হয়। প্যারিসের ট্রেন স্টেশনে তিন সিরিয়ান শরণার্থী পরিবারের নয়জন সদস্যের দেখা মেলে। তারা রাস্তাঘাটে ঘুমায়। সঙ্গে শিশু। আমার ছেলের বয়সী কয়েকজন। তাদের ইচ্ছা তারা সুইডেন গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। ফ্রান্সে সুবিধা করতে পারছে না।
আমার নিজের কাছে থাকা ক্যাশ শেষ। ক্রেডিট কার্ড থেকে মোটা ইন্টারেস্টে কিছু টাকা তুলে দিলাম। গলায় মেয়ের দেওয়া একটা হোয়াইট গোল্ডের আর ডায়মন্ডের লকেটের চেন ছিল। তার সঙ্গে হিরার কানের টপস। সেগুলো নিয়ে স্টেশনের গোল্ড স্মিথের জুয়েলারির দোকানে গেলাম। সিরিয়ান গৃহকর্তা ফ্রেঞ্চ বলতে পারে। তাকে দিয়ে দরদাম করিয়ে যা পেলাম তা তাদের হাতে তুলে দিলাম।
আমি জানি না ওই চেন কখনো পরি নাই। কী মনে করে এই ভ্রমণে পরেছিলাম। আমার রেকসেক ব্যাগটাও দিয়ে দিলাম। ছেলের জন্য বেলজিয়ান চকলেট ছিল। সেগুলো শিশুদের দিলাম। পাসপোর্ট ও ক্রেডিট কার্ডটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিলাম। সিরিয়ান গৃহকর্তাকে বললাম, কিছু ক্যাম্পিংয়ের তাঁবু কিনতে। গরমে খোলা মাঠে বা কোথাও তাঁবু টানিয়ে ক্যাম্পিং স্টাইলে থাকতে পারবে। যত দিন না সরকার বাড়ি বা হোস্টেল দেয়। গৃহকর্তাকে আরও বললাম, ইনশা আল্লাহ শীতের আগে তোমাদের নিরাপদ আশ্রয় মিলবে।
সিমরান কাউর তখন আমার পাশে। বলল, তুমি একটা পাগল। মুহূর্তে আমার এই কর্ম ছোঁয়াচে ভাইরাস হয়ে গেল। সিমরান তার নিজের হাতের সোনার এক জোড়া চুড়ি খুলে বলে, এগুলো বিক্রি করে যা পাব তা দিয়ে দিই?
আমি বললাম, কেন নয়?
আমি না হয় গাঁজার নেশায়। সিমরান কীসের নেশায় কে জানে? সেও জলের দামে সোনার বালা বিক্রি করে পয়সা তুলে দেয় তিন শরণার্থী পরিবারের হাতে। যাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ভ্রমণের কাগজ জোগাড় করেছে। কিন্তু টিকিট জোগাড় করতে পারছে না বলে চার দিন স্টেশনে বসে আছে।
সিমরান ট্রেনে পাশে বসে আমার। বলতে থাকে, অনেক শান্তি লাগছে। আমার সাহায্য কিছু মানুষের কাজে লাগবে।
আমি একটা জয়েন্ট বানাই। বলি এটা শেষ। আর নাই ষ্টকে। এক টান দেবে?
বলে, না। সিমরান আবেগপ্রবণ হয়ে বলে, তোমার গাঁজার নেশা থেকে গলার চেন আর সবকিছু দিয়ে দেওয়ার নেশা আমি নিলাম। বাকি জীবন এই দেওয়ার নেশায় আমি থাকতে চাই।
আমি হাসি, জয়েন্ট টানি আমি। নেশা হয় আরেকজনের! গুণগুণ করি, নেশা লাগিলরে, বাঁকা দু নয়নে নেশা লাগিলরে। বললাম, ইউরোপের শহরের চেয়ে তুমি অনেক মনকাড়া। এই ভ্রমণের সেরা প্রাপ্তি তুমি। শহর নিয়ে তো ভূরি ভূরি ছবি, লেখা বাজারে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। তোমারে নিয়ে লিখব। তোমার পুণ্য বা নেকি ফেসবুকে ঢেলে দেব।
সিমরান মাথা নেড়ে সায় দেয়। বলে, এরপর কি আমরা একসঙ্গে আরেকটা হলিডে করব?
আমি রসিকতা কিন্তু সিরিয়াস হয়ে বলি, পরেরবার বাকি গয়নার বাক্স নিয়া আইস।
এই ভ্রমণে থ্রিল খুঁজতে গিয়ে এক গল্প, নতুন বন্ধুত্ব আর প্লেট ভর্তি ভাত তরকারি খাবার ও দুর্বিনীত ক্রেভ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সঙ্গে ক্রেডিট কার্ডের ঋণ। তাতে কি? আমার ঘরেও কিছু গয়না আছে। কবরে তো নিয়ে যাব না মমির মতন।