সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট

চারদিকে কোনো জনমানব নেই। ধু ধু মাঠ। মাঝখানে এক রুমের একটা বাড়ি।
বাড়িটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল। হল বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না। হল তো দূরের কথা হোস্টেলও এর চেয়ে অনেক বড় হয়। ডরমিটরি কি বলা যেতে পারে? তার চেয়ে বরং স্টুডেন্ট অ্যাকোমোডেশন বলেই চালিয়ে দিই। এই বাড়িতে একটা মাত্র রুম। দুটো বাঙ্ক বেড মানে দোতলা খাট।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সিটের অনেক স্বল্পতা। কোনো সিট ফাঁকা রাখা যাবে না। তাই এক রুমে দুটো বাঙ্ক বেডে চারজনের থাকার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। চারজনের মধ্যে দুজন ছাত্রী। সঙ্গে আমি আর আমার এক কলেজ বন্ধু।
দূর দুরান্ত থেকে আজই এখানে এসেছি সবাই। দুপুর ১২টা বাজে। দুপুরে কিছু একটা খেতে হবে। আমি আর আমার বন্ধু মিলে বাজারে যেতে চাইলাম। কিন্তু বাকি দুই রুমমেট আমাদের যেতে দিলেন না। তারা বললেন, তাদের কাছে দুপুরে রান্না করার মতো সরঞ্জাম আছে। বিকেলে বাজার করে আনলেই চলবে। আমরাও তাই করলাম।

আমার বন্ধুটি গানের খুব ভক্ত। সে সঙ্গে একটা ব্লুটুথ স্পিকার নিয়ে এসেছে। মোবাইল ফোন থেকে সরাসরি স্পিকারে গান বাজানো যায়। পাশে কাচা চুলায় রান্না হচ্ছে। রন্ধন শিল্পী আমাদের হাউজমেট বান্ধবীদ্বয়। খুব আয়োজন করে রান্না হচ্ছে। তারা রান্নাবান্না নিয়ে খুব ব্যস্ত। কী যে সুস্বাদু রান্না হবে তারই অপেক্ষায় আছি। আজ রাত থেকেই নিজেদের রান্না নিজেরা করতে হবে। তাই আমি অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবিরের রান্না খাদ্য পুষ্টি বই থেকে দু-একটা রেসিপি মুখস্থ করার চেষ্টা করছি। বেসনের সঙ্গে বেকিং পাউডার ভালোভাবে মিশাও। হলুদ, মরিচ, লবণ দাও...
বন্ধু ব্লুটুথ স্পিকারে গান বাজাচ্ছে। এ মুহূর্তে জলের গান ব্যান্ডের এই গানটি বাজছে:
আমি একটা পাতার ছবি আঁকি
পাতাটা গাছ হয়ে যায়।
মাথা ভরা সবুজ কচি পাতায়
গাছটাকে ছাতা মনে হয়।
আরিরে আরি রাং ছুরিরে আরি ছুরি বাং।...
রান্না শেষ হয়ে গেছে। খুব আগ্রহ সহকারে খেতে গেলাম। রন্ধন শিল্পীদের রান্না অবাক করার মতো। তারা পাতা ছাড়া কিছুই রান্না করেননি। বড় বড় ডালসহ কাঁঠাল পাতা তো আছেই। আর লম্বা লম্বা ঘাসের সুপ নাকি তাদের স্পেশাল রেসিপি। মেয়ে দুজন খুব মজা করে নিজেদের রান্না করা পাতা খাচ্ছে। আমরা বাকি দুজন একটু কাঁচুমাচু করছি। আজকেই প্রথম হোস্টেলে উঠেছি। খুব ভালো ভাবে পরিচয় হয়নি। ভদ্রতার খাতিরে তাদের কিছু বলতেও পাচ্ছি না। একটু ভালো পরিচয় হলে হয়তো বলতাম। এই পাতার ছাতা কী রান্না করেছিস? তোদের রান্না তোরাই খা। কী আর করা। একটা বাটিতে কিছু ঘাসের সুপ নিয়েছি। এরপর এক চামচ সুপ নিয়ে মুখে দিতে যাচ্ছি। এরই মাঝে বিকট শব্দে মোবাইলে রিং বেজে উঠল।
মোবাইলের রিংয়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মানির মান আল্লাই রাখেন। পাতা আর ঘাস আর আমার খেতে হলো না। যদিও স্বপ্নটা ভালোই লাগছিল। তড়িঘড়ি করে ফোন ধরলাম। মুন্না ভাই ফোন করেছেন।
হ্যালো রাফি ভাই। আসসালামু আলাইকুম। কোরবানির মাংস আনতে যাবেন না?
ঘড়ির দিকে তাকালাম। বাজে সকাল দশটা পাঁচ। দশটায় আমাদের কোরবানির মাংস আনতে যাওয়ার কথা ছিল। ওয়ালাইকুম সালাম। জি যাব। আপনারা কি রেডি?
জি। আমি আর আলো ভাই রেডি হয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।
ইমন ভাইও যাবে নাকি? ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম আমি।
না, ইমন ভাইয়ের অফিসে জরুরি কাজ আছে। উনি অফিসে গেছেন।
চারজন হলে অবশ্য আড্ডাটা ভালো জমত। হাসতে হাসতে বললাম।
মুন্না ভাই হেসে উত্তর দিলেন, আগে গরু সামলাই তারপর আড্ডা।
আচ্ছা আপনারা চলে যান। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে চলে আসছি। আল্লাহ হাফেজ।
আল্লাহ হাফেজ।
পনেরো মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে ফার্মে গেলাম। এখনো মাংস কাটাই শেষ হয়নি। দুজন মাংসগুলো ছোট ছোট টুকরো করছে। সমিলের (Saw Mill) মেশিনে কাঠ কাটার মতো হাড্ডি কাটা হচ্ছে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে মেশিনের মোটর নষ্ট হয়ে গেল। তাই কিছু হাড্ডি না কেটেই আমাদের সব মাংস ডেলিভারি দেওয়া হলো। ফার্ম থেকে মাংস নিয়ে মুন্না ভাইয়ের বাসায় গেলাম। আলো ভাই হাড্ডিগুলো কেটে ছোট করে দিলেন। মাংস ভাগাভাগি শুরু করলাম। দুই গরুর চৌদ্দটা ভাগ করতে হবে। মুন্না ভাই হাই প্রিসিসন স্কেল দিয়ে মেপে মেপে বিভিন্ন ভাগে দিচ্ছেন। এক গ্রাম মাংসও কোনো ভাগে এদিক ওদিক করছেন না। তিনি ফার্মেসিতে লেখাপড়া করেছেন। মাপ চোঙ, পিপেট দিয়ে মাপাঝোকা করা তার অভ্যাস। তাই হয়তো ওনার পক্ষেই এটা সম্ভব। আমি হলে হয়তো এক গ্রাম কেন কোনো ভাগে এক কেজি এদিক ওদিক হওয়াটাও অস্বাভাবিক ছিল না। বুয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের কেমিস্ট্রি পড়তে হতো। কেমিস্ট্রি ল্যাবে পিপেট দিয়ে কোনো একটা লিকুইড মেপে অন্য পাত্রে ঢালতে হতো। লিকুইডটার নাম ভুলে গেছি। মুখ দিয়ে টান দিয়ে লিকুইড পিপেটে মাপতে গিয়ে কতবার যে নিজের মুখেই সলিউশন ঢুকিয়ে ফেলেছি তার সংখ্যা মনে নেই।
মাংস ভাগাভাগি শেষ। আলো ভাইকে ভাগ বণ্টন করার দায়িত্ব দিয়ে তার গাড়িতে মাংসগুলো তুলে রেখে বাসায় চলে এলাম। এরপর থেকে সারা দিন একটার পর একটা দাওয়াত লেগে আছে বিভিন্ন বাসায় বাসায়। সবার সঙ্গে দাওয়াতে দেখা হচ্ছে। কুশল বিনিময়, হাসি ঠাট্টা সবই করছি। কিন্তু মাথার মধ্যে সেই স্বপ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। এই চুয়াল্লিশ বছর বয়সে কেন আবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখলাম। কেন স্বপ্নের বান্ধবীরা আমাদের ঘাস আর পাতা খেতে দিল। ধু ধু মাঠের মধ্যে এ রকম এক বাড়িতে স্টুডেন্ট অ্যাকোমোডেশন। এ আবার কেমন স্বপ্ন?
ওয়াগাতে আসার পর দেখছি সব ভাইজানরাই খুব ভালো রান্নাবান্না পারেন। ভাবিদের চেয়েও ভাইজানেরা রান্নায় পটু। আর আমি সামান্য ডিমও ভাঁজতে পারি না। রান্নাবান্না আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যতই সিদ্দিকা কবির পড়ি অথবা জাদু টিভিতে দীবার রেসিপি দেখি। তাই আমার স্ত্রী কখনো রান্না ছেড়ে দিলে আমার হয়তো ঘাস পাতা খেয়েই বাঁচতে হবে। অতিকায় ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে। ক্ষুদ্র তেলাপোকা দিব্যি বেঁচে আছে। একেই তো বলে অভিযোজন। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে বেঁচে থাকা। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। ঘাস পাতা খেয়ে যদি বেঁচে থাকা যায় তবে ক্ষতি কী?
সেই স্বপ্নই কি দেখলাম?