
আইয়ুব চাচার কথা মনে পড়ে। কখন? সব সময়? না, সব সময় নয়। ঈদের সময়টায়। আইয়ুব চাচা আর ইহজগতে নেই। বহু বছর আগেই গত হয়েছেন। চারপাশ জানাশোনার বোধশক্তি হওয়ার পর থেকে জেনেছি তিনি এলাকার চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান চাচা বাবাকে নাম ধরেই ডাকতেন। কিন্তু মানুষজনের সামনে নামের পেছনে বাবু বলে আদব করতেন। যদিও বাবার চেয়ে বয়সে ছিলেন অনেক বড়। তখনকার মানুষজনের পারস্পরিক আদবকায়দা এ রকমই উন্নত ছিল (ধরে নিলাম এখনো আছে)।
একবার তার নামে প্রাচীনতম বাংলা সাপ্তাহিক যুগভেরীতে ভাটির নিভৃত কোণে শান্তির এক সেবক: আইয়ুব আলী শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। যা হোক যা বলছিলাম—কেন আইয়ুব চাচার কথা মনে হয় ঈদে? এই আইয়ুব চাচা আমাদের ছাড়া ঈদে সেমাই খেতেন না। ঈদের নামাজ শেষ করেই বসতেন তার বৈঠক ঘরে। আত্মীয়স্বজন, পরিবারের লোকজন, পাড়া-পড়শি, নিজের বন্ধুবান্ধব, ছেলেমেয়েদের বন্ধুবান্ধব সবাইকে ডাকতেন সেখানে। আমাদের বাসা থেকে চাচার বাড়ি হেঁটে যেতে আধা ঘণ্টা। দেরি যাতে না হয়, প্রায় ঈদেই তার ছেলে কিংবা ভাতিজারা মোটরসাইকেল করে নিয়ে যেতেন। আমরা প্রায় ১০-১৫ জন হিন্দু ছেলে। সবাই না পৌঁছা পর্যন্ত বৈঠক ঘরে সেমাই ও অন্যান্য খাবার আসত না। হিন্দু-মুসলমান মিলে মিশে একসঙ্গে ঈদের দিন প্রথম খাবার খেতাম চাচার বাড়িতে। এরপর দলবেঁধে এ বাড়ি ও বাড়ি ঈদের দাওয়াত রক্ষা। ঈদের জন্য অধীর আগ্রহ থাকত আমাদের। পুজো-পার্বণের মতোই ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান। ভালো কাপড়চোপড় পরা। মুসলমান বন্ধুদের আনন্দে একাত্ম হওয়া। বিকেলে ঈদ প্রীতি ফুটবল প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়া। একমাত্র নামাজ ও রোজা ছাড়া অনিবার্য অংশগ্রহণ ছিল সবকিছুতেই।
আইয়ুব চাচার আমল নেই এখন। দূর প্রবাসে এখানেও এখন সেমাই খাই ঈদে। সেমাইয়ের প্লেটটি সামনে এলেই ভেসে ওঠে আইয়ুব চাচার মুখ। মনে পড়ে দাঁড়ি, টুপি, লুঙ্গি-পাঞ্জাবিতে আপাদমস্তক ধর্মপরায়ণ অথচ অসাম্প্রদায়িক এই হাজি সাহেবের কথা। সুদূর আটলান্টিকের ওপারে বসে টেলিভিশন, সংবাদপত্রে অধুনা বাংলার নানা অশুভ কর্মকাণ্ড দেখে ভাবি আইয়ুব চাচাদের সময়কাল। মেলাতে কষ্ট হয়, শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর সেই চাচাদের আমল কী তাহলে অধিক মানবিক ছিল এখনকার তুলনায়! আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাউল শাহ আবদুল করিম হয়তো সেই উপলব্ধি থেকেই লিখেছিলেন, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা, গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউল গান আর মুরশিদী গাইতাম...।
রমজান মাসে একেক দিন দুই-তিন বাসায় ইফতার খেতে হতো। নয়া জামাইয়ের বাড়িতে শ্বশুর বাড়ি থেকে ইফতার পাঠানোর ট্র্যাডিশন আছে সিলেটে। ১৫-২০ পদের মুখরোচক খাবারের বিরাট আয়োজন। বাড়ির মুরব্বিরা ডেকে আনতেন আমাদের এতে যোগ দিতে। সেদিন বহু বছর পর মন্ট্রিয়েলে এ রকম এক জামাই ইফতারিতে যোগ দিয়ে ফেলে আসা সেসব দিনের কথা খুব মনে পড়ছিল। আমরা যেমন মুসলিম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আনন্দ পর্বে যোগ দিতাম তেমনি তারাও আমাদের পুজো-পার্বণে সেভাবে অংশ নিত। পুজোর প্রসাদ খাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠা উৎসবে যোগ দেওয়া। সবকিছুই ছিল প্রাণের টানের সম্মিলিত উৎসব। পৌষ সংক্রান্তির রাতে হিন্দু-মুসলমান বন্ধুরা মিলে ধানের খড় দিয়ে ঘর বানাতাম। ওই ঘরে রান্না করে খেতাম। ভোরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম ওই খড়ের ঘর। মুসলমান বন্ধুদের বাবা-মা বাধা দেননি ছেলেদের হিন্দু পার্বণে একাত্ম হতে। সকালে হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে বের হতাম প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে পিঠা খেতে।
ফাগুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের এলাকায় তিন দিন তিন রাত (চব্বিশ প্রহর) নামসংকীর্তন উৎসব হতো (এখনো হয়)।
এ উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে শত শত লোকের আগমনে মেলার মতো এক জমজমাট পরিবেশ বিরাজ করত সেখানে তখন। হিন্দু কিংবা মুসলমান পড়াশোনা অথবা চাকরি যে যেখানেই থাকতেন কীর্তন উপলক্ষে মিলিত হতেন সবাই। মুসলমান বন্ধুটিও বলতো কীর্তনে দেখা হবে। নামসংকীর্তনে বহু অর্থ ব্যয় হয়। বস্তা বস্তা চাল, ডাল ও নগদ অর্থ অনুদান আসত এলাকার ধনাঢ্য মুসলমান ব্যক্তিদের কাছ থেকেও। স্থানীয় ক্লাবের উদ্যোগে মিলাদ মাহফিল ও সরস্বতী পুজো হতো। পুজো ও মিলাদের চাঁদা হিন্দু মুসলমান তরুণেরা একত্রে উঠাত। কখনো দেখা গেছে মিলাদের চাঁদা ওঠাতে গেছে সমীরণ আবার পুজোর চাঁদা মাসুক।
দুর্গাপূজা ও নামসংকীর্তনে এলাকার ছেলেরা চাঁদার বই পাঠাত বিদেশে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে এলাকার লোক। আমি কানাডায় আসার পর একবার এলাকা থেকে ফোন পেলাম সজলের। বলল পুজোর জন্য পারলে কিছু টাকা পাঠিও। সজল জানাল, লন্ডনে শাহিনের কাছে একটি চাঁদার বই পাঠিয়েছিল তারা। শাহিন নিজে ও অন্যান্যদের কাছ থেকে তুলে মোটামুটি বড় অঙ্কের টাকা পাঠিয়েছে। বলাবাহুল্য যে, এলাকার লন্ডনপ্রবাসী মুসলমান যুবকদের কাছ থেকেই এই টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।
তবে সকল কালে সকল ভালোর মাঝেও যে কিছু মন্দ প্রকৃতির লোক থাকে তা একটি ঘটনা দিয়ে বলি। একবার আমাদের এক সাংস্কৃতিক সংঘের এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় মাদ্রাসার মাইকটি আনা হয়েছিল। অনুষ্ঠান শুরুর পূর্ব মুহূর্তে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মৌলভি সাহেব এসে আমাদের বললেন, বাবারা তোমরা গান বাজনায় এই মাইক ব্যবহার করবে এতে ধর্মীয় দিক থেকে আমাদের সমস্যা হবে। মাইকটি তোমরা ফেরত দিয়ে দাও। কাছাকাছি কোনো মাইকের দোকান নেই। আমরা তখন মহা সমস্যায়। চেয়ারম্যান চাচার ছেলে মালেক ভাই তখন সংঘের সভাপতি। তিনি প্রিন্সিপাল সাহেবকে বোঝালেন। খুবই নিরিবিলি আর সজ্জন প্রকৃতির এই প্রিন্সিপাল বললেন, ঠিক আছে। তিনি জানালেন কয়েকজন লোক তাকে বলেছে মাইক নাপাক হয়ে যাবে। শুধুই হিন্দু মুসলমান হিসেবে নয় মানুষ হিসেবে যে আমরা ছিলাম (বিশ্বাস করতে চাই এখনো আছি) জীবন চলার পথের আরও কিছু ঘটনায় বারবার তা প্রতিভাত হয়েছে।
একবার আমার এক আত্মীয় মুরব্বি সিলেট পৌর কমিশনার পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। এলাকার প্রভাবশালী মুসলমান নেতারাই তাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। দল বেঁধে আমরা যেতাম নির্বাচনী প্রচারণায়। এলাকার এক মুসলমান পরিবারের আত্মীয় এসেছেন বেড়াতে। তিনি যোগ দিলেন প্রচারণা টিমে। এলাকায় তাকে কেউ চেনেন না। একদিন গেলাম হিন্দু অধ্যুষিত এক পাড়ায়। টিমে ওই ব্যক্তি ছাড়া আমরা সবাই হিন্দু। এক হিন্দু বাড়িতে গিয়ে তিনি বললেন, আমরা যারা হিন্দু (তিনি কিন্তু হিন্দু নন। নির্বাচনী কৌশলে যাকে যেভাবে পটানো যায় সেই চেষ্টায়) তাদের উচিত হিন্দু লোককে ভোট দেওয়া। কথাটা শুনে বাড়ির এক বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, হিন্দু হলেই ভোট দেব কেন? যে আমাদের কাজ করতে পারবে, বিপদে আপদে সামনে আসবে তাকে আমরা ভোট দেব। বৃদ্ধার কথা শুনে সবাই অপ্রস্তুত। কথাগুলো আমাদের চেতনাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করল। পরে আর হিন্দু ভোটারদের কাছে হিন্দু বলে ভোট চাইবার আগ্রহ পায়নি আমাদের কেউই।
আরেকবার আমার জন্মস্থান মার্কুলি বাজার জামে মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ পড়ে বের হয়েছেন লোকজন। এমনি সময় বাজার লঞ্চ ঘাটের কুলি সর্দার সুরুজ মিয়া বিপরীত দিক থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে সুর করে বলতে লাগল, মোমিন মুসলমান ভাইগন আমাকে পবিত্র মালান মেরেছে। একজন মুসলমানের গায়ে হাত দিয়েছে। এই মালানের বিচার চাই। মুসল্লিরা তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না। সে চিৎকার করে জাত ধর্ম তুলে গালাগাল করছে। হঠাৎ মুসল্লিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক একজন লোক মরহুম তজু মিয়া মুনশি (আমার এক সহপাঠীর বাবা) দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে এক চড় মারলেন সুরুজ মিয়ার গালে। বললেন যুগ যুগ ধরে এখানে হিন্দু মুসলমান মিলে মিশে বসবাস করে আসছি। এখন তুই এসেছিস তা নষ্ট করতে। পরে জানা যায়, পাওনা টাকা নিয়ে শুধু বচসা হয়েছিল, মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
পবিত্র মোহন দাস ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, নিরিবিলি মানুষ। আর সুরুজ মিয়া অস্থানীয় ও সুযোগ সন্ধানী। সে চেয়েছিল ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে ফায়দা লুটতে। তখনকার মানুষ এসবকে পাত্তা দিত না বলেই একটা সুন্দর সহাবস্থান ছিল সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে। ধর্মীয় কিংবা সম্প্রদায়গত কুঘটনা এখনকার মতো এত বেশি ছিল না। মাঝে মধ্যে যে হয়নি তা নয়। না হলে ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯১, ২০০০ ও ২০১৩ সালে যুগপৎভাবে সংখ্যালঘুদের জন পরিসংখ্যান আশঙ্কাজনক হারে নেমে আসত না। শিক্ষা-দীক্ষা, প্রযুক্তি প্রগতিতে অগ্রসর হয়ে আলোর পথ যাত্রায় কোনো কুপমুন্ডকতা স্থান পাওয়ার কথা ছিল না।
রামুর সেই বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকের ট্যাগ করার ঘটনা নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসা-বাড়িতে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো—কই কোনো তজু মুনশি চাচাকে তো এটি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না। সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কারণ ছাড়াই নানা অছিলা তৈরি করে হিন্দু বাড়ি-ঘর, মন্দির আক্রমণ, লুটপাট হলো। সবার সামনেই ঘটল ঘটনাগুলো।
কেউ এগিয়ে এলো না বলতে, সাবধান যুগ যুগের অহংকার মিলেমিশে থাকার ইতিহাসকে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে দেব না কাউকে। কেন বাপ দাদাদের আমলের সেই প্রীতিময় অসাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্ব দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে! ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার—এ স্লোগান উচ্চারণ করার দরকার পড়েনি তখন। এটি ছিল সকলের বোধে, চেতনায়, বিশ্বাসে ও কর্মে। হীন রাজনৈতিক কিংবা অতি ধর্মীয় বিষবাষ্পে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের প্রিয় বাংলাদেশ কি তাহলে ক্ষতবিক্ষত, বিবর্ণ হয়ে যাবে? হ্যাঁ, এ রকম এক প্রকট আশঙ্কার মাঝেও স্বপ্ন দেখি আমাদের আইয়ুব চাচা, তজু মুনশি চাচাদের উত্তরসূরি বিশাল একদল মানবিক মানুষ আবার জেগে উঠবে। নানা বরণ গাভিরে ভাই, একই বরণ দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত-কবির এই অতি সত্যি প্রতীতি প্রতিভূ হবে মানব অন্তরে। তরুণ প্রজন্ম গাইবে নব জাগরণের গান, সাম্যের আর ঐক্যের গান। সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু ভেদাভেদহীন এক সম বিকশিত সমাজ গঠনে নিমগ্ন হবে কিশোর-যুব-বৃদ্ধ—শ্যামল বাংলার সকল বাঙালি। হাতে হাত ধরে সমকন্ঠে গাইবে—শুন হে মানুষ ভাই, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।