‘সাম্পা প্রজন্মে’র কারণে জন্মহার হ্রাসে রেকর্ড দক্ষিণ কোরিয়ার

ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির গতিধারা পরিবর্তনের জন্য অন্যতম করণ হচ্ছে কোরীয়দের কঠোর পরিশ্রম, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা, কাজের প্রতি একাগ্রতা। এসব কারণ দেশটি গত ৫০ বছরে উন্নয়নশীল দেশ থেকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিক্ষা-সংস্কৃতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার অগ্রসরতা কেবল এশিয়ায় নয়, বরং সারা বিশ্বেই দেশটিকে এক অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। পুরুষের অবদানের পাশাপাশি নারীদের একাগ্রতার কমতি ছিল না। কিন্তু দেশটিতে ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলেও নারীর প্রতি সামাজিক মনোভাব বদলায়নি।

কোরিয়াতে এই অর্থনৈতিক সফলতা কম মজুরিপ্রাপ্ত কারখানাশ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। এসব কারখানার বেশির ভাগ কর্মীই নারী। এর বাইরে দেশটিতে পরিবারের কাজের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হয়েছেন বর্তমান নারীরা। একই পরিবারের পাঁচজন সদস্য থাকলে সবাই সবার মতো করে কাজে বেরিয়ে পড়েন। কোরীয় কোনো নারী বাসায় বসে সময় কাটাচ্ছেন—এমনটা খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। কর্মকেই তাঁদের জীবনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেন। শুধু তা–ই নয়, নারীরা প্রতিটি কাজেই পুরুষের চেয়ে খুবই আন্তরিক।

ছবি: সংগৃহীত

এ দেশে কোনো মেয়ে চাকরিজীবী হলেও সন্তান জন্মদানের পর তা লালন-পালনের ভার নারীর ওপরেই বর্তায়। তা ছাড়া মাঝে কিছু আপত্তিকর পরিস্থিতির মধ্যেও পড়তে হয় নারীদের। যেমন সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেক ছেলে তাঁদের মেয়েসঙ্গীর অন্তরঙ্গ ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় এখন এটি বড় একটি ইস্যু। তা ছাড়া ছেলেবন্ধু কিংবা স্বামীদের দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতনের আশঙ্কাও রয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায় কেন জন্মহার কম। বিবাহের হার শুধু নয়, এখন শিশু জন্মহার হ্রাসের রেকর্ড গড়ল দক্ষিণ কোরিয়া। বিয়ে কিংবা সন্তান নিতে অনাগ্রহের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়।

দ্য কোরিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ৩ জানুয়ারি আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, প্রাকৃতিক হ্রাসের জন্য রেকর্ড কমসংখ্যক জন্মহার মৃত্যুহারের চেয়েও কমে গিয়েছে।

স্বরাষ্ট্র ও সুরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত সর্বশেষ আদমশুমারির পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ২৩ জন, যা ২০১৯ সালের থেকে ২০ হাজার ৮৩৮ জন হ্রাস পেয়েছে। আগের ১০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, যদিও প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। ২০১০ সালের ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ২ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৫টি শিশু জন্মগ্রহণ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। তবে ২০২০ সালে ৩ লাখ ৭ হাজার ৭৬৪ জন মারা গিয়েছিল, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে, ২০১৪ সালে সরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে সাড়ে ২২ শতাংশ বিয়ে, সন্তানের জন্ম ও সন্তানের দেখভালের জন্য চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
তবে সঙ্গী তৈরি ও সন্তান ধারণে নারীর এই অনীহা বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে যাচ্ছে দেশটিতে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা দিনের বেশির ভাগ সময় অফিসেই কাটান। কিন্তু সরকার চাইছে দেশে জন্মহার বাড়ুক। তাই দেশটি অফিস সময় কমানোর একটি বিল পার্লামেন্টে পাস করেছে এবং তা কার্যকর করেছে। বিলে বলা হয়েছে, ৬৮ ঘণ্টার জায়গায় এখন সপ্তাহে ৫২ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। ফলে, দিনে গড়ে দুই ঘণ্টা অফিসে সময় দিতে হবে। দেশটির নেতারা বলছেন, কর্মঘণ্টা কমানোর ফলে পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটাবেন নারী ও পুরুষেরা। স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া, অবসাদ কাটানো ও জন্মহার বাড়ানোর জন্য নতুন এ নিয়ম জারি করেছিল দেশটি। কিন্তু তাতেও কোনো ভালো সুফল পাওয়া যায়নি। দেশটির পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী চুয়াং হুন দক্ষিণ কোরিয়ার কম জন্মহারের জন্য নারীদের অতিরিক্ত কাজ করাকে দায়ী করেছিলেন।

এসব কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ সমস্যার কতটুকু সমাধান করতে পারবে, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নারীরা সন্তান নিতে চাইলে যাতে কোনোভাবে বৈষম্যের শিকার না হন, এমন আইন আছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। এর ফলে দেশটিতে তৈরি হয়েছে ‘সাম্পা প্রজন্ম’। এখানে সাম্পা মানে সম্পর্ক, বিয়ে ও সন্তান—এ তিন থেকে নিজেকে গুটিয়ে পরিষ্কার রাখা।

সন্তান জন্ম দিতে দেশটির নারীদের যে অনীহা রয়েছে, সেটা জন্মহারেই স্পষ্ট। বিশ্বে জন্মহার সবচেয়ে কম দক্ষিণ কোরিয়ায়।