টমি হিলফিগার এক ব্যক্তিত্ব, এক আভিজাত্য, এক আত্মবিশ্বাসের নাম। ফ্যাশন জগতে সবার কাছেই পরিচিত, বিশেষ করে অভিজাত বা করপোরেট সমাজে এই ব্র্যান্ডের একটা শার্ট বা টাই নিঃসন্দেহে ব্যক্তিত্বে বাড়তি কিছু যোগ করে তোলে। দেশে এই ব্র্যান্ড ছেলেদের জন্য বিস্তৃত হলেও বিশ্বের অনেক দেশে নারীদের কাছেও কাঙ্ক্ষিত ব্র্যান্ড। আমি ফ্যাশন বা তার সামগ্রী নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। সেটা হয়তো আমার চেয়ে পাঠকেরা বেশি জানেন। আমার আগ্রহ সব সময় কাজ করে এসব সফল পরিশ্রমী মানুষের বেড়ে ওঠার পেছনে কী মন্ত্র সেটা জানার কৌতূহল! এঁদের সাফল্যের কথা জেনে বরাবর চমৎকৃত হই এবং সেই তথ্য সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করি। বলা তো যায় না, এসব মানুষের পরিশ্রম আর সাফল্যের গল্প থেকে হয়তো কেউ না কেউ তার জীবনের মোড় ঘোরাতে পারেন। কারণ অর্থ-কড়ির অসাফল্য মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাশা কাজ করে।
টমি হিলফিগার ১৯৫১ সালের ২৪ মার্চ নিউইয়র্কের এলমিরায় এক আইরিশ আমেরিকান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনে মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। মা ভার্জিনিয়া একজন নার্স ও বাবা রিচার্ড স্থানীয় এক জুয়েলারি দোকানে ঘড়ি বানাতেন। টমি এক সময় এলমিরা ফ্রি স্কুল অব একাডেমি হাই স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে তিনি না একজন ভালো তারকা খেলোয়াড়, না খুব ভালো ছাত্র। বয়সের চেয়ে দেখতে কিছুটা ছোটখাটো একজন মানুষ, বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকতেন। তিনি অনেক দিন অনির্ণেয় ডাইলেক্সিয়া রোগে ভুগেছেন।
তারপরও অল্প বয়সে দেখা যায়, মানুষের জন্য তাঁর উদ্যোক্তা উপহার। কিশোর বয়সেই তিনি নিউইয়র্ক শহর থেকে জিন্স কিনে এগুলোকে আবার নিজের মতো ডিজাইনে তৈরি করে এলমিরাতে বিক্রি শুরু করেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি তাঁর প্রথম স্টোর চালু করেন। জিন্স বেলবটম হিপি ডিজাইন যা আমেরিকানদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। প্রথম স্টোরের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও স্টোরে ব্যবসা বিস্তার করতে শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ১৯৭৭ সালে রীতিমতো দেউলিয়া হয়ে পড়েন।
১৯৭৬ সালে হিলফিগার প্রেমে পড়েন তাঁর একটি স্টোরের কর্মী সুসী ক্যারোনার। পরে তাঁরা দ্রুত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ব্যাংক ঋণ খেলাপি হওয়ায় এলমিরা থেকে ম্যানহাটনে এসে বসবাস শুরু করেন।
অ্যাপারেলস ব্র্যান্ড জোর্ডেচ (Jordache) দুজনকে স্বামী-স্ত্রী জেনেই তাদের ডিজাইনার টিমে চাকরি দেয়। কিন্তু এক বছরের মাথায়ই তাদের দুজনকে স্বল্প সময়ের নোটিশে বরখাস্ত করে। তত দিনে অল্প বয়সী একজন পরিশ্রমী ভালো ডিজাইনার হিসেবে টমি নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে ফেলেছেন। তাই পেরি এলিস (Perry Ellis) ও ক্যালভিন ক্লাইন দুটিই তাঁকে তাদের ডিজাইনার হিসেবে নিয়োগ দেন। মূলত কোনো বিখ্যাত কোম্পানির ডিজাইনার হওয়াই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
হিলফিগারের প্রকৃত ব্যবসায়িক সাফল্য শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। এ সময় ভারতীয় উদ্যোক্তা মোহন মুরজানি তাঁকে ডাকেন। কারণ মোহন পুরুষ ক্রীড়াবিদদের খেলার পোশাকের কথা ভেবে একজন ডিজাইনার খুঁজছিলেন।
হিলফিগার চান ডিজাইন করবেন তাঁর নিজের নামে এবং কাপড়ে তা সিল করে দেবেন। মোহন তাদের ব্যবসায়িক চুক্তিতে রাজি হলেন। ক্রীড়া জগতের পোশাকে হিলফিগারের এই আবির্ভাবের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। ব্লিট মার্কেটিং প্রচারাভিযানের শিরোনাম হন তিনি। নিউইয়র্ক নগরের টাইমস স্কয়ারে একটি উজ্জ্বল বিলবোর্ডে তাঁর নাম ওঠে। আমেরিকান ফ্যাশনে বড় একটি বিষয় হিসেবে হিলফিগারের নাম ঘোষিত হয়। ১৯৮৬ সালে হিলফিগার এক সাংবাদিককে নিজেই বলেন, ‘I think I am the next great American designer, The next Ralph Lauren or Calvin Klein।’
হিলফিগারের এমন নগ্ন আত্মপ্রচারে ক্যালভিন ক্লাইনের মতো কোম্পানিগুলো বিস্মিত হলো এবং সেই সঙ্গে শুরু হলো ব্যবসায়িক যত প্রতিযোগিতা। তবে তিনি তার লাল-নীল-সাদা লোগো দিয়ে তৈরি পোশাকে প্রবল সাফল্য অর্জন শুরু করেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তাঁর ডিজাইন পৃথিবীজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়। আমেরিকান এই ফ্যাশন ডিজাইনার কাপড়ের জগতে এক ব্র্যান্ড নাম তৈরি করেন। নব্বইয়ের দশকে সব কমিউনিটির মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে, বিশেষ করে পপ তারকা ও সেলিব্রেটিদের কাছে সমাদৃত হয়ে উঠে। ১৯৯৪ সালের মার্চে এক শনিবার রাতে লাইভ পারফরম্যান্সের সময় হিলফিগার টি-শার্টের ব্যবহার তাঁকে বিশ্বের বাজারে সর্বকালের উচ্চ বিক্রির পরিসংখ্যানে পৌঁছে দেয়।
হিলফিগারের বাণিজ্যিক সাফল্য সত্ত্বেও ফ্যাশন অভিজাতরা তাকে নানাভাবে ছোট করার চেষ্টা করে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের ডিজাইনার ডিজাইনস-এর মর্যাদাপূর্ণ কাউন্সিলের ফ্যাশন ডিজাইনার অ্যাসোসিয়েশনের পুরস্কার পাওয়ার পরও সিএফডিএ পুরস্কার না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরে যাচাই-বাছাই ও উদ্বেগের মধ্যে ১৯৯৫ সালে শেষ পর্যন্ত তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
২০০০ সাল ছিল হিলফিগারের জীবনে একটা কঠিন সময়। ২০ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাঁদের চার সন্তানের পরিবারে ভাঙন ধরে। স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। অন্য দিকে তার ব্যবসায়িক সাফল্য ৭৫ ভাগ নিচে নেমে যায়। টমি হিলফিগার ব্র্যান্ড মানুষের কাছে আর তেমন জনপ্রিয় থাকে না। তখন তিনি নতুন করে আবার ভাবতে লাগলেন। শহুরে বাচ্চারা তার লাল নীল সাদা লোগোর কাপড় আর পছন্দ করছে না। তাই তিনি এগুলোকে নতুন ডিজাইন দিলেন। মেসির সঙ্গে একটা ব্যবসায়িক চুক্তি হলো যে, এগুলো শুধু তাদের স্টোরেই বিক্রি হবে। এরপরেই এটি ছিল মেসির একটা বেস্ট সেলিং প্রজেক্ট।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি ডি অক্লিপোকে বিয়ে করেন। ২০০৯ সালের আগস্টে তাঁদের ঘরে ছেলে সেবাস্টিনের জন্ম হয়। ২০১০ সালের মে মাসে তাঁর লাভজনক পোশাক কোম্পানি ফিলিপ্স-ভ্যান হিউসেনের কাছে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি কাপড় বিক্রি করে। তিনি ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিওফ্রে বিনে লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডের ফ্যাশন ডিজাইনার কাউন্সিল লাভ করেন। এভাবেই সৃজনশীল চিন্তা ও কাজের মাধ্যমে হিলফিগার তার দুঃসময় আবার কাটিয়ে ওঠেন।
বর্তমানে হিলফিগার তাঁর ব্র্যান্ডের মাধ্যমে বিশ্বের প্রধান ডিজাইনার হতে চলেছেন এবং তাঁর ৯০টির বেশি দেশে ১ হাজার ৪০০টি স্টোর আছে। ২০১৬ সালে তিনি ক্লাসিক আমেরিকান কুল নামে একটি নতুন প্রজেক্ট হাতে নেন, যার উদ্দেশ্য প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য অভিযোজিত পোশাকের একটি লাইন তৈরি করা। এ জন্য তিনি রানওয়ে অফ ড্রিমসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজে অংশ নেন।
এখন বিশ্বের কাছে টমি হিলফিগার এক পরিচিত নাম। বেশির ভাগ জনপ্রিয় মানুষ কোনো না কোনোভাবে সংগ্রাম করেই উঠে আসেন। এরা মানুষের কাছে সত্যি বলতে এক প্রেরণার উৎস। একজন মানুষের ইচ্ছা শক্তির চেয়ে বড় আর কোনো শক্তি যে হতে পারে না, তিনিই তাঁর প্রমাণ।