সহে না যাতনা

কি যাতনা তব সহ এ মরমে
নাহি পারো প্রকাশে লোকো ভয়ে।
আমাদের জীবনের চলার পথের কত ঘটনা আমরা স্মৃতির পাতায় পাতায় জমিয়ে রাখি। প্রকাশের অভাবে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। অনেকে প্রকাশ করে নিজেকে হালকা করেন এবং মনঃপীড়া থেকে মুক্তি লাভ করেন। আমার লেখা সেই হতভাগাকে নিয়ে, যার প্রকাশ করার ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই নেই। এ জাতীয় ভীরু ও কাপুরুষেরা যেমন নিজের আত্মাকে কষ্ট দেন, সত্যকেও অন্ধকারে নিমজ্জিত করেন সৎ সাহসের অভাবে। এমনি এক বন্ধুর সংস্পর্শে আমাকে আসতে হয়েছে। তার না বলা সত্য কাহিনি তার হয়ে এবং তার অনুরোধে হুবহু পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। দরদ কা রিস্তার এই সম্পর্কের সূচনা বাহরাইনে।
আমি বাহরাইন হিলটনের লা গ্রিল রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। সবাই অরি বলে জানে। রেস্টুরেন্টে কাজ করার মজাই আলাদা আর তা যদি ফাইন ডাইনিং হয়। কাজ আর ছুটিতে ইউরোপ ঘোরাঘুরি আর ওয়াইন ও ককটেল টেস্ট করা এবং টু ডিসকাস উইথ দ্য এক্সপার্ট ওয়াজ দ্য অনলি ইন্টারেস্ট ইন মাই লাইফ।
প্রেম বিয়ে এসব ভাবনার অবকাশ আমার ছিল না। ভাবনার উন্মুক্ত আকাশে ডানা মেলে আমি তখন স্বপ্ন দেখি মাইগ্রেশনের। ফ্রান্সের bordeaux region অথবা অস্ট্রেলিয়ার সিডনির chardonnay region-এ। আমার পেপার সব প্রসেসিং হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়। বছর দেড়েক লাগতে পারে।
এর মধ্যে আওমী আমাদের রেস্টুরেন্টে যোগ দিল নতুন রিক্রুটমেন্টে। শ্রীলঙ্কান। সেই আমি—যার সম্পর্ক অন্য স্টাফদের সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া অন্য কিছু না, আমার অনেক কিছু আওমী সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করল। প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগে গেল তাকে। বেশ সুন্দরী সে। প্রায় ৬ ফুট লম্বা। পাতলা গড়ন। ঘন কালো চুল নিতম্ব ছাড়িয়ে হাঁটু পর্যন্ত। কালো বর্ণের এবং মুখটা দেখতে ঠিক ক্লিওপেট্রার মতো। আমি অনেক ব্ল্যাক বিউটি দেখেছি। কিন্তু এত অপরূপ সৃষ্টি দেখিনি। কাজের পর ওর ফাইলটা আমি বাসায় নিয়ে গেলাম। বাসায় সোফায় বসে আরাম করার ছলে একটা সিগারেট ধরালাম। আমি অভ্যস্ত নই, তার পরও কখনো কখনো সুখ টান দিই মুডটা চাঙা করার ছলে। ২৪ বছরের আওমী বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। চার বছরের বিবাহিত জীবনে কোনো বাচ্চা নেই।

আওমী এ লাইনে কাজ করছে কয়েক বছর ধরে। কাজেই পারফরমেন্সের জন্য আমার বা অন্য কারও সাহায্যের দরকার নেই তার। ডাইনিং হল রোববার বন্ধ থাকে। আওমীকে এক রোববারে আমার সঙ্গে ডিনারের আমন্ত্রণ করলাম। সে গ্রহণ করল। আমরা সি ফুড খেলাম—lobster bisque soup, grilled shrimp with vegetable, teramishu and espresso.
আমরা দুজনই হোটেল কমপাউন্ডের ভেতরে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় থাকি। সেদিন ডিনারের পর হাঁটতে হাঁটতে আমরা আরব সাগরের ধারে বেঞ্চে বসে অনেক কথা বললাম। আমি আমার ব্যাচেলর জীবনের ভালো লাগা না লাগার কথা বললাম। আর আওমী ওর বিবাহিত জীবনের টুকিটাকি কথা শোনাল। সাগরের দমকা বাতাস ওর চুল কখনো কখনো আমর মুখে খেলা করছিল। ও রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল! দূরের আকাশ আর মিটিমিটি তারা আমার মনের খবর পেয়ে সম্ভবত হাসছিল। আমরা বাসায় চলে এলাম। আমার ঘুম এল না। অনেক দিন পড়ে থাকা কলের গানটা বের করে আনলাম। ধুলা ঝেড়ে একটা রেকর্ড বসালাম। careless whisper আমার চিত্তে নব দোলা লাগল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
ধীরে ধীরে আওমী আমার আরও কাছে আসতে লাগল। আমরা একে অপরের মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলাম। আমার প্রেমের বন্যায় আওমী ভেসে যেতে লাগল! আমাদের মনে রং লাগল। আমরা একে অপরকে রংধনুর সাত রঙে ভরিয়ে দিতে লাগলাম! ওর আসার পর মুখে মেঘের ঘনঘটার যে ছাপ ছিল উবে গেল। এই যখন জীবন, আওমী আমায় শুধাল, ও মা হতে চায়। আওমীর আজন্মের মাতৃত্বের স্বাদ তার স্বামী নেভাতে পারেনি।
আওমী ঘটনাটা খুলে বলল। ছোটবেলায় আম গাছ থেকে পড়ে গেলে ওর স্বামীর সার্জারি হয়। এই ঘটনা বিয়ের সময় তাকে জানানো হয়নি। বিয়েটা ওর সঙ্গে ধোঁকা হয়েছে। ওর শ্বশুর বাড়ির লোক প্রতারণা করেছে।
ঘটনাটা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমার মাথায় যেন কিছু ভেঙে পড়ল। আমি সব অন্ধকার দেখলাম। একদিকে ওর অসহায়ত্ব অন্যদিকে আমার ধর্মভীরুতা।
পরে আমি আওমীকে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম—তুমি তোমার স্বামীকে ডিভোর্স দাও আমি তোমাকে বিয়ে করব এবং তোমার শখ পূরণ করব।
আওমী তাতে রাজি হলো না। জানাল ওদের জীবনে স্বামী বেঁচে থাকতে বিয়ে একবারই হয়। ও আর আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না, help us God!
আমি রাজি হলাম না, আমি আমার এ জগৎ ও পরের জগৎ দুটোই হারাতে পারব না। মনে মনে চিন্তা করলাম, আমার জীবনের এ কোন কঠিন পরীক্ষা?

এরপর আওমী দুদিন কাজে আসল না। কল দিয়ে জানাল সিক। তৃতীয় দিনে হিউম্যান রিসোর্স আমাকে জানাল, আওমী দেশ থেকে ইমার্জেন্সি কল পেয়ে সকালের ফ্লাইটে কলম্বো চলে গেছে। এটা শুনে আমি মনে মনে বললাম, Oh aumi! why did you do that i did not finish yet? এক সপ্তাহ পর আওমী রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিল। আমি ওকে চিঠি দিলাম। আমার চিঠির জবাব এল না। ফোন করেও পেলাম না।
আমি আবার সেই একা হয়ে গেলাম আগের মতো। কিছুই ভালো লাগে না। আমি ছটফট করতে লাগলাম। কিছুদিনের মধ্যেই আমার অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রান্ট ভিসার কাগজ এসে গেল। কয়েক দিন পর আমি সিডনি চলে গেলাম।
জীবন চলে যায়। চলার নাম গাড়ি। আমিও এর সওয়ারি। যখন একা থাকি ভাবি, ভালোবাসার মানুষ হিসেবে এই সাক্রিফাইস আমার কি করা উচিত ছিল? কিন্তু ধর্মতো সেটা পারমিট করে না। আমার এ ছাড়া কীই বা করার ছিল। আওমী তুমি যেখানেই থাক, ভালো থেকো। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিয়ো...!