সহানুভূতি চাই আপনার কাছে, সরকারের কাছে না

সহানুভূতির আভিধানিক অর্থ দয়া, ভিক্ষা, কৃপা, করুণা, অনুকম্পা ইত্যাদি। এই শব্দগুলো ভালো, শুনতে অনেক মিষ্টি লাগে, কিন্তু পক্ষপাতদুষ্ট; আর পক্ষপাতদুষ্ট স্বভাবতই এক পক্ষের ক্ষতি করে অন্য পক্ষের লাভ করা হয়। পক্ষপাতদুষ্ট কোনো কিছুরই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় না, একান্ত বিশেষ প্রয়োজন না হলে। সেটা পাশ্চাত্য হোক আর আমাদের মতো দেশে হোক। কিন্তু এই শব্দগুলোর খুবই প্রয়োজন ব্যক্তিগত জীবনে। এগুলো ত্যাগেরই নামান্তর। ত্যাগ না থাকলে সংসার যেমন সুখের হয় না, তেমনি পরিবার, সমাজ ভালো থাকে না। ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। তবে সহানুভূতির প্রয়োগটা হওয়া দরকার ছোট পরিসরে, বড় পরিসরে না। ত্যাগ সবাই স্বীকার করতে চায় না।

প্রতিষ্ঠান, যেমন রাষ্ট্র একটি বড় প্রতিষ্ঠান। এখানে অনেক মানুষের চাওয়া–পাওয়া থাকে। যেহেতু ত্যাগী মানুষের সংখ্যা খুব বেশি হয় না, তাই সবার চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে গুড গভর্নেন্সের সঙ্গে ল অ্যান্ড অর্ডার থাকে। ল অ্যান্ড অর্ডার হলো মোটাদাগে কিছু নিয়মকানুন, যা মানতে হয়, অন্যথায় শাস্তি পেতে হয়। এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, সবার শ্রদ্ধা থাকে। এসব পক্ষপাতমূলক হয় না, তাই এখানে সহানুভূতি থাকে না। যদিও সহানুভূতি একটা মানবিক ও আবেগীয় শব্দ, কিন্তু এটার প্রয়োগ এখানে তেমন দেখা যায় না। এটা দিয়ে অল্প মানুষকে সন্তুষ্ট করা যায়, অনেক মানুষকে নয়। যেটা স্বামী-স্ত্রী, বা সংসার এ দেখা যায়। এখানে অনেক কিছু থাকে, যা ল অ্যান্ড অর্ডার কভার করে না, করতে পারে না। সহানুভূতি স্বল্প পরিসরে রাষ্ট্রে থাকে, তবে তা ল অ্যান্ড অর্ডারের বিকল্প হতে পারে না।

সম্প্রতি কানাডার অন্টারিওতে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে পূর্বপরিকল্পিতভাবে গাড়িচাপা দিয়ে এক মুসলিম পরিবারের চারজনকে হত্যা করা হয়। এখানে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারকে তো বিচার চাইতে হয়নি। কাউকে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ ও করতে হয়নি। ল অ্যান্ড অর্ডার যেমন আছে, সেভাবেই চলছে। দোষী ব্যক্তি সেদিনই গ্রেপ্তার হয়েছে। বাড়তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো থেকে সব স্তরের মানুষ সমভাবে ব্যথিত হয়েছে। তার একটি নমুনা হলো: কয়েক দিন আগে আমার বন্ধু, মোহাম্মদ বকস বাসার দরজায় একটি চিরকুট দেখতে পান। তাতে লেখা,
‘প্রিয় বকস পরিবার,

সম্প্রতি লন্ডন অন্টারিওতে ইসলাম পরিবারের হত্যার ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন। এটা আমার কানাডা নয়। আমি আশা করি যে তোমার পরিবার স্পষ্টত কোনো বর্ণবাদের মুখোমুখি হয়নি। অনুগ্রহ করে আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে সহযোগিতা ও বন্ধ্যত্বের নমুনাস্বরূপ আমার এই ছোট্ট উপহারটি গ্রহণ করুন।’

আমরা কি আমাদের কাছে কখনো প্রশ্ন করি, আমাদের চারপাশে এমন অনেক মর্মান্তিক ঘটনা তো কতই–না ঘটে, তাতে আমরা কতটুকু ব্যথিত হই। আমাদের অনুভূতিগুলো যেন মরে যাচ্ছে, আর যা আছে তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ না এমন কোনো বুস্টার ডোজ আমাদের নিজেদের কাঁধে আসে, ততক্ষণ আমাদের বোধোদয় হয় না।

অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া আমাদের দেহ কাজ করে না, নিজেদের ইমিউনিটি মরে গেছে। আমরা যারা খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন করি; তারা তো আমাদের মধ্য থেকেই কেউ না কেউ করে থাকে। অনুভূতিশূন্য হয়ে গেলে এসবের মাত্রা বাড়বে বই কমবে না।

কি সাংবাদিক, কি সেলিব্রিটি, কি রাজনৈতিক, কি সাধারণ মানুষ—সবাইকে বিচার চাইতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হতে দেখা যায়। সবাই একটু সহানুভূতি বা দয়া কামনা করে। ল অ্যান্ড অর্ডার ভেঙে পড়লে, আইন-আদালতের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললে মানুষ একটু দয়া বা সহানুভূতি পেতে চায়। নিখোঁজ ইসলামিক বক্তা আবু ত্ব-হা আদনানের স্ত্রী সাবেকুন্নাহারের আকুতিও তার ব্যতিক্রম নয়, ‘আমি এভাবে জীবন চালাতে পারছি না। আমি প্রচণ্ড রকম দুর্বল হয়ে গেছি। আমি হাতজোড় করে বলব, এই নিউজটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে দিন। উনি যেন অতিসত্বর ওনাকে (ত্ব-হা) আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন।’ অথচ কেউ গুম বা অন্যায়ের বিচার চাইলে এটা নাগরিক অধিকার, করুণা নয়।

সহানুভূতি তখনই আসে, যখন ল অ্যান্ড অর্ডারের বাইরে কিছু করতে হয়। যেমন ফাঁসির আসামির সাজা মওকুফ করার ক্ষেত্রে ‘জীবন ভিক্ষার’ আবেদন হয়ে থাকে। কিন্তু ঘটনা যদি এমন হয়, ধর্ষণচেষ্টার মতো ছোট অপরাধ থেকে গুম, হত্যার মতো অপরাধের জন্য জিডি করতেও যদি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দয়ার প্রয়োজন হয়, তখন আমার কী মনে হবে। এই রাষ্ট্রের ল অ্যান্ড অর্ডার কি ভেঙে পড়েছে? আমাদের নাগরিক অধিকার কি হারিয়ে ফেলেছি? আমরা কি একটি দয়ার রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছি?


লেখক: নূর আলম, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা।