সময় বদল

জন্ম গ্রাম্য এক চিকিৎসকের পর্ণকুটিরে। গ্রামের বাজার লাগোয়া বড় ব্যবসায়ীর গুদাম ঘরের পাশের এক কোঠার ঘরে চার সন্তানের জন্ম আর বেড়ে ওঠা। বাবার কথায় ছিল দেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের টান। গায়ের রং গাঢ়, তার ওপর কথায় অন্য জেলার টান। দুটো নামে ডাকত সবাই। কালা ডাক্তার, কেউ আবাদি ডাক্তার।

ঘরের বারান্দায় নড়বড়ে টেবিলে অতি পুরোনো ওষুধ বহনের কালো মুখ খোলা চামড়ার ব্যাগ। পেছনে এক হাতলের উঁচু চেয়ার। রোগী বলতে গ্রামের গরিব লোকজন। বেশির ভাগ পেটের পীড়ায় আক্রান্ত। আর আসে শরীরজুড়ে খোস–পাঁচড়া আর দাঁদের নানা সংক্রমণ নিয়ে নানা বয়সী কামলা কামিনের দল। সোম ও বৃহস্পতিবার হাট বার ছাড়া বাকি পাঁচ দিন, শীতে হাঁটা পথে আর বর্ষায় নৌকায় পাশের গ্রামে যায় ডাক্তার রোগী দেখতে। বেশির ভাগ নারী আর শিশুরোগী।

নিজের পরিবারে চার ছেলের বড় দুটি নদী পেরিয়ে যায় পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। পুরোনো ঘরের বারান্দায় বাঁশের খুঁটিতে আটকানো সাদা–সবুজ ছোট্ট সাইনবোর্ড। লেখা ডা. আবদুল হামিদ, পল্লি চিকিৎসক, সর্ব রোগের চিকিৎসা হয়। পরের দুলাইনে ঠিকানা। হাটের দিনে আয়–রোজগার হলেও বাকি দিনে কষ্টের সীমা নেই। বেশির ভাগ ডাক আসে গরিব গৃহস্থ বাড়িতে। টেনেটুনে ওষুধের দাম নিলেও ফি নেওয়া যায় না। কেউ দয়া করে দু/চারটি হাঁসের ডিম দেয়, না পারলে বাগানের শাক–সবজি। যা দেয়, তাই হাতে ঝুলায়ে বাড়ি নিয়ে আসে কালা ডাক্তার। গ্রামের ধনী গৃহস্থ বাড়ি, নয়তো লন্ডনী বাড়ি গেলে হিসাব আলাদা। রোগী দেখার পর দুই সালুন দিয়ে খানাপিনা। পরে ফি নগদ ১০ টাকা। ওষুধের দাম আলাদা। সেসব বাড়িতে ডাক আসে কম। কিছু হলে তাঁরা নৌকা নিয়ে চলে যান সদরে বড় ডাক্তারের চেম্বারে।

কালা ডাক্তারের ইয়ার বন্ধু বলতে বাজার মসজিদের মোয়াজ্জিন সাব। দিনে বার দু-এক এসে হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করে যান, কালা ডাক্তার বাড়িত নি? শরীলডা ভালা? চেয়ারম্যান সাবের চাউলের আড়তের পেছনের ঝুপড়ি ঘরে একাই থাকেন মোয়াজ্জিন সাব। কুমিল্লা অঞ্চলের লোক। ফি বছর চৈত্র মাসে আসতেন পাশের গ্রামে। পরে একসময় আর ফিরে যাননি নিজ গ্রামে। বড় ইমাম সাবের ছোট মেয়েকে বিয়ে করে থেকে গেলেন ইমাম বাড়ি। বছর তিন আগে বউ মারা গেলে একাই পড়ে আছেন শ্বশুর বাড়ি।

ডাক্তারের বড় পোলাটি পড়াশোনায় নাকি ভালো। মাস্টার সাবে দেখা হলেই বলেন, ডাক্তার, ছেলেরে থামাইও না। যেমনে পারো লেখাপড়া শিখাও, মগজ ভালো। বিদ্বান হইব কইলাম। লগে আরেকখান কথা কই, তোমার দুই নম্বর পোলা কিন্তু জুইত না। হগলতের লগে খালি মারামারি করে। একটু টাইট দিয়ো। পরদিন সকালে মেজো ছেলেকে ভালো করে শাসন করতে গিয়ে বেত ভাঙল দুটো। তারপর থেকে বড়টা স্কুলে যায় আর মেজো ছেলেকে ঢুকিয়ে দিল বাজারের অন্য পাশের রাইস মিলে। ডাক্তারের দিন–রাত কাটে অভাব–অনটনে। বয়স বাড়ে। নিজের শরীর আর চলে না। বড় ছেলেকে শহরে দিয়ে আসে গ্রামের এক লন্ডনী বাসায় পাহারাদারের চাকরি দিয়ে। নিজের কান্না লুকিয়ে বলে, পারলে নিজে কিছু জোগাড় করে পড়ালেখা করিস বাবা। শহর থেকে আনা প্যারাসিটামল আর ফ্লাজিল ট্যাবলেট দিয়ে গ্রামের গরিব দুঃখীদের চিকিৎসা করে আর কেউ ফি দিতে না পারলে বলে, আমার বড় পোলাডার লাগি দোয়া করবাইন।

এক রাতে কালা ডাক্তার শুনে মেজ ছেলে মায়ের সঙ্গে কথা বলে, মা আমি সৌদি যামু। মা জিজ্ঞেস করেন, সৌদি যাবি, টাকা পাবি কই? ছেলে মাকে বুঝিয়ে বলে, রাইস মিলের মালিকের ভাই কইছে, যাইতে টাকা লাগত না। সৌদি গিয়ে দিলে অইবো রুজি কইরা, খালি পাসপোর্ট বানাতে অইবো। ৪০০ টাকা লাগব পাসপোর্ট বানাইতে। বাবারে বলো টাকা দিতে! কালা ডাক্তার সারা রাত ঘুমায় না। কই পাইবো ৪০০ টাকা। তার কাছে তো চল্লিশ টাকাও নাই। ফজরের নামাজে দেখা মুয়াজ্জিন সাবের সঙ্গে। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলে, বলে আল্লাহ মেহেরবান।

মানুষের উপকার করলে আল্লাই তার বিপদ কাটিয়ে দেন। পুতের জন্য দোয়া করো বেশি কইরা। কিছু না বুঝে মাথা নাড়ে কালা ডাক্তার। গুনে গুনে ১৭ দিন পর মেজো ছেলে সকালের গয়না নৌকায় চড়ে পাগলা বাজার। পরে সিলেট থেকে বাসে ঢাকা। এক সপ্তাহ পর রাইস মিলের হেড মিস্ত্রি খবর দিল, ডাক্তার, তোমার মাইজম পোলা সৌদি আরবের মদিনা শহরে পৌঁছে গেছে। কাজও পাইছে ভালো, মসজিদ নববীতে মুর্দা গোসলের কাজ।

মানুষের উপকার করলে আল্লাই তার বিপদ কাটিয়ে দেন। পুতের জন্য দোয়া করো বেশি কইরা। কিছু না বুঝে মাথা নাড়ে কালা ডাক্তার। গুনে গুনে ১৭ দিন পর মেজো ছেলে সকালের গয়না নৌকায় চড়ে পাগলা বাজার। পরে সিলেট থেকে বাসে ঢাকা। এক সপ্তাহ পর রাইস মিলের হেড মিস্ত্রি খবর দিল, ডাক্তার, তোমার মাইজম পোলা সৌদি আরবের মদিনা শহরে পৌঁছে গেছে। কাজও পাইছে ভালো, মসজিদ নববীতে মুর্দা গোসলের কাজ।

এক মাস পর চিঠি পায় মেজ ছেলের। আব্বা সালাম। পর সমাচার, আপনাদের দোয়ায় আমি ভালো আছি। ভালো কাজ পাইছি। সৌদি মুর্দাদের যত্ন করে শেষ গোসল করিয়ে দিলে খুশি হয়ে রিয়াল দিয়ে পকেট ভর্তি করে দেয়। মিলের চাচার কাছে টাকা পাঠাইছি। তোমার ও মায়ের জন্য। ওখান থেকে মোয়াজ্জিন চাচাকে ৫০০ টাকা দিয়ো। চাচার দেওয়া টাকায় পাসপোর্ট বানাইছি।

আজ প্রায় ৩০ বছর পর শহরের ছয় তলা অফিসে চার তলার চেম্বারে বসে স্মরণ করে সেই দিনের কথা। এক সময়ে হতদরিদ্র পল্লি চিকিৎসক কালা ডাক্তারের মেজ ছেলে সৌদিপ্রবাসী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সোলায়মান শেখ। ২৬ বছর সৌদি আরবের মদিনার মসজিদে নববীতে আল্লার দীনি ও পছন্দের কাজ শেষ করে মধ্য বয়সে ঢাকা, সিলেট আর সদর থানায় আধা ডজন বাড়ির মালিক আলহাজ সোলায়মান শেখ। পরের ভিটায় জন্ম নেওয়া সোলায়মান এখন পাঁচ/দশ একর জমি কিনে না। দু/তিন গ্রামের সবাই একমত হয়ে যখন তার অফিসে আসে সেদিনই শত একরের জমির মালিকানা হাত বদল হয়ে নতুন নামে রেজিস্ট্রি হয়। নতুন মালিকের নাম আলহাজ সোলায়মান শেখ, সাকিন অমুক গ্রাম, থানা, উপজেলা ও পোস্ট–সদর, জেলা-সুনামগঞ্জ।