সময় আসলে কী?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমাদের জীবন ও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে সময় | অনেকে বলেন সময় নদীর স্রোতের মতো। আবার অনেকে বলেন সময়ই অর্থ। সময় আসলে কী? ছোট্ট এই প্রশ্নের উত্তরটি অনেক জটিল। হয়তো কোনো উত্তরই আমাদের জানা নেই। প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সময়ের কোনো অতি সুপরিচিত ব্যাখ্যা আমরা দাঁড় করাতে পারি, কিন্তু সত্যিকারের সময় কী সেটা খুঁজে বের করা হয়তো আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা প্রতিনিয়ত সময় ও সময়ের অস্তিত্বকে গভীরভাবে জানার চেষ্টা করে আসছেন |
মানুষ সর্ব প্রথম সময়ের ধারণা মূলত দিন-রাতের নিয়মিত আবর্তন থেকে বের করে। পৃথিবীর নিজ অক্ষে একটি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। যে সময়টি একদিন সূর্যোদয় থেকে পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যে অংশ সূর্যের দিকে থাকে সে অংশে দিন এবং বিপরীত অংশে রাত হয়। প্রাচীন মানুষ প্রকৃতির এই নিয়মিত পরিবর্তনকে একটি আদর্শ সময় মান হিসাবে বিবেচনা করত। এরপর সূর্যঘড়ি অর্থাৎ​ সান-ডায়াল দিয়ে সময় মাপার প্রচলন শুরু হয়। সান-ডায়াল যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দিনকে কতগুলো ঘণ্টায় ভাগ করা হয়। পেন্ডুলামের দোলন কালকে আদর্শ মানদণ্ড ধরে ঘণ্টাকে মিনিটে ও মিনিটকে সেকেন্ডে ভাগ করা হয়। কোয়ার্টজ ক্রিস্টালের কম্পনকে কাজে লাগিয়ে এই সেকেন্ডকে আরও ক্ষুদ্রতম এককে ভাগ করা হয়। এভাবেই জন্ম হয় আধুনিক ঘড়ির। ঘড়ি বলে দিত এখন সময় কত। কিন্তু কোনো ঘড়ি বলতে সক্ষম হয়নি সময় নিজে কী?
পদার্থবিজ্ঞানে সময় ও গতি এই দুইটির মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, দুজন চালক A ও B যখন যথাক্রমে প্রতি ঘণ্টায় ১০ ও ২০ কিলোমিটার ক্ষমতাসম্পন্ন দুইটি ভিন্ন গতিবেগের মোটরবাইক নিয়ে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের পথ অতিক্রম করতে যান তখন চালক B কম সময়ে পথটি অতিক্রম করতে পারেন। যদিও পথের দূরত্ব সমান। এ ক্ষেত্রে আমরা বলি B-এর সময় A-এর চেয়ে কম লেগেছে। সময় কম লেগেছে এই জন্য বলি, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক কেবলমাত্র চালক A ও B-এর মধ্যে তুলনা করে। এবার যদি তৃতীয় একজন চালক C, যার মোটরবাইকের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার, এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তাহলে তিনি আরও কম সময়ে পথটি অতিক্রম করবেন। এবার আমরা বলব তিনজন চালকের মধ্যে C-এর সময় কম লেগেছে। কারণ এখন আমরা তিনটি ভিন্ন গতিবেগের মধ্যে তুলনা করছি। একই ভাবে যদি পৃথিবী নিজ অক্ষে স্বাভাবিক গতির চেয়ে বেশি গতিতে ঘুরতে থাকে তাহলে দিন-রাত খুব দ্রুত বদলাতে থাকবে। আমরা বলব খুব দ্রুত দিন-রাত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তার মানে আমাদের কাছে সময় এক ধরনের আপেক্ষিক ধারণা।

১৬৮৭ সালে সর্ব প্রথম প্রকাশিত ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থে স্যার আইজ্যাক নিউটন অ্যাবসলিউট টাইম ও স্পেস (Absolute Time & Space) সম্পর্কে আধুনিক মতবাদ প্রকাশ করেন। যেটি পরবর্তীতে সময় সম্পর্কীয় ধারণার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। অ্যাবসলিউট টাইম ও স্পেস হলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তব অভিজ্ঞতা, যেগুলোকে অবজেকটিভ রিয়ালিটিও বলা হয়। নিউটন সময়কে একটি ধ্রুব মান বলে উল্লেখ করেন এবং তার মতে সময়ের পরিবর্তনের হার সব জায়গায় সব সময় সমান। এ মতবাদ অনুসারে দুইটি ভিন্ন গ্রহে অবস্থান করা দুটি আলাদা প্রাণীর কাছে সময়ের অভিজ্ঞতা একই রকম। এমনকি মহাবিশ্বের সবকিছু যদি স্থির হয়ে যায় এবং কোনো ইভেন্ট অথবা ঘটনার প্রবাহ না থাকে, তবুও সময় চলতে থাকবে। নিউটনের মতে অ্যাবসলিউট সময়কে কোনো দৃশ্যমান রূপকের সঙ্গে মেলানো অসম্ভব। এটাকে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
পরবর্তীতে আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির আবিষ্কার সময় সম্পর্কিত সব পুরাতন ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। আইনস্টাইনের মতে সময়ের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয় ও এটি স্থানভেদে সর্বদা পরিবর্তনশীল। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী মহাশূন্যের যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আধিক্য বেশি সময় সেখানে তত ধীর গতিতে প্রবাহিত হয়। একটি পারমাণবিক ঘড়িকে বিভিন্ন উচ্চতায় স্থাপন করে দেখা যায় তাদের মধ্যে সামান্য হলেও সময়ের তারতম্য রয়েছে। সময়ের এই পার্থক্যকে গ্রাভিটেশোনাল টাইম ডাইলেশন (Gravitational Time Dilation) বলা হয়। তিনি আরও বলেন, যেকোনো শূন্য মাধ্যমে গতি ও সময়ের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক আছে, যেটা আমরা সচরাচর উপলব্ধি করতে পারি না। তার মানে আমাদের কাছে সময়য়ের উপলব্ধি গতি, দিক ও মাধ্যম ভেদে ভিন্ন হতে পারে। ছোট একটি পরীক্ষা করা যাক। ধরা যাক একজন ব্যক্তি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে দক্ষিণ দিক বরাবর গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী এই অবস্থায় গাড়িটির সমগ্র গতিবেগ দক্ষিণ দিক বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। কিছুক্ষণ চলার পর গাড়িটি হঠাৎ​ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভিন্ন পথে ঘুরে ঘণ্টায় একই বেগে চলতে শুরু করল। গাড়ির চালক লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন যে, একটু আগে দক্ষিণ দিকে নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে যে সময় লেগেছিল এবার সমান পথ অতিক্রম করতে আরেকটু বেশি সময় লাগবে। এর কারণ হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মোড় নেওয়ার পর গাড়িটি যেই গতিবেগ প্রাপ্ত হয় সেটি মূলত পুরাতন রাস্তার গতিবেগের একটি অপসারিত অংশ। তাই নতুন রাস্তায় চলার পর গতিবেগ তুলনামূলকভাবে কমে যাবে। ফলস্বরূপ গাড়িটির অগ্রগতিও ধীর গতিতে হতে থাকবে। এটিকেই বলা হয় টাইম বনাম স্পেসের সম্পর্ক |

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, সময়ের সাপেক্ষে বিবেচনা করলে কোনো স্থির বস্তুই স্থির নয়। বরং তারও একটা নিজস্ব গতিবেগ আছে। কারণ একজন ব্যক্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও সময় দাঁড়িয়ে থাকবে না। এই গতিবেগকে আমরা বলি মোশন থ্রো টাইম (Motion Through Time)। অত্যন্ত গতিশীল কোনো বস্তু ও অত্যন্ত ধীর গতিসম্পন্ন কোনো বস্তুর সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা হয়। যেমন ভূমিতে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তির গতির সাপেক্ষে আকাশে চমকানো বিদ্যুতের গতি অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে প্রবাহিত হয়। যদি কোনো ব্যক্তি অথবা বস্তু বিদ্যুতের সমান গতিতে দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে তাহলে সে এক সেকেন্ডে প্রায় এক লাখ ৮৬ হাজার দুই শ ৮২ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করবে। এই সমান গতিতে চলতে থাকলে টাইম ট্রাভেল করে ব্যক্তিটি কয়েক সেকেন্ডেই তার অদূর ভবিষ্যতে প্রবেশ করতে পারবে। তাহলে আমরা দেখলাম একই সঙ্গে একজন ব্যক্তির বর্তমান আরেকজন ব্যক্তির ভবিষ্যৎ হতে পারে। সময়ের এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আমাদের বলছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তিনটি আলাদা সময়কাল নয় বরং তারা সহাবস্থান করছে। সময় হয়তো একেবারেই কোনো নির্দিষ্ট দিকে ধাবমান নয় বরং সেটা স্থির। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এগুলো কেবলমাত্র আমাদের ভ্রম | হয়তো অতীত কখনো ছিল না, ভবিষ্যৎ কখনো আসবে না, যেটা আছে সেটা কেবল কতগুলো মুহূর্তের সমষ্টি, যেটাকে আমরা বর্তমান নামে ডাকি | এই বর্তমানই আমাদের বিরতিহীনভাবে তাড়া করে বেড়ায় শতাব্দী থেকে শতাব্দী, সহস্রাব্দ থেকে সহস্রাব্দ |(লেখক শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং)