সমুদ্র, জাহাজ ও বরফ, স্মৃতিতে টাইটানিক

নিউফাউন্ডল্যান্ড এবং লাব্রাডরের দক্ষিণ উপকূল থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: লেখকMd. Rashedul Alam Rasel

যখন এ লেখা লিখছি, তখন আমার জাহাজের অবস্থান কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে ২৫০ মাইলের মতো দক্ষিণে, টাইটানিক স্মৃতিস্তম্ভের শহর হ্যালিফ্যাক্স ও নোভা স্কটিয়া থেকে ২০০ মাইলের মতো পূর্বে; যেখানে উত্তর মেরুর হিমশীতল বরফ গলা জলের স্রোত ল্যাব্রাডর সমুদ্র হয়ে উত্তর আটলান্টিকে মিশছে, বাতাসের তাপমাত্রা মাঝেমধ্যে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। শীতকালের মাঝামাঝি সময়ে যেখানে সমুদ্র খুব উত্তাল, কোথাও কোথাও সাদা বরফে আবৃত।

সমুদ্র, জাহাজ ও বরফের কথা বলতেই আমাদের সবার মাথায় চলে আসে টাইটানিক বিপর্যয়ের কাহিনি। গল্প শুনে হোক অথবা সিনেমা দেখে হোক, টাইটানিক জাহাজের কথা আমাদের সবার কমবেশি জানা। টাইটানিক ব্রিটিশ যাত্রীবাহী জাহাজ। ১৯১২ সালে ১৫ এপ্রিলে যুক্তরাজ্যর সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্ক সিটিতে প্রথম সমুদ্রযাত্রার সময় আইসবার্গে ধাক্কা লেগে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায়। সামুদ্রিক নিরাপত্তার পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি প্রাণহানি সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ১১০ বছর পর এসে আজও টাইটানিক বিপর্যয় সামুদ্রিক নিরাপত্তার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে হয়েছে অনেক অনুসন্ধান, এসেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল। অনুসন্ধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলগুলোর মধ্যে একটি ছিল ১৯১৪ সালে আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য সেফটি অব লাইফ অ্যাট সির (SOLAS) প্রতিষ্ঠা, যা আজও সামুদ্রিক নিরাপত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।

নোভা স্কটিয়ার উপকূল- উত্তর আটলান্টিক
ছবি: লেখক

ব্রিটিশ হোয়াইট স্টার লাইন শিপিংয়ের সবচেয়ে সিনিয়র ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথ, চিফ মেট হেনরি টিংগেল ওয়াইল্ড, ফার্স্ট অফিসার উইলিয়াম ম্যাকমাস্টার মারডক ও দ্বিতীয় অফিসার চার্লস লাইটোলার নিয়ে গঠিত একদল চৌকস নাবিকদের নেতৃত্বে টাইটানিক ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে রওনা হয়েছিল।
কুইন্সটাউন ছেড়ে যাওয়ার পর টাইটানিক আইরিশ উপকূল ধরে ফাস্টনেট রক পর্যন্ত প্রায় ৫৫ নটিক্যাল মাইল (৬৩ মাইল/১০২ কিমি) যাত্রা করে। সেখান থেকে ১ হাজার ৬২০ নটিক্যাল মাইল (১৮৬০ মাইল/৩,০০০ কিমি) উত্তর আটলান্টিকজুড়ে একটি গ্রেট সার্কেল পথ ধরে নিউফাউন্ডল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বে ‘কোনা’ নামে পরিচিত সমুদ্রের একটি জায়গায় পৌঁছানোর জন্য রওনা হয়েছিল। যাত্রার শেষ ধাপটি ছিল ১৯৩ নটিক্যাল মাইল (২২২ মাইল/৩৫৭ কিমি) অ্যামব্রোস লাইট এবং অবশেষে নিউইয়র্ক হারবার পর্যন্ত। ১৭ এপ্রিল সকালে নিউইয়র্ক পৌঁছানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল রাত ১১টা ৪০ মিনিট (জাহাজের সময়) একটি আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর ডুবে যায় টাইটানিক। সমুদ্রে দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক প্রাণহানির সব মাইলফলক ছাড়িয়ে রচিত হয় এক মর্মান্তিক ইতিহাস।
এখন কথা হচ্ছে, কেন এ স্মৃতিচারণা!

বরফ কেটে চলা। সেন্ট লরেন্স উপসাগর
ছবি: লেখক

এ স্মৃতিচারণার একটাই কারণ, নোভা স্কটিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অক্ষাংশে ৪১, ৪৩, ৩২ উত্তর, দ্রাঘিমাংশে ৪৯, ৫৬, ৪৯ পশ্চিম স্থানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২.৫ মাইল (৪ কিলোমিটার) গভীরে উত্তর আটলান্টিকের তলদেশে যে ইতিহাস শায়িত আছে, তার খুব নিকট দিয়ে পরিকল্পনা করেছি আমাদের বর্তমান সমুদ্রযাত্রাটি, গন্তব্য নিউইয়র্ক।
ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথের সময়ের ১১০ বছর পর একই সমুদ্রে একই গন্তব্যে জাহাজ চালাতে গিয়ে একরকম নস্টালজিয়া অনুভব করছি। অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি কল্যাণে আবহাওয়ার প্রতিবেদন, বরফ সতর্কতাসহ নেভিগেশন বার্তাগুলো নিয়মিত হাতে আসছে। পর্যালোচনা করে পরিকল্পিত গতিপথ পুনর্নিরীক্ষণ করে এগিয়ে যাচ্ছি। তবে ১৯১২ থেকে ২০২২—সময় পেরিয়েছে ১০০ বছরের বেশি, নিয়ম বদলেছে হাজারো, কিন্তু সমুদ্র বদলায়নি তার চিরচেনা রূপ।

*লেখক: তন্ময় রায়, মার্চেন্ট নেভি অফিসার, উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর থেকে