আতাউল গণি ওসমানী

পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই তাঁর কর্ম ও বেঁচে থাকাকালে নিজের বা ভবিষ্যৎ বংশধরদের আত্মীয় বা আপনজনদের জন্য কিছু করে রাখার চেষ্টা করেন। কিছু ব্যতিক্রমী মানুষও আছেন, যারা আজীবন দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ

করে গেছেন। নিজের সুখ, শান্তি, আরাম, আয়েশের সামান্য চিন্তাও করেননি। মরহুম বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর কর্মকালে এবং চিন্তা–ভাবনায় দেশ ও জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেশবাসীর হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।

আতাউল গণি ওসমানী ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তাঁর বাবার কর্মস্থল সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস সিলেট থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বালাগঞ্জ থানার দয়ামীর নামক স্থানে। ওসমানীর বাবা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ও মা জুবেদা খাতুন।

ওসমানী স্কুলে বাল্যকালের লেখাপড়া শেষ করে সিলেট সরকারি হাইস্কুল থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি ১৯৩৪ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দীর্ঘ ৪ বছর এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নকালে অসাধারণ মেধাবী ও বহুগুণের অধিকারী ছাত্র ওসমানী অনেক সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ডিগ্রি নেন। তিনি নিজ মেধা বলে ১৯৩৯ সালে ক্যাডেট হিসেবে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তারপর ১৯৪০ সালে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি দেরাদুন থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন অফিসার হিসেবে যোগ দেন। নিজের পেশায় মেধার স্বাক্ষর রেখে ১৯৪১ সালেই দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে ক্যাপ্টেন ও ১৯৪২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মেজর পদে উন্নীত হন। এত অল্প বয়সে এই পদের মর্যাদা এর আগে আর কোনো সেনা অফিসারের ভাগ্যে জোটেনি। এটি এক বিরল সম্মান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ওসমানী বিভিন্ন রণাঙ্গনে অত্যন্ত বীরত্ব, ত্যাগ, সাহস ও রণনৈপুণ্যের পরিচয় দেন। ইতিমধ্যে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে আইসিএস ক্যাডারে নিয়োগ পান। কিন্তু জওহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণ পেয়েও তিনি কূটনৈতিক পদ গ্রহণের প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। ওসমানী সৈনিক জীবনে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছেন সব সময়ই।

জেনারেল ওসমানীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও রণকৌশল আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ওসমানীর নেতৃত্বে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে বাঙালি জাতি এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার পায়, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ওসমানী পাকিস্তানে চলে যান এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গঠনের কাজে শরিক হন। এ সময় তিনি দক্ষতা, সাহসিকতা ও ধৈর্যের সঙ্গে কর্তব্য পালন করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। তিনি বিভিন্ন বিভাগে সমন্বয়, কার্যনীতি, অধীনস্থ বিভাগের অফিসার–আমলাদের নিয়োগ, পরিকল্পনা ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ওসমানী এ সময় থেকে বিভিন্ন ব্রিগেডের ট্রেনিং টিমের ভারপ্রাপ্ত অফিসার নিযুক্ত হন এবং বিভিন্ন সেনাদলকে যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশল শিক্ষাদানে তৎসংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা, যুদ্ধ প্রস্তুতি, পরিচালনা সম্পর্কে উন্নত কৌশল নিয়ে প্রশিক্ষণ দেন।

চট্টগ্রাম সেনানিবাসের প্রতিষ্ঠাতা ওসমানী ১৯৫১-৫৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোরসহ এ অঞ্চলের সেনানিবাসগুলোর স্টেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালের শেষ দিকে তাঁকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের

ইপিআর বাহিনীর উপমহাপরিচালক পদে নিয়োগ করা হয়। ১৯৫৬ সালের মে মাসে কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং দেশরক্ষা পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের সমন্বয়ের কাজে

আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি সেন্টো ও সিয়াটোর

বিভিন্ন বৈঠকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রতিনিধি ও মুখপাত্র মনোনীত হন। ১৯৬৪ সালের সামরিক বিভাগের আধুনিক ব্যবস্থা ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন মূল্যায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র, গোলন্দাজ, সাঁজোয়া, পদাতিক বাহিনী ও বিমানবাহিনী এবং পেন্টাগনের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন।

১৯৬৫ সালে ওসমানী পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পশ্চিম রণাঙ্গনে মিলিটারি অপারেশনের উপপরিচালক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি ব্যাটালিয়নের স্থলে ছয়টি ব্যাটালিয়ন গঠন করেন। অনেক প্রতিরোধ ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উন্নয়ন ও সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈন্যের কোটা বৃদ্ধি করতে সফল হন। শুধু এখানেই শেষ নয়, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চপাস্ট সংগীতে কবি নজরুল ইসলামের

জনপ্রিয় সংগীত ‘চল চল, চল’–কে সরকারি অনুমোদনের মাধ্যমে চালু করেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার আগে ওসমানী তৎকালীন সর্বাধিনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে পাকিস্তানের বাঙালি সৈন্যদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সুচিন্তিত ও বিস্তারিত সুপারিশমালা দেন। এসব সুপারিশের মধ্যে লোকসংখ্যার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ প্রস্তাবও ছিল, যা পরবর্তী পর্যায়ে অনুমোদন পায়।

কিন্তু পাকিস্তান আর টেকেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং এ অঞ্চলকে স্বাধীন করার মানসে সংগ্রাম শুরু হয়। সাধারণ মানুষ, ছাত্র, আনসার, পুলিশ, ইপিআর এবং বাঙালি সেনাসহ সব বাহিনীর লোক নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ওসমানী অত্যন্ত ধৈর্য, দক্ষতা, সতর্কতার সঙ্গে জাতির এই বিপর্যয়ের সময় এক বিরাট বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। অসীম সাহস, বীরত্ব ও দক্ষতার

জন্য ১৯৭১ সালে ১২ এপ্রিল ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। জেনারেল ওসমানীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও রণকৌশল আর

অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ওসমানীর নেতৃত্বে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে বাঙালি জাতি এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার পায়, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী আজ আমাদের মধ্যে নেই। মৃত্যু সবারই অনিবার্য। কাজেই তাঁর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মহান জননেতা সমরনায়ক জেনারেল ওসমানী লন্ডনের সেন্টপল হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সামরিক মর্যাদায় তাঁর শেষ ইচ্ছায় তাঁকে শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।

আমাদের মুক্তির জন্য, আমাদের স্বাধীনতার জন্য, আমাদের জাতি সত্তার মর্যাদার জন্য যারা নিজ জীবনকে বলি দিয়ে আত্মোৎসর্গের ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, আমরা তাদের জন্য কি করতে পেরেছি? যে ওসমানী সময়ানুবর্তিতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ধারক ও বাহক ছিলেন, যিনি মূল্যবোধ সৃষ্টির অনুকূলে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতির ক্রান্তিলগ্নে বৃহত্তর স্বার্থে, সার্বিক কল্যাণে শত বাঁধা–বিপত্তি উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, তাঁর জন্য তাঁর

মৃত্যুর পর আমরা কি করতে পেরেছি? এ মহান সৈনিকের জন্মদিনে দুই লাইন লিখে আর স্মৃতিচারণের মাধ্যমে আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যেতে পারে না। তাঁর মহান আদর্শকে, তাঁর জীবনের শিক্ষণীয় দৃষ্টান্তগুলোকে আমার যদি কিছুটা অনুসরণ করতে পারি এবং নিজের জীবনে তাঁর অমূল্য আদর্শের সামান্যতম প্রতিফলন ঘটাতে পারি, তবেই তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন সম্ভব হতে পারে।