সভ্যতার অগ্রগতি

ফেনী রেলস্টেশনে এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি। না কোনো ট্রেন ধরার জন্য বসে নেই। বসে আছি রেলের এক কর্মকর্তার অপেক্ষায়। টিকিটিং সিস্টেমের নতুন টার্মিনাল বসাবার জন্য কিছু ওয়্যারিং করাতে হবে। যদিও আমাদের কাজ, কিন্তু করাতে হবে রেলের লোক দিয়েই। আমি ওই সময়ে কুমিল্লা থাকার কারণে অফিস আমাকেই দায়িত্ব দিল। সকালের ট্রেনে ফেনী এসেছি। তখন প্রায় ১১টা বাজে। রেল কর্মকর্তা ওমর সাহেব কখন অফিসে আসবেন কেউ জানেন না। এখন কোনো ট্রেন নাই। বুকিং ক্লার্কেরা চা-সিগারেট সহযোগে আড্ডায় ব্যস্ত। প্ল্যাটফর্মে একটা মাদি কুকুর তিনটা বাচ্চাসহ শুয়ে আছে। স্টেশনের বাইরে একমাত্র রিকশার গদিতে বসে রিকশাওয়ালা মনের সুখে সিগারেট টানছে...চারদিকে কেমন সুন্দর অলসতা-স্থিরতা। কিন্তু এসব দেখেও মনে স্থিরতার বদলে কেমন বিরক্তি দানা বেঁধে উঠছে...।
—কে...কে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে?
বলতে বলতে একজন ছোটখাটো মধ্যবয়স্ক মানুষ স্টেশনে আসেন।
—জি, আমি।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের নাম পরিচয় দিই। আসার কারণটাও বলি।
—আসো ভেতরে এসে বসো।
খেয়াল করি উনি আমাকে তুমি করে বলছেন। আমার সাধারণ সমস্যা। দৈহিক গড়নই মূল কারণ। মোটা-তাজা হওয়ার জন্য ইউরিয়া সার বাদে বাকি সবকিছু চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। চেহারায় একটু ভারিক্কি আনার জন্য মাঝখানে সপ্তাহ দুয়েক গোঁফ রাখার চেষ্টা করেছিলাম। ফলাফল আরও করুণ। লালমাটিয়ায় আড়ংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছি। হঠাৎ এক সুন্দরী নারী এসে বললেন—‘এই একটা রিকশা ধরে দাও না।’ এর পরের দিনের ঘটনা আরও করুণ। থাক এসব। নিজের অপমানের কথা এত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে না বলাই ভালো।
ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওমর সাহেবের সামনের চেয়ারে বসলাম।
—তোমার কাজের জন্য তো ইলেকট্রিশিয়ান লাগবে। এখন পাব কিনা কে জানে। এই শহীদ...বলে একজনকে ডাক দিয়ে ইলেকট্রিশিয়ানের খোঁজে পাঠান ওমর সাহেব। দুজনের জন্য চায়ের কথাও বলেন। চা আসে। ওমর সাহেব আলাপ শুরু করেন। প্রাথমিক বিরক্তিটা দ্রুত কেটে যায়। দিলখোলা মানুষ ওমর সাহেব। রাজশাহী বাড়ি। কথা বলেন বেশ মজা করে।
—বুঝলা এইখানে পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ে আছি। মনে হয় বছরখানেক থাকতে হবে। সরকারি চাকরির এ-বি-সি ভুলে গেছিলাম তাই এই অবস্থা। এ-বি-সি কি জানো তো?
—জি না।
আমি ছোট করে উত্তর দিই।
—এ তে হইল অ্যাভয়েড। কাজ আসলেই চেষ্টা করবা অ্যাভয়েড করতে। বি তে হইল গিয়া বাইপাস। বাইপাস মানে কি বুঝছ?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই ওমর সাহেব আবার বলা শুরু করেন।
—পাস আর বাইপাসের মধ্যে কিন্তু ফারাক আছে। পাস দিলে তোমারে আবার ব্যাক পাস দিতে পারে। তাই কাজ এমনভাবে বাইপাস করবা যাতে তোমার কাছে আর ফিরা না আসে।
—সি তে কি?
আমি আবার ছোট করে জিজ্ঞেস করি।

—কাজ অ্যাভয়েড কিংবা বাইপাস করতে পারো নাই। তাহলে কি করবা জানো। একটা কমিটি কইরা ফালাইবা। সি তে হইল কমিটি। কাজ খারাপ ভালো যাই হোক তোমাকে যেন কেউ দায়ী করতে না পারে। দায় সব কমিটির। এই এ-বি-সি থিওরি মেনে অনেক দিন ভালো ছিলাম। ভূতে কিলাইছিল তাই কিছু কাজ করতে গেছিলাম। ফলাফল পানিশমেন্ট পোস্টিং।
এভাবেই কথা চলতে থাকে। আমার বেশ ভালো লাগে। একটু পরেই শহীদ এসে জানায় ইলেকট্রিশিয়ান সেদিন ছুটিতে।
—তোমাকে তো তাহলে আর একদিন আসতে হবে। ফিরবে কীভাবে?
—প্ল্যান ছিল তো কাজ শেষ করে বিকেলের ট্রেনে ফিরে যাব। এখন তো আর কিছু করার নাই। দেখি বাসেই ফিরে যাব।
—বিকেলের ট্রেনেই ফিরো। চলো বাসায় যাইয়া আড্ডা দিই। এইখানে অল্প কিছুদিন এসেছি। তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালোই লাগবে।
—আজ থাক। অন্য আর একদিন যাব।
আমি আপত্তি করার চেষ্টা করি।
—এত ফর্মালিটি করো কেন মিয়া। তা ছাড়া এখান থেকে বাস স্ট্যান্ড গিয়ে বাসে উঠে যতক্ষণে ফিরবে তার আগেই ট্রেনে ফিরতে পারবা।
অতএব ওমর ভাইয়ের বাসায় যেতেই হয়। স্টেশন থেকে কাছেই বাসা। দরজা যিনি খোলেন তিনি যে ওমর ভাইয়ের স্ত্রী সেটা বোঝাই যায়। ভদ্রমহিলা এককালে অনেক সুন্দরী ছিলেন সেটা বোঝা যায়। এখনো যথেষ্ট সুন্দরী...এতটাই যে ওমর ভাইকে তার পাশে বেমানানই লাগে। ওমর ভাই পরিচয় করিয়ে দেন।
—সানু ভাত দাও তাড়াতাড়ি।
ওমর ভাই বলেন।
—ভাই আড্ডা দিতে এসেছি। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ঝামেলা কেন।
আমি আপত্তি করি।
—ছোট ভাই তোমাদের বাসায় দুপুরবেলায় কেউ গেলে কি খেতে বলো না। আর এই মানুষটার সাথে এই সব ফর্মালিটি করে লাভ নাই। কি চিজ জানো না তো?
সানু ভাবি হাসতে হাসতে বলেন।
—আর তুমি খুব ভালো। আমাকে প্রথম দিন কি বলেছিলে বলব ছোট ভাইকে।
ওমর ভাই পাল্টা উত্তর দেন।
—খবরদার। ছেলেটার সাথে আজকেই পরিচয়। কি ভাববে?
—ভাবাভাবির ধার আমি কি কোনো দিন ধারছি। শোনো ছোট ভাই। ভালো ফুটবল খেলতাম। মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে খ্যাপ খেলতে যেতাম। খ্যাপ খেলা কি জানো তো?
—জি জানি।
—একদিন অন্য এক পাড়ায় খ্যাপ খেলতে গিয়ে দেখি পাশের এক দোতলা বাসার বারান্দায় এক আসমানের পরি দাঁড়াইয়া খেলা দেখতাছে। কী আর খেলা। একটু পর পর আসমানের পরির দিকেই খালি চোখ যায়। দুই গোল খাওয়ার পরে একজন আইসা বলল ঠিকমতো না খেললে পা দুটো নিয়া কিন্তু বাসায় যাইতে পারবা না। একটা গোল দিয়েই বারান্দায় চোখ। দেখি পরি আনন্দে হাততালি দিচ্ছে। আমারে আর পায় কে। হ্যাটট্রিক করলাম। এক সপ্তাহ ওই পাড়ায় ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু আমার অত ধৈর্য নাই। একদিন কলেজে যাওয়ার রাস্তায় ঠিকই মুখোমুখি হলাম। ভালো লাগার কথা বলতেই কি বলল শুনবা?
—কি?
—একটা হরলিকসের কৌটা কিনা বাসায় যান। নিয়মিত হরলিকস খেয়ে বড় হয়ে তারপর দেখা করবেন।
—কি করব অতটুকু একটা মানুষ। তখন মুখটাও ছিল বাচ্চা বাচ্চা।
ভাবি হাসতে হাসতে বললেন।
—হইছে এখন হাতমুখ ধুয়ে আসো।
ভাবি তাড়া দেন। আমার খুব খুব ভালো লাগে এই স্বল্প পরিচিত যুগলকে। মনেই হয় না মাত্র অল্প কিছুক্ষণ আগে এদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।
খেতে বসে আরও মজার মজার কথা বলতে থাকেন ওমর ভাই। মাঝে মাঝে ভাবিও খুনসুটিমূলক কথাবার্তা বলতে থাকেন।
—ভাই ভাবিকে কীভাবে রাজি করালেন সেটা তো বললেন না।
আমি জিজ্ঞেস করি।
—খবরদার। এই সব নিয়া আর আলাপের দরকার নাই।
ভাবি বাধা দেন।
—পোলাপান মানুষ শুনতে চাইছে। অসুবিধা কি?
—অসুবিধা আছে। শোনো ছোট ভাই। ঘটনা বিশেষ কিছু না, আমিওতো মানুষ, মায়া দয়া আমারও তো আছে।
ভাবি হাসতে হাসতে বলেন।
—ঠিক আছে তাহলে আমাদের বিয়ের গল্প বলি।
—আচ্ছা, বিয়ের গল্পই বলেন। কীভাবে প্রস্তাব পাঠালেন। আমি আবার জিজ্ঞেস করি।
—তুমি যে এত বোকা এইটা বুঝতে পারি নাই।
—কেন ভাই?
—আমাকে দেইখাও যে মনে করে আমি প্রস্তাব করব আর সানুর বাবা-মা খুশি মনে আমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে, সে বোকা নাতো কে বোকা?
—তাহলে?
—আরে ভাইগা যাইয়া বিয়ে করছি। এক বন্ধুদের আমবাগান আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। বিয়ে করে বউ নিয়ে গেলাম সেই আমবাগানে। আমবাগানের পাশেই ছোট একটা বাড়ি। আমের মৌসুমে এক-দুজন লোক থাকে সেখানে। তখন শীতকাল। বাড়িতে কেউ নাই। আমাদের দুজনকে রেখে বন্ধুরা রাজশাহী ফিরে গেল। কথা হলো দুই দিন পর আবার আসবে আমাদের বাসা আর সানুদের বাসার খবর নিয়ে। খাবার ভালোই রেখে গেল। কিন্তু খেয়াল করি নাই যে, দুইটা পাতলা কাঁথা ছাড়া তেমন গরম কোনো গরম কাপড় নাই ঘরে। উত্তরবঙ্গে খুব ঠান্ডা পরে। বিশেষ করে রাতে। মানুষজন বাসর জাগে গল্প করতে করতে। আমরা ঠান্ডায় ঠক ঠক করতে করতে রাত জাগলাম। দুই দিন পরে বন্ধুরা এল আরও দুঃসংবাদ নিয়ে। সানুর বাবা নাকি মহা খেপেছে। থানা-পুলিশ করে একাকার। বন্ধুরা পরামর্শ দিল বর্ডার পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া গিয়ে কিছুদিন থাকতে। হাতে দুই হাজার টাকা দিয়ে বর্ডার পার করে দিল বন্ধুরা। প্রথম তিন-চার দিন ভালোই গেল। তারপরেই শুরু হলো অর্থকষ্ট। এমনও দিন গেছে সারা দিন শুধু দুইটা লুচি পরোটা আর সবজির তরকা খেয়ে দিন কাটাইছি। একজন আর একজনকে বলতাম, ‘দেখেছ ইন্ডিয়ার আলো বাতাসে মনে হয় কিছু আছে। একদম ক্ষুধা লাগে না।’ কী যে কষ্ট...।
মুখে কষ্টের কথা বলছেন অথচ ওমর ভাই সানু ভাবি দুজনের চোখে মুখেই কী অদ্ভুত সুখের ছায়া। ইসস সবাই যে কেন এই কষ্ট পায় না...।
সেদিন ফিরে আসলাম। পরদিন রেলের ফোনে ওমর ভাই জানালেন ইলেকট্রিশিয়ান পরের সপ্তাহে আসবে। আরও অনেকক্ষণ গল্প করলেন। পরের সপ্তাহে গেলাম। ইলেকট্রিশিয়ান ফরিদকে নিয়ে ওমর ভাই প্রস্তুত ছিলেন। ফরিদকে কাজ বুঝিয়ে দিলাম। নিজেও কিছু কাজ করলাম। বিকেলে ফেরার আগে ওমর ভাইয়ের বাসায় আধা ঘণ্টা সময় কাটালাম। আগের মতোই খুব ভালো লাগল।
পরদিন আবার গেলাম। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সুইচ অন করতেই ইউপিএসের পেছন থেকে ধোয়া বের হলো। ইলেকট্রিশিয়ান ফরিদ কোথাও শর্টসার্কিট করে রেখেছে। ভাগ্য ভালো ইউপিএসের ফিউজটা জ্বলে যাওয়াতে আর কোনো ক্ষতি হয় নাই। ওমর ভাই ফরিদকে ডাকলেন।
—এইটা কি কাজ করলা। জানো এখনই লাখ টাকার ক্ষতি হতে পারত।
ওমর ভাই রাগত স্বরে বলেন।
স্যার আমার কোনো দোষ নাই। এইটা আগের ইলেকট্রিশিয়ান দেলোয়ারের ভুল। আসেন স্যার দেখাই।
ফরিদ বলে।
ভুল হয় মানুষের। আর যে ভুলটা অন্যের ঘাড়ে চাপাইয়া দিতে পারে তাকে কি বলে জানো? অফিসার। তুমিতো বিরাট অফিসার হইয়া গেছ ফরিদ। যাও এই স্যারের সঙ্গে যাইয়া কাজটা শেষ করো।
বেশ রাগী গলায় বলেন ওমর ভাই। ফরিদও আর তেমন কথা বাড়ায় না। পুরোনো ওয়্যারিং অনেকখানি আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। সেদিন আবার ট্রেন লেট করে দুই ঘণ্টা। তাই ওমর ভাইয়ের বাসায় বেশ কিছুটা সময় কাটে।
আলাপের একপর্যায়ে ভাবি বলেন, ওমরের গান শুনেছ?
—না তো!
-তোমার পকেটে যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে তো?
ওমর ভাই পরিহাস সুরে জিজ্ঞাসা করেন।
-কেন?
আমি জিজ্ঞেস করি।
-দুনিয়ায় দুই ধরনের শিল্পী আছে। একদলকে টাকা দিয়ে গান গাওয়াতে হয়, আর একদলকে টাকা দিয়ে গান থামাতে হয়।
স্বভাবসুলভ ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলেন ওমর ভাই। কিন্তু যখন হারমোনিয়ামটা নিয়ে গান শুরু করেন আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। এত সুন্দর গলার গান আমি অনেক অনেক দিন শুনি নাই।
দুই-তিনটা গানের পরেই আমি বলি, ভাই আপনার গানের গলা অসাধারণ। গানটাকে সিরিয়াসলি নেন।
-আরে রাখো, তোমার ভাবির পীড়াপীড়িতে রেডিওতে দুইবার অডিশন দিছিলাম। দুইবারই ফেল। তোমার ভাবিকে মুগ্ধ করার জন্য গান শিখেছিলাম। সে মুগ্ধ হইলেই হবে...।
দুই দিন পরেই আবার যাই। সব ঠিকঠাক থাকলে এখানে আর আসতে হবে না। এবার সব ঠিকই থাকে। খুব তাড়াতাড়িই সব কাজ শেষ হয়ে যায়। ওমর ভাই আগেই বলে রেখেছিলেন তার বাসায় খেতে হবে। যথারীতি আড্ডা দিতে দিতে খাওয়া চলে।
-ছোট ভাই আজমির শরিফ যাব। আমাদের জন্য একটু দোয়া করো।
হঠাৎ কথার মাঝখানে সানু ভাবি বলেন।
-ষোলো বছর বিয়ে হলো এখনো আমাদের কোনো সন্তান নাই।
-তুমি আবার কি শুরু করলা। সন্তান না হলে কি সুখী হওয়া যায় না।
ওমর ভাই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
-সত্যি ছোট ভাই, একজন মানুষ জীবনে যা পেতে পারে তা প্রায় সবই আমি পেয়েছি। বিয়ের পরে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুরা অনেকে জিজ্ঞেস করেছে, কি দেখে আমি ওমরকে বিয়ে করলাম। এখন আর কেউ করে না। সবাই জানে আমি কি পেয়েছি। কিন্তু এখন যখন ওর আত্মীয়স্বজনরা সন্তানের প্রসঙ্গ তোলে তখন আমার খুব কষ্ট হয়। ওমর অবশ্য কখনোই পাত্তা দেয় না। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয়। এক জীবনে এত ভালোবাসা পেয়েছি...শুধু একটা সন্তান...।
কথা শেষ করতে পারেন না সানু ভাবি। গলা ধরে আসে। ওমর ভাই এটা-সেটা বলে পরিবেশ স্বাভাবিক করেন।
কিছুক্ষণ পরে আবার স্টেশনে আসি ফিরতি ট্রেন ধরার জন্য। ওমর ভাইও সঙ্গে আসেন। স্টেশনে ঢোকার মুখেই মানুষের জটলা দেখি। বয়স্ক এক ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিতভাবে এক মহিলার হাত ধরে আছেন। মহিলার পোশাক চুল সব অবিন্যস্ত।
-আপনারা যাই বলেন। আমি একে পুলিশে দেব। এই সব মহিলা আসলে পাগল সেজে বাচ্চা চুরি করে।
ওমর ভাই ভিড়ের মাঝে এগিয়ে যান। ভদ্রলোককে কি বলে বোঝালেন শুনতে পারি না। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসলে জিজ্ঞেস করি।
-কি ঘটনা ওমর ভাই।
-ঘটনা তেমন জটিল কিছু না। এই পাগলি রাস্তাঘাটে থাকে। কয়েক বছর আগে পাগলি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এলাকার মুরব্বিরা প্রথমবার অ্যাবরশন করে। কিছুদিন পরে পাগলি আবার প্রেগন্যান্ট হয়। বারবার ঝামেলার চাইতে এইবার পাগলির লাইগেশন করানো হয়। সেই থেকে পাগলি বাচ্চা পোলাপান দেখলেই কোলে নিয়ে দৌড় দেয়। দেখলেই তো আমার বউ বাচ্চা-বাচ্চা করে কি পাগল আর এইখানে এই পাগলি। সবই এই নিষ্ঠুর দুনিয়ার খেলা।
উদাসভাবে বলেন ওমর ভাই।
ট্রেনের জানালায় বসে আমার হঠাৎ একটা ছবির কথা মনে হয়। আমজাদ হোসেনের ‘কাল সকালে’। মূল গল্পটাই গ্রামের এমন এক পাগলিকে নিয়ে। পাগলি গর্ভবর্তী হলে গ্রামের বিচারে সাব্যস্ত হয় পরদিন সকালে পাগলি অনাগত সন্তানের পিতা হিসেবে যার নাম বলবে সেই হবে দোষী। গ্রামের শান্ত, নিরুপদ্রব জীবনে হঠাৎ ঝড় ওঠে। রাতের আঁধারে গ্রামের মাতবর আসে টাকা পয়সা গয়না নিয়ে। এরপর একে একে আসে স্কুল মাস্টার, মসজিদের ইমামসহ আরও গণ্যমান্য লোকেরা। সবাই সঙ্গে করে টাকা গয়না নিয়ে আসে। পাগলিকে সবার একই অনুরোধ-‘তুই আমার নামটা বলিস না।’
আর যাই হোক স্টেশনের এই পাগলিকে নিয়ে এমন কোনো সামাজিক সমস্যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। মানুষ-সমাজ-সভ্যতা যে এগিয়ে গেছে তাতে আমার কোনোই সন্দেহ থাকে না...।
মোস্তাফিজুর রহমান: ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।