সব বাবাই যে এক

লেখকের মা এবং বাবা
ছবি: সংগৃহীত

বাবা দিবস আসে, বাবা দিবস যায়। প্রতিবারই ইচ্ছা হয়, বাবাকে নিয়ে কিছু লিখি। কিন্তু জানি না কেন, বাবাকে নিয়ে লিখতে সাহস হয় না। বাবা দিবসে অনেকেই বাবার ছবি ফেসবুকে দেন। বাবাদের সেসব ছবি আমি খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। বাবাদের সেসব ছবিতে আমি আমার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। আসলে সব বাবাই যে এক। সন্তানের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সারাক্ষণ সন্তানের মঙ্গলচিন্তা। আবার বাবারা কখনো শঙ্কিত হন, চিন্তিত হন সন্তানের বিপদে–আপদে, দুর্যোগে, অসুখে।

বাবারা খুশি হন, আনন্দিত হন সন্তানের সাফল্যে, জয়ে, কোনো সুখবরে, কৃতকার্যে। বাবা মানে শ্রদ্ধা, স্নেহ মমতা, ভালোবাসা, নির্ভরতা। বাবার কাছ থেকেই সন্তানেরা পায় নৈতিকতার শিক্ষা। পায় দায়িত্ব, কর্তব্য, মানবিকতা, সততা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, ত্যাগ, আপসহীনতা, স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা, সৎ পথে থাকার শিক্ষা। বাবাদের বিশালত্ব আকাশের মতন, বাবারা সন্তানদের ছায়াদানকারী বৃক্ষের মতো সব সময় আগলে রাখেন।

বাবারা সন্তানদের প্রথম ও শেষ নির্ভরতার জায়গা, আশ্রয়স্থল। বাবারা জানেন, তাঁদের সন্তানদের চাওয়া–পাওয়া, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, দুর্বলতার জায়গাগুলো। বাবা সন্তানদের পথপ্রদর্শক, বাবা হচ্ছেন সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আবার প্রয়োজনে সন্তানদের করেন শাসন। সন্তানের কাছে বাবা হচ্ছেন আইকন। বাবা মানে ‘সব পেয়েছি’র ঘর।
বাবাদের নিয়ে সব সন্তানেরই অনেক গল্প থাকে। আমি এর ব্যতিক্রম হই কী করে! তেমনি একটি গল্প আজ বলছি।

ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিলাম। লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগ ছিল না। বাবাদের ইচ্ছা থাকে, সন্তান চিকিৎসক হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমার বাবার ইচ্ছা ছিল, আমি যেন অ্যাকাউন্টেন্ট হই। সেইমতো তিনি আমাকে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও শফিক রেহমানের (যায়যায়দিন সম্পাদক) মালিকানাধীন রহমান রহমান হক অ্যান্ড কোম্পানিতে (চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেসি ফার্ম) শিক্ষানবিশ হিসেবে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বিষয় সেটা নয়, বিষয় হচ্ছে, বাবার হাত ধরে এই প্রথম আমার ঢাকা দর্শন। বাবা একসময় একটি মাড়োয়ারি ফার্মে চাকরি করতেন।

চাকরির সুবাদে তাঁকে প্রায়ই ঢাকা, চট্টগ্রামে যেতে হতো। তাই এ দুটি শহরের সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। তখন মধ্যবিত্তের প্রিয় বাহন ছিল বেবিট্যাক্সি। বাবা বেবিট্যাক্সি না নিয়ে, নিলেন একটা রিকশা। বললেন, ভালোভাবে শহর দেখতে হলে রিকশাই উত্তম। পুরান ঢাকার মরণচাঁদ থেকে সকালের নাশতা করে রিকশায় চাপলাম। রিকশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মধুর ক্যানটিন, কার্জন হল, রেসকোর্স ময়দান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, পুরাতন জাদুঘর, বিউটি বোর্ডিং, সদরঘাট, লালবাগের কেল্লা, জাদুঘর, পিজি হাসপাতাল, শহীদ মিনার, নিউমার্কেট, বায়তুল মোকাররম, বলধা গার্ডেন, সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখালেন।

বাবা প্রতিটি স্থানের ইতিহাস এবং গল্প বললেন। আরও বললেন, ‘সুযোগ ও সময় পেলে ভ্রমণ করবে। বই পড়ে শেখা আর ভ্রমণের মাধ্যমে শেখায় অনেক পার্থক্য।’ বাবার বয়স এখন ৯০ ছুঁই ছুঁই, এখনো মাথার সব চুল কালো, ভোরে ঘুম থেকে উঠে একটু হাঁটাহাঁটি, একটু বই পড়া, সবার খোঁজখবর নেওয়া এখনো তাঁর নিয়মিত অভ্যাস। এ বয়সেও সবকিছু রুটিনমাফিক। বাবা একসময় খুব ভালো বক্তৃতা দিতেন, মানুষ ও মানবতা ছিল তাঁর বক্তৃতার বিষয়।

একসময় প্রতিদিন একাধিক পত্রিকা পড়তেন। জানার আগ্রহ প্রবল। একটা ছোট্ট শিশুর কাছ থেকেও যে অনেক কিছু শেখা যায়, তা বাবার কাছ থেকেই শিখেছিলাম। আমেরিকার নাগরিত্ব পাওয়ার পর মা–বাবাকে এখানে এনেছিলাম। শীতের মধ্যে ঘরবন্দী জীবন ভালো না লাগায় দুই বছর থেকে আবার দেশে চলে যান ছোট ভাইয়ের কাছে। সেখানে কয়েক বছর থেকে বোনের আবদারে এখন কানাডায়। গতকাল মা ও বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম।

বয়স হয়েছে, কিন্তু আচার–আচরণ যেন শিশুর মতো। বাবা যেখানেই থাকেন না কেন, সব সময় থাকেন আমাদের চিন্তায়। আমরা যেন ভালো থাকি। বাবা যে বিশাল এক বটবৃক্ষ, তা বারবার টের পাই। বাবা যেমনটি চেয়েছিলেন, হয়তো তেমনটি হতে পারিনি, বাবার মতো হতে পারিনি। তবে বাবা যে আদর্শের কথা বা নীতির কথা বলেন, তা আজও পালন করার চেষ্টা করি। বাবা দিবসে সব বাবাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।