সব দেশে প্রবাসজীবন এক নয়

লেখক
লেখক

জীবন-জীবিকার তাগিদেই আমরা প্রবাসে আছি। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি। এর মধ্যে বিরাট অংশ মধ্যপ্রাচ্যে। ইউরোপ, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বহু দেশে বাংলাদেশিরা প্রবাসী হিসেবে আছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের এক জায়গায় ও এক মঞ্চে আনার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে ইউরোপের বাংলাদেশিদের সংগঠন অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন (আয়েবা)। আগামী ১৯-২০ নভেম্বর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম বাংলাদেশ গ্লোবাল সামিটের প্রস্তুতি হিসেবে আয়েবার নেতারা স্বাগতিক দেশ মালয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা করেন গত ২৫ সেপ্টেম্বর।

মতবিনিময় সভায় আয়েবার সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন, সিঙ্গাপুরপ্রবাসী বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতারা ও মালয়েশিয়াপ্রবাসী ব্যবসায়ী, কমিউনিটির নেতা, অধ্যাপক, চিকিৎ​সক, প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা বক্তব্য দেন। সভায় ইউরোপপ্রবাসী আয়েবার নেতাদের বক্তব্য থেকে প্রবাসজীবন বা প্রবাসী নিয়ে নতুন এক বিষয় উঠে এসেছে। বিষয়টা অবশ্যই নতুন নয়, পুরাতনই। এটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অনেক দিন।
বিষয়টা হচ্ছে, প্রবাসজীবনের পার্থক্য। সব দেশ বা সব মহাদেশে প্রবাসজীবন এক নয়। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসজীবন আর মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার মতো দেশে প্রবাসজীবন এক নয়, বিরাট পার্থক্য রয়েছে। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের মিল শুধু এক জায়গায়, তা হলো দেশপ্রেম। প্রবাসে থাকলে দেশপ্রেম বাড়ে। সেটা হোক ইউরোপ, আমেরিকা বা মালয়েশিয়ায়। সবারই মনটা পড়ে থাকে মাতৃভূমিতে। ধূলিমাখা বাংলার মেঠো পথে।
প্রবাসে যাপিত জীবনে একজন মানুষ হিসেবে প্রাপ্য মানবাধিকার, সম্মান, চাওয়া-পাওয়া সব দেশে এক নয়। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় একজন প্রবাসী যে মানবাধিকার ভোগ করেন তা মালয়েশিয়ার মতো দেশে কল্পনাও করা যায় না। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, মালয়েশিয়ার মতো দেশে একজন প্রবাসী বিশ বছর থেকে জীবন–যৌবন সব সে দেশে কাটিয়েও তাঁর ভিসা-পাসপোর্টের টেনশনের শেষ হয় না। মালয়েশিয়ার মতো দেশে টানা আট-দশ বছর কষ্টার্জিত পয়সায় ভিসা লাগিয়ে হঠাৎ ভিসা নবায়ন হয় না। কারও কারও দুই-তিন বছর পর ভিসা নবায়ন হয় না। প্রবাসে এসে প্রবাসীরা ঋণ শোধ করে পারিবারিক আর্থিক সচ্ছলতা আনার পর্যায়ে বেশির ভাগ ভিসা জটিলতায় পড়েন। তখন শুরু হয় অনিচ্ছাকৃত অবৈধ প্রবাসজীবন। মালয়েশিয়ায় অনেক ইন্দোনেশিয়ান প্রবাসীরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও টাকা বাঁচানোর জন্য পারমিট করেন না। মানে বৈধ কাগজপত্র করেন না। অথচ কোনো বাংলাদেশিই অবৈধ থাকতে চান না। সুযোগের অভাবে বাংলাদেশিরা অবৈধ হন। বিদেশি শ্রমিক আইনের কারণে তাঁরা অবৈধ হন। প্রবাসীদের মাঝে একটা কথা প্রচলিত আছে, মালয়েশিয়ার সরকারের নিয়মের শেষ নেই। তা শুধু প্রবাসীদের জন্য। অর্থাৎ প্রবাসীদের জন্য আজ এক আইন হলে কাল অন্য আইন হয়। এর বড় উদাহরণ গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনার চুক্তি করে পরদিন উল্টে যাওয়া।
কথাগুলো বলছি আয়েবার মতবিনিময় সভায় আয়েবার সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত উল্লাহ, আরেক বক্তা জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার সালেক সুফি ও ফখরুল আকম সেলিমসহ ইউরোপ থেকে আসা কয়েকজনের বক্তব্যের সূত্র ধরে। অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সপ্রবাসী এ বক্তারা তাঁদের বক্তব্যে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির উদ্দেশে কথা বলতে গিয়ে বারবার মালয়েশিয়াকে আপনাদের দেশ, আপনাদের দেশে (মানে মালয়েশিয়া মালয়েশিয়াপ্রবাসীদের দেশ) উল্লেখ করেছেন অভ্যাসবশত। কারণ তাঁরা এ সামিটের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ কমিউনিটির সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। ওখানে সব দেশেই সংশ্লিষ্ট দেশকে তাঁদের দেশ বলেছেন।
যদিও তাঁরা সবাই বাংলাদেশকেই নিজের দেশ মনে করেন। কাজ করছেন বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য। যে দেশে প্রবাসী হিসেবে থাকেন সে দেশও তাদের নাগরিকত্ব ও মর্যাদা দিয়েছে। তাই সে দেশকেও তাঁরা তাঁদের দেশ বলতে পারেন। কিন্তু মালয়েশিয়া নয়। এই দেশে মানুষ এই আছে তো এই নাই। আছে আছে, নাই নাই করেও কাটিয়ে দেন ১০-১৫ বছর বা ২০ বছর। এক যুগ কাটিয়েও এখানে ভিসা-পাসপোর্টের চিন্তা মুক্ত হওয়া যায় না। তাই মালয়েশিয়ায় প্রবাসজীবন আর ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসজীবন কখনো এক নয়।
মালয়েশিয়ার মতো দেশে অস্থিরতা কাটিয়ে স্থায়ী স্বস্তির নিশ্বাস নেওয়া যায় না। ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় যেটা হয়। স্থায়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে আমার এক আত্মীয় ২০০৮ সালে টুরিস্ট ভিসায় ফ্রান্সে যান। পাঁচ-ছয় বছর থেকেও ফ্রান্সে তাঁর থাকার বৈধ কাগজপত্র করতে পারছেন না দেখে তিনি ফ্রান্স থেকে পর্তুগাল চলে যান। পর্তুগালে তিনি মাত্র বছর দেড়েকের মাথায় বৈধ কাগজপত্র পেয়ে যান। অবশেষে অস্থিরতা কাটিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তিনি দেশে গিয়ে বিয়ে করেন। যত দিন তিনি ইউরোপে থাকবেন কাগজপত্রের কঠিন ঝামেলা হয়তো আর আসবে না। ফ্রান্সে থাকার সময় তাঁর কাগজপত্র না হলেও তাঁকে কখনো পুলিশে ধরেছে বলে শুনিনি। মালয়েশিয়ায় হলে তা কেমন হতো এটা না-ই বা বললাম আর।
মালয়েশিয়ার মতো দেশে যত দিন, যত বছর থাকবেন তত দিন কাগজপত্রের ঝামেলা কাঁধে নিয়েই থাকতে হবে।
তাই বলি, প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য দেশে থাকলেই প্রবাসী হওয়া যায়, তবে সব দেশে প্রবাসজীবন এক নয়। প্রবাসে থেকে স্বদেশপ্রেমটা সবার এক হয়।