সব্যসাচী কবিকে প্রথম দেখার স্মৃতি

সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক

নিউইয়র্কে ২২, ২৩, ২৪ জুন বসছে তিন দিনব্যাপী বইমেলা। এবারের মেলায় বাংলা ভাষার অনেক গুণী কবি, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে সমভাবে স্মরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সম্মানিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে স্মরণ করা হবে মেলার শেষ দিন রোববার রাত ১০টায়। মূলত স্মৃতিচারণমূলক এই অনুষ্ঠানে কবির জীবনের নানা দিক ও সময়ের স্মৃতিচারণ করবেন কবিপত্নী কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। কবির কবিতা আবৃত্তি করবেন মোহাম্মদ আহকাম উল্লাহ। বইমেলায় প্রিয় কবিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত একটি স্মৃতি স্মরণ করে কবিকে আবারও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে চাই বলে আমার আজ এই লেখা।
১৯৯০ বা ’৯১ সাল হবে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে কবি সৈয়দ শামসুল হক নানা বিষয়ের ওপর বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতেন। সাহিত্যের ওপর অনুষ্ঠান তো ছিলই, এর বাইরেও নানা অনুষ্ঠান ছিল। তেমনি একটি অনুষ্ঠান ছিল দেশের নানা প্রান্তের সাধক পুরুষদের মরমি গানের অনুষ্ঠান। তা ছিল গবেষণামূলক অনুষ্ঠান। অনেক গুণী সাধক মরমি কবিয়াল ও গীতিকারদের দেশবাসীর সামনে সফলভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলে ধরতে পারতেন সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গায়ক-গায়িকারা সুন্দর সুন্দর হারিয়ে যেতে বসা আঞ্চলিক গান পরিবেশন করতেন। হয়তো বা তারই সূত্র ধরে সুনামগঞ্জে আসা। পরে জেনেছি, হাছন রাজার গানের ওপর কিছু চিত্রায়ণ করতে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলেন তিনি।
বেলা তিনটার দিকে শহরের মূল বাজারের মোড়ে দাঁড়ানো। হঠাৎ দেখি কবি হেঁটে হেঁটে দক্ষিণ দিক থেকে আসছেন। কেউই কবিকে চিনছে না। চিনবার কথাও নয়। মফস্বল শহরে অধিকাংশ মানুষ জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত। সেখানে সাহিত্য চর্চা ছিল আধুনিক বিলাসিতা। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনই এই বিলাসী চর্চায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন। তবে নীরবে অনেক সাহিত্যমোদী চালিয়ে যাচ্ছেন কবিতা, প্রবন্ধসহ সব সাহিত্য শাখায় প্রাণবন্ত অনুশীলন। পরনে প্রিয় জলপাই রঙের জ্যাকেট। কানের পাশে অতিপরিচিত সাদা কালো লম্বা জুলফি। রাজ্যের সব চিন্তা চেতনার মূল জায়গা মাথা একেবারে খালি। ধীর পায়ে হাঁটছেন আর বারবার মানুষের দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছেন। দুপা এগিয়ে বললাম, স্যার কেমন আছেন? চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, কবি আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি, আপনি আমাদের প্রিয় কবি সৈয়দ শামসুল হক। মৃদু হেসে বললেন, আমি ভাবিনি এই ছোট শহরে এভাবে কেউ আমার পথ আগলে দাঁড়াবে। কী সুন্দর কাব্যিক কথোপকথন। আবার হেসে বললেন, চলেন এগিয়ে যাই। বললাম, জি চলেন। একটু হেঁটে বামে মোড় নিয়েই আমাদের দোকান সুরমা এজেন্সি। বললাম, স্যার এটি আমার দোকান। ভেতরে যাবেন? ছোট উত্তর, চলেন! ভেতরে যেতেই কে যেন চেয়ার এগিয়ে দিতেই বললেন, না, বসব না। দাঁড়িয়েই ক্ষণিকের আতিথেয়তা উপভোগ করতে চাই। জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কী ধূমপান করেন?
শরীর কাঁপিয়ে জোরে একটি হাসি দিয়ে বললেন, ধূমপান করি মানে আগে আমি ধূমপান করতাম। এখন ধূমপানের নেশার দৈত্য আমাকে দিয়ে ওর সব শখ মিটাচ্ছে। বলেই আবার হাসি। কবিদের সঙ্গে আলাপচারিতার এটিই মজা। আজব আজব কথা মালার আবির্ভাব কোন আগাম বার্তা না দিয়েই। তাই বলেই হয়তো বা কবিদের কথাই বলেন আর লেখা বলেন, আমরা সাধারণ পাঠকেরা গোগ্রাসে গিলি। জয়তু কবি। বেঁচে থাকুন অনন্ত কাল লক্ষ-কোটি পাঠকের সুকোমল হৃদয়ে।
আবারও অতি সাবধানে জিজ্ঞাসা, কোন ব্র্যান্ড স্যার? দেয়ালে সারি সারি বিটিসি কোম্পানির নানা ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেট সাজিয়ে রাখা। বেশ খানিক সময় নিয়ে দেখালেন, এক সময়ের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড গোল্ড ফ্লেক। সাদা হলুদ রঙের রুচিশীল কম্বিনেশনে স্মার্ট প্যাকেট। দোকানের কর্মচারীদের ইশারা করতেই নিয়ে আসা হলো কয়েক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট। আলতো করে মাত্র একটি প্যাকেট হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, আপনার এই বিষময় আতিথেয়তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞ। বলেই আবার রাস্তায় নেমে হাঁটতে লাগলেন পশ্চিমমুখী রাস্তা ধরে। লক্ষ্য পশ্চিম বাজার লাগোয়া হাছন রাজার বাড়ি।