‘সেরা অদম্য সাংবাদিক’ হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত দৈনিক প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলাম বলেছেন, ‘ব্রিটেনের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকসহ যাঁরাই আমার জন্য প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম।
রোজিনা ইসলাম বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যখন আমি আক্রান্ত হই, তখন দেশের সব স্তরের মানুষের পাশাপাশি ব্রিটেনের বাংলাদেশি সাংবাদিকেরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। একইভাবে গত এক বছর চেনা–অচেনা যাঁরা আমাকে সাহস জুগিয়েছেন, পাশে থেকেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, আমার জন্য রাস্তায় নেমে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি শব্দও উচ্চারণ করেছেন, তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দুঃসহ দিনগুলোতে আমার ও আমার পরিবারের প্রতি যে সহমর্মিতা আপনারা দেখিয়েছেন, আমি অভিভূত, আপ্লুত ও কৃতজ্ঞ। এই ঋণ শোধ হবার নয়। আপনাদের বড়ত্বকে সম্মান জানাই, কুর্নিশ করি। আপনারা সবাই আমার ভালোবাসা নেবেন।’
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাব কার্যালয়ে ক্লাবের সভাপতি ও সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা পরিচালনা করেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ।
গত বছর পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সচিবালয়ের বেশ কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা এবং গ্রেপ্তারের পর দেশে–বিদেশে সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন। ইউকে-বাংলা ও লন্ডন-বাংলা দুটি প্রেসক্লাব মানববন্ধন করে রোজিনা ইসলামের মুক্তি দাবি করে।
এ প্রসঙ্গে রোজিনা ইসলাম বলেন, ‘দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের এমন সহযোগিতার জন্য আমি আজ আপনাদের সামনে। আমার জীবনে সবার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, দুর্নীতিবিরোধী সাংবাদিকতায় আমি কখনো ভয় পাই না। কারণ, মৃত্যু তো একদিন আসবেই। সুতরাং সৎ সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনকল্যাণে কাজ করে মারা গেলেও তাতে দুঃখের কোনো কারণ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ২০ বছর বয়স থেকেই সাংবাদিকতা করছি। আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। আমি এভাবেই সাংবাদিকতা চালিয়ে যাব।’
বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভার শুরুতে প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং অনুষ্ঠানটি সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে নিবেদন করা হয়।
প্রাণবন্ত আলোচনায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সংবাদের কোনো অভাব নেই। তিনি বলেন, ‘ভালো সাংবাদিকতার জন্য সেদিন সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষও আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আসলে ভালো সাংবাদিকতার কোনো বিকল্প নেই।’
গত বছরের ১৭ মে রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের পিএর কার্যালয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা হয়। এরপর ব্রিটিশদের তৈরি সেই এক শ বছরের পুরোনো ‘অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট’ আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রিজন ভ্যানে একাকী তাঁকে কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা থাকতে হয়। তাঁর জীবনে এটি ছিল খুব কঠিন একটি সময়। এরপর তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। তিনি কারাগারের জীবনকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পান। নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেন। কারাগারে কয়েক দিন থাকার পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এখন পর্যন্ত তিনি জামিনেই আছেন। কিছুদিন পরপর আদালতে হাজির হতে হয়।
গ্রেপ্তারের এক বছর পূর্ণ হলেও তিনি মামলা থেকে পুরোপুরি খালাস পাচ্ছেন না। তাঁর অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে শর্তসাপেক্ষে। ছয় মাস পর পাসপোর্টটি ফেরত দিতে হয়। অন্যদিকে ঘটনার দিন যাঁরা রোজিনা ইসলামকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেছেন, তাঁদের কোনো বিচার হয়নি।
মতবিনিময়কালে সাংবাদিকেরা ওই দিন সচিবালয়ে যাঁরা রোজিনাকে হেনস্তা করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
প্রেসক্লাবের সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতায় যত প্রতিবন্ধকতা আসুক, আমাদের সেই চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে। কারও হুমকি-ধমকিকে ভয় পেলে সৎ সাংবাদিকতা হেরে যাবে। প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ বলেন, রোজিনা ইসলাম সাহসী সাংবাদিকতায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
মতবিনিময় সভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে বক্তব্য দেন বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রযোজক সিনিয়র সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসাইন, লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমদ, সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক শামসুল আলম, স্পেকট্রাম রেডিও–বাংলার উপস্থাপক মিছবাহ জামাল, দৈনিক প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধি তাবারকুল ইসলাম পারভেজ, লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের নির্বাহী সদস্য আহাদ চৌধুরী বাবু, সিনিয়র সাংবাদিক মাহবুব আলী খানশূর, সাপ্তাহিক দেশের বার্তা সম্পাদক ফয়সল মাহমুদ ও প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য মানিক মিয়া।
মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সাপ্তাহিক সুরমার বার্তা সম্পাদক কবি আবদুল কাইয়ূম, এনটিভি ইউরোপের চিফ রিপোর্টার আকরামুল হোসাইন, ফটো সাংবাদিক জিআর সোহাইল, লন্ডন–বাংলা প্রেসক্লাবের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি এমরান আহমদ, মিডিয়া অ্যান্ড আইটি সেক্রেটারি মো. আব্দুল হান্নান, ইভেন্ট অ্যান্ড ফ্যাসিলিটি সেক্রেটারি রেজাউল করিম মৃধা, নির্বাহী সদস্য নাজমুল হোসেন, নির্বাহী সদস্য সারওয়ার হোসাইন, সাংবাদিক হাসনাত চৌধুরী ও সাংবাদিক আবদুল হান্নান।