সন্তানকে অনলাইনে পড়াব, নাকি স্কুলে পাঠাব

দেড় বছর পর স্কুলে যাচ্ছে দুই সন্তান। এ কারণে উদ্বিগ্নতার পাশাপাশি আনন্দিত শাহানা ও মাসুদ দম্পতি

সন্তানের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, সচেতনতামূলক অভিভাবকত্ব মা-বাবার দায়িত্বের আওতায় পড়ে। তবে, করোনা মহামারি ইতিমধ্যেই বাবা-মার সিদ্ধান্তকে পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। আজ একটি বিশাল সিদ্ধান্ত তাঁদের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে—‘আমি কি সন্তানকে ইনপারসন শিক্ষায় পাঠানোর ঝুঁকি নেব?’

কোভিড-১৯ মহামারির কথা আসলেই চলে আসে বাবা-মাদের সংগ্রামের কথা। এ সময়ে সন্তানকে স্কুলে পাঠানো কিংবা রিমোট লার্নিংয়ে রাখা—কোনোটার সঠিক উত্তর তাঁদের জানা নেই। তাঁদের কাছে মনে হতে পারে, কোনো উত্তরই সঠিক নয়। চারপাশে বিতর্কিত মতামত চলছে। পরামর্শের জন্য তাঁরা কাকে বিশ্বাস করবেন, তা নির্ধারণ করাও কঠিন।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলো মহামারির কারণে গত দেড় বছর ধরে দূরদর্শিতার সঙ্গে বিকল্প হিসেবে রিমোট লার্নিং পদ্ধতি চালিয়ে গেছে।

ইনপারসন লার্নিং শিশুদের মধ্যে ভালো সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করে। শৈশব একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় শিশুরা প্রতিদিন নতুন কিছু শেখে। অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন এবং বিকাশ শিশুদের তাদের সম্পর্কে আরও জানতে সাহায্য করে। তাদের সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করে এবং মানসিক চাপের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করে।

আমরা জানি, সরাসরি সংযোগ শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের একটি বিশাল উপাদান। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শিশুদের মানসিক ক্রিয়াকলাপ, অন্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, বাইরের খোলা আবহাওয়া এবং স্বাস্থ্যকর খাবার তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখে।

আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসের মতে, ‘শিশুরা স্কুলে শিক্ষার বাইরে আরও অনেক বেশি কিছু পায়। তারা স্কুলে সামাজিক ও মানসিক দক্ষতা শেখে, স্বাস্থ্যকর খাবার এবং শারীরিক ব্যায়াম পায়, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তাসহ অন্য পরিষেবাগুলো পায়। যা অনলাইনে সহজে পাওয়া যায় না।’

অন্যদিকে গবেষণায় দেখা গেছে, রিমোট লার্নিং শিক্ষার ফলে স্কুল বয়সী শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা এবং আত্মঘাতী চিন্তা ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইনপারসন শিক্ষায় শেখার বিভিন্ন ধরন থাকে। তেমনি প্রতিটি শিশুর আলাদা শেখার ধরন আছে। শেখার এই শৈলীগুলো চারটি ভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করা হয়। যেমন—

ভিজ্যুয়াল: এখানে শিক্ষার্থীরা পাঠের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণরূপে বুঝতে শিক্ষকের দেহের ভাষা ও মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পারে। ভিজ্যুয়াল ডিসপ্লেগুলো যেমন-ডায়াগ্রাম, সচিত্র পাঠ্যপুস্তক, ভিডিও, ফ্লিপ চার্ট, হোয়াইট বোর্ড ব্যবহার থেকে ভালো করে শিখতে পারে শিক্ষার্থীরা। একটি পাঠ বা শ্রেণিকক্ষে আলোচনার সময় চাক্ষুষ শিক্ষার্থীরা তথ্য সংগ্রহ করে বিস্তারিত নোট নিতে পারে।

শ্রবণ: এখানে শিক্ষার্থীরা মৌখিক পাঠ, আলোচনা, কথা বলার মাধ্যমে এবং অন্যদের কথা শোনার মাধ্যমে সর্বোত্তমভাবে শেখে। শিক্ষার্থীরা কণ্ঠস্বর এবং গতি শোনার মাধ্যমে বক্তৃতার অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা করতে পারে।

পড়া/লেখা: যেখানে শিশুরা নোট নেওয়ার মাধ্যমে লিখিত শব্দ ব্যবহার সবচেয়ে ভালো শেখে।

কাইনেস্থেটিক: কাইনেস্থেটিক একটি স্পর্শকাতর শেখার ধরন। যেখানে শিক্ষার্থীরা কোনো বক্তৃতা শোনা বা দেখার পরিবর্তে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করে।

অন্যদিকে রিমোট শিক্ষায় প্রতিটি শেখার শৈলীকে চ্যালেঞ্জ করে। উদাহরণস্বরূপ, গতিশীল শিক্ষার্থীরা তথ্য সংরক্ষণের জন্য শারীরিক কৌশল ব্যবহার করতে পারে না এবং শিক্ষার্থীরা দেখা ও যথার্থ শোনা থেকে বঞ্চিত হয়।

যদিও অনলাইন শিশুদের বিশ্বজুড়ে আরও বেশি লোকদের সঙ্গে দেখা করতে সহায়তা করে, তবে মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়া শিশুদের আরও বেশি লোকদের জানতে সহায়তা করতে পারে।

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এই গ্রীষ্মের শুরুর দিকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে, যাতে শিশুদের বিকাশের জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে গঠিত সংযোগ শিশুদের সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, আচরণগত বা অন্যান্য বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য।

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য যত্ন ও সেবা অন্যান্য শিশুদের থেকে বেশি প্রয়োজন হয়। করোনা মহামারিতে এখন তাদের দৃশ্যমানভাবে শিক্ষকদের সহায়তার বিষয়টি নেই। স্থায়ী সম্পর্কগুলো গড়ে তোলার মতো, বিশেষ করে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মিথস্ক্রিয়াটির মুখোমুখি হতে পারছে না শিক্ষক, কাউন্সেলর, স্কুল সাইকোলজিস্ট ও থেরাপিস্টরা। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক যে রুটিন ও যত্নের দরকার, তা এখন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অনেক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। এতে অনেক বাবা-মাও সংকটে পড়েছেন।

যেসব অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার পরই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। তবে এটাও সত্য, যদিও স্কুল ভবনগুলোতে প্রতিটা শিক্ষক, কর্মী এবং শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বজায় রেখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবু কোভিড-১৯ সংক্রমণের একটা ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

তাই শিশু সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন কিনা, সেটা নির্ভর করছে বাবা-মার সিদ্ধান্তের ওপর।