সন্তানকে অতিরিক্ত শাসন নয়

আমরা বাচ্চাদের শাসন করি তাদের ভালোর জন্য। দিনের শুরু থেকে রাত পর্যন্ত তাদের বলে দিই কী করতে হবে। কথা শুনলে বলি লক্ষ্মী বাবু, না শুনলে রাগারাগি করি। কেন শুনছ না, বেশি বুঝ—এসব বলে তাকে কথা শুনতে বাধ্য করি। কিন্তু বাচ্চাটি মনে মনে কী ভাবছে, কিংবা তার মনে কী প্রভাব পড়ছে তা অনেক বাবা-মা খেয়াল করে না। বরং তারা ধরেই নেয়, বাচ্চা মানুষ-ও কী বুঝবে। আমরা যা বলি তাই ঠিক। এমন কী বাবা-মা ভুল কিছু বললে কখনো বাচ্চাকে ‘সরি’ বলার প্রয়োজন মনে করে না। উল্টো কথা না শুনলে শাসনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
লেখাপড়া, খাবার-দাবার, বন্ধু–বান্ধব, সবকিছুই যেন গণ্ডির মধ্যে আটকে দেয় বাচ্চাটিকে। তার কী পছন্দ বা অপছন্দ সেদিকে খেয়াল রাখে না অনেকে। এই যে চাপিয়ে দেওয়া, এই যে তাকে বাধ্য করা, এই যে তাকে শাসন করা—এভাবে এতে হিতে বিপরীত হতে পারে তা বাবা-মা ভাবে না। কিন্তু এই বাচ্চাটি যখন আরেকটু বড় হয়, আরেকটু বুঝতে শিখে, তার চলার পরিধি বাড়তে থাকে, তখন সে আর বাবা-মাকে তোয়াক্কা করে না। সে নিজের মতো চলতে চায়। তার মনে ধারণা জন্মে যায়, বাবা-মা বোধ হয় তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। তা সে মেনে নিতে নারাজ।
তখন সে পা বাড়ায় বন্ধুদের দিকে। বন্ধু ভালো কী মন্দ, তা সে বিবেচনা করতে চায় না, সে স্বাধীন হতে চায়, বাবা-মায়ের শাসন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়। এই যে তার চাওয়া, এটি একদিনে গড়ে উঠে না। বাবা-মায়ের অতিরিক্ত কেয়ারিং তাকে বাধ্য করে এভাবে গড়ে উঠতে। বাবা চায় পড় পড়, মা চায় শিল্প সাহিত্যে মন দাও। কিন্তু তার মন কী চাইছে, তা কী তারা জানতে চায়?
বাচ্চাদের মন থাকে কোমল। দেখা যায়, স্কুলে ভালো ফল চাই–ই চাই, অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের আরবি শিক্ষা দেয়, অনেকে গানের শিক্ষক রেখে দেয়, অনেকে নাচের স্কুলে বাচ্চাদের নিয়ে যায়। দেখা যায়, বাচ্চাটির নিজের জন্য সময় নেই। সে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে যায়। ভালো না লাগলেও বাবা-মাকে খুশি করার জন্য তাই করে চলে। গর্বিত বাবা-মা প্রতিবেশী আত্মীয়দের বলতে থাকেন, আমার সব কথাই ওরা শুনে।
আমি একবার এমন এক দম্পতিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা কী সন্তানের কথা শোনেন? আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলেছিল, ওদের আবার কী কথা শুনব, ওরা কী বুঝে? সেই অভিভাবকদের সঙ্গে অনেক দিন পর আবার দেখা হয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন আছে তাদের সন্তানেরা। তাদের কথা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে। তাদের সন্তান যখন এলিমেন্টারি (প্রাইমারি) স্কুলে পড়ত, তখন বাবা-মায়ের কথা ছাড়া এদিক-ওদিক হতো না। সমস্যা হলো মিডল স্কুলে যাওয়ার পর। বাবা-মাকে ফাঁকি দিতে শুরু করে, মিথ্যা বলতে শুরু করে। ক্লাসে অনিয়মিত হয়ে যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবককে ই-মেইল করে। অভিভাবক শাসনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। ফলাফল আরও খারাপ হতে থাকে। একসময় বাচ্চারা টিচারদের কাছে অভিযোগ করে তাদের বাবা-মায়ের বিহেভ (আচরণ) ভালো না, কথা না শুনলে সারাক্ষণ বকাবকি করে। শিক্ষক বাবা–মাকে স্কুলে ডাকেন, মিটিং হয়, বাচ্চাদের অভিযোগে তারা আনফিট বাবা-মা হিসেবে বিবেচিত হন।
অভিভাবকেরা তাজ্জব বনে যায়, কারণ তাদের মাথায় এটা কখনোই আসেনি ছেলেমেয়ে এমন অভিযোগ করবে। তবুও তারা স্বাক্ষর করে বাচ্চাদের নিয়ে আসে এই বলে, তারা আর কোন রকম, কোন কাজে বাজে আচরণ করবে না। তাদের প্রথমবারের মতো সুযোগ দেওয়া হয়। এই বলে নিশ্বাস ফেলছিলেন দম্পতি।
বাচ্চারা এখন বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। তবে তাদের মতো করেই চলে। কিছু বললে হুমকি দেয়, শিক্ষককে বলে দেবে।
বলছিলেন, আমরাতো তাদের ভালোই চেয়েছিলাম। কোন বাবা-মা কী চায় তাদের সন্তান খারাপ পথে যাক? কত কষ্ট না করেছি শিশু সন্তানদের জন্য। সত্যি এই পৃথিবীতে বাবা-মায়ের মতো আপন কে আছে? কিন্তু এই বিষয়টা সন্তানের মাথায় রাখতে হবে আদর করে, ভালোবাসা দিয়ে। শাসন করতে হবে, যাতে খারাপ পথে না যায়। কিন্তু সেই শাসন যেন অতিরিক্ত না হয়। এমন যেন না হয়, আমরাই ঠিক, বাচ্চারা কী বুঝবে। বাচ্চাদের ব্রেইন অনেক শার্প, তারা সবকিছুই বুঝে। বরং তাদের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে, যাতে বাচ্চারা প্রাণ খুলে কথা বলতে পারে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করতে পারে।
বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ। বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবী বলা চলে। এই ব্যস্ততার মধ্যেও সব বাবা-মা সন্তানদের সময় দিতে চেষ্টা করে। পরিবারে শাসন করার মতো কেউ একজন থাকতে হয়। হয় বাবা, না হয় মা। একজন শাসন করলে অন্যজনের কাছে যেন বাচ্চা আশ্রয় পায়। দুজনেই শাসন করলে এবং অতিরিক্ত শাসন করলে হিতে বিপরীত হয়। অনেকে তা বুঝতে চায় না। শাসনের পাশাপাশি বাচ্চাকে বুঝতে দিতে হবে, তার চাওয়ারও মূল্য আছে। খেলাধুলা, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দেওয়া অর্থাৎ বাচ্চা কী চাইছে, তা খেয়াল রাখতে হবে। যদি মনে হয়, ভুল কিছু চাইছে, তা বুঝিয়ে বলতে হবে। আমরা অভিভাবক হয়েছি বলে আমাদের ভুল হবে না—এমন নয়।
আমার মেয়ে তখন ছোট, একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম বড় হয়ে তুমি কী হবে?
বলেছিল, আইসক্রিম বিক্রি করবে ট্রাকে করে। নিউজার্সিতে ছোট ছোট বাচ্চাদের আইসক্রিম ট্রাক আছে, এগুলো ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। আমার মেয়ের মনেও তাই বাসা বেঁধেছিল। সে বড় হয়ে তাই হবে।
কেউ জিজ্ঞেস করলে তাই বলত। আমি হাসতাম। বলতাম, তুমি যা হতে চাও তাই হবে। কিন্তু আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল আর তার স্বপ্নগুলো পাল্টে যেতে থাকে। এ বছর তার স্কুল শেষ। ভর্তি হলো কলেজে, কম্পিউটার সায়েন্সে। তার এটাই পছন্দ এখন।
আসলে চাপাচাপি না করে বাচ্চাদের বুঝিয়ে বলতে হয়। একবার যদি তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া যায় কোন পথটা ভালো, কোন কাজটা ভালো, সেখানেই তারা আবদ্ধ থাকে। সন্তানকে মানুষ করতে হলে সবচেয়ে ভালো দিক হলো তাকে সময় দেওয়া, বন্ধুর মতো আচরণ করা। শাসন অবশ্যই দরকার আছে, কিন্তু তা যেন অতিরিক্ত না হয়, এমন যেন না হয়, শাসন করতে গিয়ে তার সঙ্গে আপনার দূরত্ব তৈরি হয়। সেই দূরত্ব একবার হয়ে গেলে তা আর সহজে ঘুচে না।
বরং সন্তান একবার আপনার নাগালের বাইরে গেলে বা বয়স আঠারো পার হলে সে আপনার আর খোঁজও নিবে না। অতিরিক্ত শাসনে যেসব বাচ্চারা বড় হয়েছে, আঠারো পার হয়েছে এখন তারা স্বাধীন। এতটাই স্বাধীন যে বাবা-মাকে আর ভাবে না। বরং ওই যে ছোটবেলার অতিরিক্ত শাসন তাদের কাছে বাবা-মায়ের অত্যাচার মনে হয়েছে, মনে হয়েছে তাদের জীবন কয়েদখানায় ছিল, এখন তারা মুক্ত। তাই আপনার বাচ্চা ছোট থাকতেই তাকে গুরুত্ব দিন, ভালোবাসুন, বন্ধু হোন, পাশাপাশি শাসন করুন। শুধু খেয়াল রাখুন শাসনটা যেন অতিরিক্ত না হয়ে যায়। তাহলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।