শরতের আকাশের মেঘগুলো যে রকম ডানা ছাড়াই ঘুরে বেড়ায়, মনের আকাশের ভাবনাগুলো আমাদের মনে তেমন উড়ে বেড়ায়। ভাবনাগুলোকে কখনো ধরে রাখা যায়, কখনো বা ধরা যায় না। শরতের আকাশের মেঘের ভেলা মূলত সাদা রঙের, কিন্তু মনের আকাশের ভেলাগুলো বিচিত্র রঙের। শরতের আকাশ বলি আর অন্য যেকোনো ঋতুর কথাই বলি না কেন, আকাশতো প্রকৃতিরই অংশ। আকাশের রং আর মানুষের মনের মধ্যে আছে অপূর্ব মিল। ক্ষণে ক্ষণে নানা বর্ণ ধারণ করে। অনিন্দ্য সুন্দর রং দিয়ে প্রকৃতি আকাশকে ক্যানভাস করে কত কত ছবি আঁকে। এসব ছবির সৌন্দর্য যখন আমাদের হৃদয় আকাশকে স্পর্শ করে, ময়ূরের মতো নেচে ওঠে হৃদয়। অনির্বচনীয় অনুভূতি জেগে ওঠে হৃদয়ের কোণে কোণে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য মনে দোলা দিয়ে যায়। প্রকৃতি সুন্দর বলে কী সেই দোলার স্পর্শ আমরা টের পাই? এ নিয়ে কোলরেজ তাঁর ‘ডিজেকশন এন অড’ নামে একটি বিখ্যাত কবিতায় খুব সুন্দর কথা বলে গেছেন। প্রকৃতি সুন্দর বলেই আমরা তাকে সুন্দর বলতে বাধ্য হই, আবার আমাদের মন প্রকৃতিকে সুন্দর বলে, তাই প্রকৃতি সুন্দর হয়ে ওঠে। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে একটি মিথস্ক্রিয়া আছে. কোলরেজের মতো সুন্দর করে আর কাউকে বলতে শুনিনি। কোলরেজের সৌন্দর্য অনুভূতির দর্শন বিশ্ব সাহিত্যে বিরল।
আকাশের মেজাজ, আকাশের রূপের সঙ্গে, মানুষের মন মেজাজকে মিলিয়ে দেখলেও বিস্মিত হতে হয়। আকাশ কখনো স্নিগ্ধ, কখনো ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন, কখনো প্রচণ্ড ঝড়ের মেজাজে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেওয়ার মতো মূর্তি ধারণ করে। শুক্ল পক্ষের আকাশে জোছনার ঢেউ বিশেষ করে পূর্ণিমার ভরা চাঁদের দিনগুলোতে, আর কৃষ্ণ পক্ষে আকাশ ঘন কালো নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে থাকে। যেমন মানুষের মনের আকাশকে কখনো কখনো অন্ধকার, হতাশা গ্রাস করে ঠিক সে রকম। আকাশ যেন মানুষের মনোজগতের এক অবিকল চিত্ররূপ।
আকাশ ও প্রকৃতিকে নিয়ে মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা ভাবনাগুলোকে এত বিস্তৃত করে লিখতে চাইনি। বাঙালি আবেগাপ্লুত হলে মাত্রা জ্ঞান হারায়। ‘হৃদয়ের এ–কুল ও–কুল দু কুল তখন ভেসে যায়। শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ছিলাম। শামসুর রাহমান এসে ভর করলেন মনে। কবিতা পড়তে পড়তে, তাঁর গদ্য লেখার কথাও মনে এল। তাঁর গদ্য লেখার ধরনও ছিল কত অসাধারণ। অকপটে তিনি মত প্রকাশ করতেন। তখন কেমন ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতা? মানুষের চিন্তার যোগসূত্র আসলে কত বিচিত্র। শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে চিন্তা ক্রমশ অগ্রসর হয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় এসে স্থির হলো। শামসুর রাহমান কেমন করে চিন্তাভাবনাকে অনুবাদ করতেন? যে সব সৃষ্টিশীল ভাবনা তার মনের আকাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো, তার সব কী তিনি প্রকাশ করতে পারতেন? মত প্রকাশের প্রসঙ্গ আসলেই আমার কেন জানি, সবার আগে শামসুর রাহমানের কথা মনে আসে। তাঁর গদ্য ছিল কবিতার মতো অসাধারণ। মতপ্রকাশ নিয়েই কথা বলব পাঠকের সঙ্গে আজ, তাঁর আগে শামসুর রাহমানের গদ্য নিয়ে আর একটু কথা বলে নিই।
শামসুর রাহমানের গদ্য বললেই দৈনিক বাংলায় লেখা উপসম্পাদকীয়ের কথা মনে পড়ে যায় সবার আগে। শামসুর রাহমান যখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন, তখন নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন। আগেও তিনি অনেক সংবাদপত্রে নানা ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। দৈনিক বাংলায় তিনি লিখতেন ‘মৈনাক’ ছদ্মনামে। কবি হিসেবে তিনি যেমন অনন্য ছিলেন, তাঁর গদ্যও ছিল অনন্য, ভিন্ন মাত্রার। তাঁর লেখা উপসম্পাদকীয় পড়লে তা অনুভব করা যেত। তিনি উপসম্পাদকীয়তে মনের ভাবনার ছিপি খুলে দিতেন। তাঁর লেখা উপসম্পাদকীয় গতানুগতিক ধারার বাইরে ছিল। কণ্ঠ ছিল নিচু ও মার্জিত। পড়লে বোঝা যেত, এ লেখা শামসুর রাহমানের। সন্তোষ গুপ্ত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কিংবা নির্মল সেনের লেখা নয়। যদিও তিনি উপসম্পাদকীয় হিসেবে লেখা লিখতেন, কিন্তু উপসম্পাদকীয় অনেকটা সৈয়দ শামছুল হকের ‘হৃৎ কলমের টানের’ মতো সাহিত্য ও সংস্কৃতিধর্মী লেখা মনে হতো।
‘মৈনাক’ ছদ্মনামে দৈনিক বাংলায় তাঁর লেখা ছিল রোমান্টিক প্রকৃতির। উপসম্পাদকীয় আবার রোমান্টিক হয়? এরকম কথা শুনে হয়তো পাঠক নড়েচড়ে উঠবেন। কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, চলচ্চিত্র রোমান্টিক হয়। তাই বলে উপসম্পাদকীয়ের মতো ভাবগম্ভীর বিষয়, তাও আবার ১৫/২০ বছল আগে শামসুর রাহমানের সম্পাদকীয়—যখন বাংলাদেশের সংবাদপত্র তাদের গতানুগতিক ধারা পুরোপুরি ভাঙতে পারেনি। রোমান্টিসিজমের যে সংজ্ঞা পড়েছি, সে সংজ্ঞা অনুযায়ী শামসুর রাহমানের উপসম্পাদকীয় রোমান্টিক প্রকৃতির। রোমান্টিসিজম শুধু তো প্রেম ভালোবাসায় সীমাবদ্ধ থাকে না। রোমান্টিসিজমে থাকে স্বপ্ন, কল্পনা, সাহস, বীরত্ব, সৃজনশীলতা আরও কত কিছু। শামসুর রাহমানের মতো কবির হাতে গদ্য লেখা হলে সে গদ্যও রোমান্টিক না হয়ে উপায় নেই।
শামসুর রাহমানের উপসম্পাদকীয়তে ভর দুপুরে খাটে শুয়ে দেয়ালের দিকে স্বপ্নাবিশিষ্ট চোখে তাকিয়ে যা কিছু কল্পনা ও বাস্তবে তিনি দেখতেন, তাঁর বর্ণনা থাকত। দেয়ালে আকাশ, ঘুড়ি, রাজপুত্র, রাজকন্যা সবকিছুই তিনি দেখতে পেতেন। দেয়ালের আকাশে কোনো ঘুড়ি, সেই ঘুড়িগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘুড়ি মেঘ ছুঁই ছুঁই—এ রকম করে তিনি তাঁর সে দিনের লেখা হয়তো শুরু করতেন। সমসাময়িক বিষয়কে তিনি এড়িয়ে যেতেন না, সমাজের নানা অসংগতি, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিদের আস্ফালন, রাজনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে তিনি লিখতেন। কিন্তু লেখার স্টাইল বা ধরনে স্বপ্নাবিষ্ট কবির মনের ছবির প্রতিফলন ঘটতো। যারা গদ্যের অনন্য সুন্দর স্বাদ পেতে চাইতেন, তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন খুব প্রিয়। এ রকম রোমান্টিক স্টাইলে হরেক রকম বিষয়ে লেখা উপসম্পাদকীয় খুব কম পাওয়া যেত। কবি হিসেবে তাঁর ভাবনা কারণে–অকারণে তাঁর হৃদয়ে দোলা দিত, আর তিনি সে সব ভাবনা কবিতার মত করে গদ্য লিখে পাঠকদের সামনে উপস্থাপনা করতেন।
ফিরে আসি আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে। সক্রেটিস, গ্যালিলিও, নজরুল থেকে শুরু করে কত কত চিন্তাশীল দার্শনিক, কবি, বিজ্ঞানী অকপটে মত প্রকাশের জন্য নিজেদের জীবনকে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। জীবন তাঁদের বিপন্ন হয়েছে। এসব জানার পরও মত প্রকাশের প্রসঙ্গ আসলে আমার শামসুর রাহমানের কথাই মনে আসে নানা কারণে। মত প্রকাশ নিয়ে সারাটি জীবন তিনি নানাভাবে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে বারবার। তিনি আমার নিজের শহর সিলেটে যেতে পারেননি জীবন সায়াহ্নে। তাঁর সিলেটে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তাঁর পরও শামসুর রাহমানের মনের আকাশে যে সত্য, ঘুরে বেড়াতো মেঘমালার মতো, তা প্রকাশে তাঁর চিত্ত ছিল নির্ভয়। তিনি কবি কিটসের মতো বিশ্বাস করতেন ‘সুন্দরই সত্য, সত্যই সুন্দর’।
শামসুর রাহমান ছিলেন সুন্দরের পক্ষে। আর সুন্দরের পক্ষে যারা থাকেন, তারা থাকেন মানুষের পক্ষে। কিছু কিছু মতামত প্রকাশে তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে আপসহীন। বিশেষ করে মৌলবাদ ও স্বাধীনতার বিরোধিতা তিনি মোটেই মেনে নিতে পারতেন না। মৃত্যুর আগে তাঁর কণ্ঠ ও লেখনী হয়েছিল আরও তীক্ষ্ণ। এ কারণে তিনি গোষ্ঠী বিশেষের অপছন্দের তালিকায় ছিলেন। তাই তাঁর শ্যামলীর বাড়িতে অসুন্দর তরুণ ১৯৯৯ সালে ঢুকেছিল ছুরি হাতে, তাঁর কণ্ঠ ও লেখনী চিরকালের জন্য স্তব্ধ করে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। সুন্দরকে, সত্যকে সহ্য করতে পারে না সেই তরুণ–তরুণেরা। সুন্দর তাদের কাছে অসহ্য। সুন্দরের মধ্যে ওরা সর্বনাশ খুঁজে পায়। তাই তো সুন্দরকে হত্যার জন্য তালিকা তৈরি করা হয়। একাত্তরের আগে, একাত্তরে এবং এই সময়ে। সেই তালিকার নাম আর শেষ হয় না। অজস্র, অগুনতি, সুন্দরের পিয়াসি।
দৃশ্যপট কী পাল্টে গেছে? খুব যে পাল্টায়নি, তা আমরা অনুভব করতে পারি। ম্যাকবেথ নাটকে রাজা ডানকানকে হত্যার জন্য সেনাপতি ম্যাকবেথ যখন ঘুমিয়ে থাকা ডানকানের কক্ষে প্রবেশ করছিলেন, বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়। ম্যাকবেথের মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি তার দুষ্কর্মের কথা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে। রাজা ডানকানের বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন ম্যাকবেথ।। তাঁকে হত্যা করতে যাওয়ার সময় মনের ভেতর বিভ্রম হচ্ছিল, তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, একটি রক্ত মাখা ছোরা, তার বুকের দিকে তাক করে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতির কাছ থেকে এ ছিল সতর্ক বার্তা। যারা এখন সৃষ্টিশীল কাজ করছেন, যারা সুন্দরকে সত্য মনে করেন, তাঁদের অনেকেরই এখন বিভ্রম হচ্ছে। তাঁরাও রক্তমাখা ছোরা দেখতে পাচ্ছেন কখনো কখনো।
ম্যাকবেথ তো তাঁর অতিথি রাজাকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন রাজা হওয়ার লোভে। তা ছিল অপরাধ। আর সৃষ্টিশীল মানুষেরা? তারাতো সত্যকে, সুন্দরকে আবিষ্কার করেন। ক্ষণিকের বিভ্রম, ক্ষণিকের দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। এ বিভ্রম কেটে যাবে, যেমন মেঘের আড়াল থেকে প্রখর সূর্যের মতো সক্রেটিস, গ্যালিলিও, নজরুল উজ্জ্বল আলো ছড়ান, তাঁরাও ছড়িয়ে যাবেন। প্রখর সূর্যের তেজোদীপ্ত আলোর সামনে কোনো মানুষ দাঁড়াতে পারে না। বিভ্রম, দুঃস্বপ্নের রাত যে শেষ হয়ে যাবে দ্রুত, এ কথায় আমাদের অপার বিশ্বাস।