সত্যি কথা বললে কি বিপদ ঘটে?

উম্মে কুলসুমের মন খুব আজ উৎফুল্ল। কারণ আজ তার ষষ্ঠ শ্রেণির প্রথম ক্লাস। সেদিন স্কুলে ক্লাসে তাদের শেণিশিক্ষিকা বললেন, সপ্তাহে একদিন (বৃহস্পতিবার) তারা স্কুলড্রেস বাদে অর্থাৎ অন্য জামা পরে স্কুলে আসতে পারবে। এতে সকলেই খুব খুশি হলো। কুলসুমদের ক্লাসে ফাতেমা নামে একটি মেয়ে পড়ে। সে কিছুটা অহংকারী, তার বাবা বড় চাকরি করে। ক্লাসের তেমন কেউ তার সঙ্গে মিশে না। ফাতেমা দাঁড়িয়ে শিক্ষিকাকে বলল, মিস আমি বুধবারেও অন্য জামা পড়তে চাই। শিক্ষিকা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, তবে এটা শুধু ফাতেমার জন্য প্রযোজ্য।
এমনি ভাবে ক্লাসে সবাই বৃহস্পতিবার স্কুলড্রেস বাদে অন্য জামা পরে আসতে থাকল। দেখা গেল ফাতেমা দুদিন অন্য জামা পরলেও কোনো সপ্তাহেই এমনকি কোনো দিনেই একই জামা পরে না। অন্যদিকে ক্লাসের বাকি মেয়েদের এক বা দুই সেটের বেশি জামা না থাকায় একই জামা পরেই স্কুলে আসছে। এতে অবশ্য তাদের কোনো মাথা ব্যথা নাই। তারা স্কুলড্রেসের পরিবর্তে অন্য জামা পরতে পারছে এতেই খুব খুশি।
ফাতেমা ব্যাপারটা প্রথম সকলের নজরে আনল। সে কুলসুমসহ অন্যান্যদের ডেকে বলল, আমার বাবা অনেক বড় চাকরি করে এবং আমাকে অনেক আদর করে। বাবা প্রায় প্রতিদিনই বেতন পান। তাই আমাকে নতুন জামা কিনে দেন। তোমরা একই জামা কিছুদিন পরপর পরে আসো কিন্তু আমি এক জামা এক দিনের বেশি পরি না।
কুলসুম জিজ্ঞেস করল তোমার বাবা কীসে চাকরি করে? ফাতেমা বলল আমার আব্বু ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা)। অনেক বড় চাকরি। তোমার বাবা কি করে? ফাতেমা কুলসুমকে জিজ্ঞেস করল। কুলসুম বলল বাবা ব্যাংক মানেজার। ফাতেমা বলল, তাহলে তো তোমার বাবাও তোমাকে অনেক জামা কিনে দিতে পারেন। তোমার বাবা আসলে তোমাকে আমার বাবা আমাকে যেমন ভালোবাসে তেমন ভালোবাসে না। কুলসুম কিছু না বলে আলোচনা স্থল ত্যাগ করল।

কিছুটা মন খারাপ করেই সে বাড়ি ফিরল। রাতে বাবা ফেরার পরে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা বাবা ইউএনওরা কি দৈনিক বেতন পায়? আর তুমি কেন ইউএনও হলে না? কুলসুমের বাবা হেসে বলল নারে পাগলি ইউএনও আর আমি প্রায় সমান বেতনই পাই। আর ইউএনও হতে হলে আরেকটা পরীক্ষা দেওয়া লাগে এবং একটা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যেই তা দিতে হয়। আর যে যেই চাকরি ই করুক না কেন মাসে এক বারই বেতন পায়। তবে কেউ যদি ঘুষ খায় তা অন্য কথা। আমি তো মা এই হারাম ঘুষ খাই না। তাই মাসে একবারেই বেতন পাই। বলেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন। কুলসুম বলল এমনি বাবা।
পরদিন ফাতেমা টিফিনের সময় আবার একই ভাবে তাদের বিত্ত-বৈভব নিয়ে আলাপ করছিল। তার মায়ের শাড়ি গয়না, নিজের জুতা জামা এগুলো নিয়ে অনেক কথা বলছিল। এমন সময় কুলসুম বলল, আর অহংকার করিস না, তোর আর আমার বাবা প্রায় সমান বেতনই পায়। আর তোর বাবা আমার বাবার মতোই মাসে একবার বেতন পায়। আর যে বললি প্রতিদিন বেতন পায় ওটা আসলে ঘুষ। তুই ঘুষখোরের মেয়ে। ঘুষের টাকাতে কেনা জামা নিয়ে বড়াই করতে তোর লজ্জা করে না! এই কথা শুনে ফাতেমা কান্নাকাটি শুরু করল। পরে শিক্ষিকা এসে ফাতেমাকে রিক্সা করে বাড়ি পাঠিয়ে দিল।
পরদিন কুলসুমের বাবা অফিসে একটা ফোন পেলেন। তিনি ফোন ধরতেই তাঁর কানে কথা ভেসে এল আমি ইউএনও বলছি।
কুশল বিনিময়ের পর ইউএনও তাঁকে বললেন, ভাই আপনাকে দাওয়াত দিতে ফোন করেছি। আজ রাতে আমার বাসাতে আপনার মেয়ে কুলসুমসহ খাওয়া দাওয়া করবেন।
কুলসুমের বাবা বললেন, কী ব্যাপারে হঠাৎ দাওয়াত দিচ্ছেন যে।
ইউএনও বললেন, আরে আসেন বাসাতে আগে। একটু আলাপ ছিল। ভাবিকেও নিয়ে আসলে ভালো হয়।
কুলসুমের বাবা বললেন, ঠিক আছে আমি কুলসুমকে নিয়ে আসব।
বিকেলে বাসাতে ফেরার পথে কুলসুমের বাবার মনে হলো দুদিন আগে কুলসুম ইউএনওদের বেতন নিয়ে কী যেন বলছিল আজ আবার উনি কুলসুমকে নিয়ে ওনার বাসাতে খেতে বললেন। কোনো সমস্যা করল না তো মেয়েটা?
রাতে কুলসুমের বাবা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ইউএনও সাহেবের বাসাতে ঢুকতেই ফাতেমা কুলসুমকে দেখে ড্রয়িংরুম থেকে চলে গেল। ইউএনও তেমন কিছুই না বলে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে করতে খাওয়া দাওয়া সারলেন। এরপর ইউএনও সাহেব কুলসুমকে কোলে নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে নিয়ে ফাতেমার রুমে গেলেন। ফাতেমা সেখানে মুখ হাঁড়ি বানিয়ে চিন্তা বসেছিল। তার ভাব এমন যে, কুলসুম বাবাকে কত খারাপ একটা গালি দিয়েছে। আর বাবা ওর বাবাকেসহ দাওয়াত করেছে। ইউএনও সাহেব ফাতেমার মাকেও ডাকলেন। তিনি আসার পরে ইউএনও সাহেব বললেন, মা তুই যে আমাকে ঘুষখোর বলেছিলি না, আমি আসলেই ঘুষখোর। আর আমি কী জন্য ঘুষ খাই জানিস মা, আমি ঘুষ খাই আমার মেয়ের একেক সপ্তাহে একেক রকম জামার আবদার মিটাতে। আমি ঘুষ খাই তোর কাকির প্রতি মাসে নতুন শাড়ি কিনতে। আমি ঘুষ খাই তোর কাকির আর তোর বান্ধবীর নানা আবদার মেটাতে।
তোর বাবা বড়ই ভাগ্যবান যে তোর মতো মেয়ে আর তোর মায়ের মতন বউ পেয়েছে। যে মেয়ে দু সেট কাপড়েই সন্তুষ্ট। যেই কারণে তোর বাবার ঘুষ খাওয়া লাগে না। তবে আজ তোকে আমি কথা দিচ্ছি এদের আর কোনো চাহিদা পূরণের জন্য আমি ঘুষ খাব না।

ম্যানেজার সাহেব কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি বলে উঠলেন ভাই বাচ্চা মেয়ে হয়তো খেলার ছলে বলেছিল আপনারা কিছু মনে করবেন না। ইউএনও সাহেব কুলসুমের বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, নাহ ম্যানেজার সাহেব আমি কিছু মনে করিনি, এমন একটা কথা যে আমার শোনার বড়ই দরকার ছিল। আপনার মেয়ে আমার মায়ের মত আমাকে শুধরে দিল।
এরপর অন্যান্য কথার পরে কুলসুমের বাবা মেয়েকে নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলেন নিজের বাসাতে।
দুর্নীতি আজ আমাদের দেশের সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু যার মোকাবিলা করতে পারলেই আমরা বিশ্বের বুকে অনুকরণীয় এক জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারব। তাই আসুন না সবাই মিলে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ গঠন করি। যারা তাদের বাবা-স্বামীকে এমন দৈনিক বেতন তুলতে বাধ্য করছেন তারা একটু ভেবে দেখুন না, আপনাদের একটু হিসাব করে চলাই হয়তো একজন ব্যক্তিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারে। তবে কেউ যদি নিজে থেকেই দুর্নীতি করে তাঁর জন্য এই সূত্র প্রযোজ্য নয়। কিন্তু আপনি নিজে চাইলেই এই দুর্নীতির বেড়াজাল কেটে সহজেই বেরিয়ে হয়ে আসতে পারবেন। একটু চেষ্টা করে দেখুনই না, দেখবেন এটাই আপনার মনের প্রশান্তি লাভের একমাত্র পন্থা।
বি দ্রঃ এটা সম্পূর্ণ সত্যি ঘটনা এবং উম্মে কুলসুম আমার বড় বোন।
(লেখক পিএইচডি গবেষক)