সংকটে ক্যাব শিল্প

বাংলায় একটা কথা আছে, ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।’ এই কথাটি এখন সবচেয়ে বেশি খাটে নিউইয়র্ক নগরের ক্যাব শিল্পের ক্ষেত্রে, যার অবস্থা আগেই খুব সঙিন ছিল। এ নিয়ে একের পর এক আন্দোলন হয়েছে। আর্থিক সংকটে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন অন্তত নয়জন ক্যাবি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

নিউইয়র্কের ঐতিহ্যবাহী ট্যাক্সি ক্যাব শিল্প তার জৌলুস হারিয়ে ধুঁকছে। নগর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। রাইড শেয়ার অ্যাপের প্রতি যাত্রীরা বেশি ঝোঁকায়, আয় কমে যাচ্ছিল ক্যাবিদের। সঙ্গে ছিল এক সময় অতিমূল্যায়িত ট্যাক্সি মেডালিয়নের দামের অবিশ্বাস্য রকমের অবনমন। এক সময় যে মেডালিয়নের দাম ১০ লাখ ডলারের বেশি ছিল, তা ২ লাখ ডলারের নিচে নেমে আসে। ফলে ঋণ নিয়ে বেশি দামে মেডালিয়ন কেনা লোকেদের পক্ষে পেশা বদলও অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ‘খাঁড়ার ঘা’ হয়ে নেমে এল করোনাভাইরাস।

যুক্তরাষ্ট্রে এখন করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। গত জুনের শেষে কর্মজীবী মানুষ কাজে ফিরলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবারও অনিশ্চিত সবার ভবিষ্যৎ। সবচেয়ে বাজে অবস্থা নিউইয়র্ক নগরের। গত কয়েক মাস বেকার ভাতাসহ অতিরিক্ত ৬০০ ডলারের প্রণোদনা জীবিকা নির্বাহে সাহায্য করছিল ক্যাবিদের। এটিও এখন বন্ধ। ফলে কাজে ফিরতে হচ্ছে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। কারণ, ক্যাবিদের আয়ের একটা বড় অংশই পর্যটননির্ভর। কিন্তু এখন এই পর্যটন বন্ধ। আবারও পুরো নগর লকডাউনে চলে যেতে পারে। ফলে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ ক্যাব রাস্তায় থাকলেও, তাদের আয় এতই কম যে, এ দিয়ে জীবন নির্বাহ সম্ভব নয়।

ফলে অনেক মেডালিয়ন ও গ্যারেজ মালিক দৈনিক ভাড়ার পরিমাণ আগের তুলনায় অর্ধেক করে দিলেও চালকদের তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক চালক ব্যয়বহুল নিউইয়র্ক ছেড়ে অন্য অঙ্গরাজ্যে বা নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের অন্য কোনো এলাকায় চলে যাচ্ছেন। এ তালিকায় নিউইয়র্কের প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশি ক্যাবচালকের অনেকে রয়েছেন।

এ অবস্থায় ক্যাবিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন নিউইয়র্ক ট্যাক্সি ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্স চলতি মাসে একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করে, যেখানে মেডালিয়ন অনুমোদনের দাম ও এর বিপরীতে দেওয়া ঋণের অঙ্ক কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধে মাসিক কিস্তির পরিমাণ তিন-চার হাজার ডলার থেকে কমিয়ে ৮০০ ডলারে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে পরিকল্পনায়। কিন্তু এই পরিকল্পনা সবাইকে স্বস্তি দিতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে ক্যাবচালকদের স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও বেসরকারি ঋণদাতাদের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। গত মার্চে প্রস্তাবিত এই পরিকল্পনা গৃহীত হলে ক্যাবিদের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার থেকে নেমে ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারে আসবে। এতে ক্যাবচালকেরা ভীষণ উপকৃত হলেও বিপদে পড়বেন ঋণদাতারা, যার দায় ভোগ করতে হতে পারে সবাইকে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিউইয়র্কের ঐতিহ্যবাহী ক্যাব শিল্প দীর্ঘ দিন ধরেই সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার অন্যতম কারণ হিসেবে নগর কর্তৃপক্ষের এক সময়ের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ ভীষণভাবে দায়ী। করোনাভাইরাসের কারণে এই পরিস্থিতি আরও জটিল আকার নিয়েছে। এ অবস্থায় ক্যাব শিল্প রক্ষায় ও এর সঙ্গে জড়িত হাজারো মানুষের কথা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বসে একটি দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এই পদক্ষেপ অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে নিতে হবে, যাতে আত্মহত্যা বা নগর ত্যাগের মতো দুঃখজনক ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করতে না হয়।